বলে, দেখ আমি কিছু খুঁজে ফিরি, তা কিন্তু আমি নিজেই জানিনা। তবে তুমি যা বলছো, সে সূত্রে বলি, আমি কিছু খুঁজি কি-না জানিনা, তবে আমার ভিতর দেশ-সমাজ নিয়ে চিন্তা-ভাবনাগুলি আসে প্রায় প্রতিনিয়ত। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের অসঙ্গতিগুলো সবসময় কেন জানি আমার ভাবনায় আসে। সমাজের এবং রাষ্ট্রের অসঙ্গতিগুলি কিভাবে দুর করা যায়, সেগুলোও আমার ভাবনায় ঘুরপাক খায়। এটা কি রাজনীতি দিয়ে দুর করা যায়, গেলে কোন ধরনের রাজনীতি দিয়ে সেটা দুর হতে পারে, এসবই হয়তো আমি খুঁজে ফিরতে পারি, যেমনটি তুমি বলছো।
এই রকমই প্রিয় তার ঝন্টু ভাই, ভাবে মিতা। গ্রামে একদিন শুনেছিলো ওরই কাছে, অসঙ্গতিগুলো কি কি। এই ধরো, আমরা পাশ করার পর আমাদেরকে চাকরীর বাজারে প্রবেশ করতে হবে। একেতো দেশে সন্ত্রাাসের কারনে বিদেশী বিনিয়োগ নাই বলে কর্মসংস্থানের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত, আবার সরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে বিরাজ করছে চরম দুর্নীতি ও দলপ্রীতি। গাদি গাদি টাকা নিয়ে যাও, না হলে মেধা যতই থাকুক না কেন চাকরী হবেনা। মনে হয় মেধার কোন প্রয়োজন নাই, মেধাহীন লোকেরই প্রয়োজন বেশী দেশে । কেমন করে চাকরী পাবো আমরা, বলতে পারো মিতা ? আবার দেখ, দেশে নানা ধরনের অন্যায়, অবিবেচক কাজ দিনকে দিন এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে, মনে হচ্ছে এসব বন্দ হবেনা আর কোনদিন। কোথাও কোন সুশাসন নাই, সবখানে শুধুই দু:শাসন।
থামিয়ে দিয়েছিল সেদিন ঝন্টু ভাইকে মিতা। বলেছিল, দেশের এতো বড় বড় সব বিশৃংখলা আপনি কিভাবে মিটাবেন জনাব, শুনি? একটু যেন ঠাট্টাই করল মিতা বলে মনে হয়েছিল ঝন্টুর কাছে সেদিন।
হেসেই জবাব দিয়েছিল ঝন্টু, দেখ রাজনীতিকে তুমি ভয় পাও, তাই আর কিছু বললামনা। আমি যে টিপসগুলি দিয়েছি, সেভাবে ভাববে যখন, তখন বলবো। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল মিতা তখন, কথা আর এগোয়নি।
দিন, মাস এগিয়ে যায়। হারুন মিয়ার মৃত্যুর পর ভেঙ্গে যাওয়া সংসারের হাল তাঁর দুই মেয়ে তাদের টিউশনির আয়ের মাধ্যমে মোটামুটিভাবে ধরে রেখেছে। নিজেরা তারা পড়াশুনাটা ঠিক রেখেছে আবার বাড়ীতে মা-ভাইয়েরও কোন অসুবিধা হতে দিচ্ছেনা। পারছেনা শুধু মায়ের কান্না থামাতে। এ বড়ই কঠিন কাজ, জানে ওরা। বছরখানেক হয়ে এলো হারুন মিঞার গত হওয়া, এখনও মেয়েরা বাসায় এসে পরম আদরে মাকে জড়িয়ে বসে থাকে অনেক, অনেকক্ষন করে। অনূ বলে, তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব মা, চাকরী একটা পেয়ে নিই আগে। বছরখানেক অপেক্ষা কর আর। হাহাকার করে ওঠে মায়ের মন।
ধীরে ধীরে আরো কঠিন হয়ে ওঠে মিতার মন। এর মধ্যে একদিন দীর্ঘক্ষন কথা হয় ঝন্টুর সাথে। ব্যস্তভাবে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল ঝন্টু একদিন। সদরঘাটে সস্তায় বই প্রকাশ করে দেন কিছু লোক। তাদেরই একজন সেলিম ভাই, ভ্যানে করে বই বিক্রি করেন তিনি, সস্তায় বই প্রকাশও করে দেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক কারনে যারা বই প্রকাশ করতে পারেননা, তাদের ভরসা ইনারাই। মাঝারী মানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে যেখানে খরচ হয় প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা, ইনারা সেখানে পাঁচ-সাত হাজারের মধ্যে প্রকাশ করে দিতে পারেন, তবে মান অবশ্য নিম্নই হয়। ঝন্টুর সাথে একটা ছেলেও ছিল সেদিন। ছেলেটা সেরকম একজনের কাছে যাচ্ছিল কবিতার একটা বই ছাপবে বলে। পথে দেখা হয়ে গেল মিতার সাথে। ফেরার সময় মিতার সাথে কথা বলবে বলে ছেলেটাকে নিয়ে চলে গেল ঝন্টু।
ঐতিহাসিক ভিক্টোরিয়া পার্কে বসে কথা হচ্ছিল তাদের মধ্যে। সাথের ছেলেটা ছিলনা তখন। মিতাই প্রথমে বলে, অনূর রাজনীতি তোমার অপছন্দ কেন ঝন্টু ভাই? সে-ও তো গনমানুষেরই কথা বলে।
দেখ মিতা, শুরু করে ঝন্টু, ব্যাপক মানুষ তথা খেটে খাওয়া মানুষের উপর অনূর সহমর্মিতার কোন অভাব আছে তা আমি বলিনা। তবে অনূর রাজনীতিতে গনমানুষের কোন লাভ হবে বলেও আমি মনে করিনা। আমাদের এখন অনূধাবনের সময়, স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পার হতে যাচ্ছে, অথচ আমাদের রাজনীতি আমাদের অর্থাৎ আমরা তরুন প্রজন্ম কি চাই, সেটাই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। আজও এদেশে রাজনীতি হয় ব্যাবসায়িক মনোভাব নিয়ে অর্থাৎ রাজনীতি যেন ব্যাবসায়িক বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে। আর এই ব্যাবসায়িক মনোভাবের জন্যই রাজনীতিতে এতো হানাহানি, এতো সহিংসতা, যা আমাদের গোটা সমাজজীবনে ছড়িয়ে পড়েছে।
এসব আমাদের অজানা নয় ঝন্টু ভাই। আর কি বলবেন আপনি ?
আমি বলতে চাই মিতা, রাজনীতি আমাদের চাহিদামতো হতে হবে। আমরা চাই দেশ ন্যায়-নীতির ভিত্তিতে চলুক, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হোক, কিছু সুবিধাভোগী মানুষের পরিবর্তে সকল শ্রেণী-পেশার সব মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক। শুধুমাত্র রাজনীতির কারনে কেন এতো অশান্তি থাকবে মানুষের জীবনধারনে, মানুষের জীবনযাপনে?
কি করবেন আপনি, আপনারা?
দেখ মিতা, শিক্ষিত তরুন-তরুনীসহ দেশের আপামর জনগনের আজ পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতি শুদ্ধ করার। আমরা দেশে সহিংসতা, হানাহানি বন্দ করে সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ভাবে, নায্যভাবে কাজ করতে বাধ্য করব। যেখানেই কোন অন্যায় দেখব, গর্জে উঠব আমরা এবং উক্ত অন্যায় কাজ বাতিল করে সঠিক ন্যায়ানূগভাবে কাজটি যতক্ষন না সমাধা হচ্ছে, চাপ অব্যাহত রেখেই যাব আমরা, থামবনা।
এতো সহজ কাজ তো এটা মোটেই নয় ঝন্টু ভাই। আপনারা এটা করতে গেলে এর ফলে যারা ক্ষতিগ্রন্থ হবে, তারা এটা আপনাদেরকে করতে দিবে কেন? বিবাদ লেগে যাবেনা দেশব্যাপী?
আমাদের একটা খোলা ডাক দিতে হবে মিতা। সেই ডাকে কেউ সাড়া দিবেনা বলে আমি মনে করিনা। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ তাতে সাড়া না দিয়ে পারবেনা। মানুষকে সংগঠিত করে কংক্রিটের মত জমাট বাঁধিয়ে ফেলতে হবে। আর কিছু করতে হবেনা। এই জমাট এতো শক্তিশালী হবে যে, সুবিধাভোগী সকল শক্তিই এটার কাছে অতি তুচ্ছ হয়ে যাবে। মানুষের সন্মিলিত শক্তি অপরাজেয়। অপ্রতিবোধ্য হয়ে উঠবে এই শক্তি। দরকার শুধু শুরুটা করাটা। আর বিবাদ বলছো! ধবংস ছাড়া কোন সৃষ্টি হয় কি? রাতের আঁধার না কাটলে কিভাবে সূর্য আলো ছড়াতো, বলতো। এ হবে আরেক যুদ্ধ মিতা। একাত্তরে ত্রিশ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং দু’লাখ মা-বোনের চরমতম অপমানের বিনিময়েইতো স্বাধীন হয়েছে আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি। এই চরম ক্ষতিগুলি যদি না হোত, কেমনে তবে আমরা স্বাধীন হতাম? অনেক ধ্বংস, অনেক ক্ষতি না হলে কিভাবে আমরা শুদ্ধ হবো? অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পরেই না আকাশে উঠবে আগামীর ঐ রক্তিম সূর্য।
তন্ময়তার কেমন যেন একটা ভাব এসে গিয়েছিল মিতার মধ্যে, কথাগুলো শুনতে শুনতে। সেই ভাবটা কাটতেই আবার শুরু করে ঝন্টু, বলে, হারুন চাচার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইতে তুমি, মিতা। তিনি এবং তাঁর মতো মারা যাচ্ছেন যারা একান্তই অকারনে, তাঁদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে আমাদের সবার এই সন্মিলিত কার্যক্রমে। আসবেনা মিতা তুমি সন্মিলিত এই কার্যক্রমে? ভালো করে ভেবে দেখ, আর কি কোন পথ আছে আমাদের সামনে এছাড়া?
হাঁ ঝন্টু ভাই, আমাদের সবাইকে আসতে হবে এই উদ্যোগে, সবাইকে আমাদের, বিশেষত: আমাদের আজকের এই প্রজন্মকে ধাবিত হতে হবে সেই রক্তিম সূর্যের দিকে, এভাবেই।
আসলেই তাই মিতা, আমরা সেভাবেই ধাবিত হবো; চল, উঠতে হবে আমাদের, সন্ধা প্রায় পার হয়ে গেল।
কি যেন কি পড়ে গেল মিতা, চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝন্টুর। পরক্ষনেই ঝট করে উঠে বলল, চলেন ঝন্টু ভাই।
ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে বেরিয়ে এল দু’জন, চলে গেল দু’দিকে; মিতা জগন্নাথের আর ঝন্টু ফুলবাড়িয়া, তার মেসের দিকে।
৫টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
রাজনীতি শুদ্ধ হোক ।
খুব ভালো একটি সিরিজ শেষ করলেন ।
এই প্রজন্মকে সঠিক ভাবে চালাতেই হবে ।
শুভ কামনা ।
প্রহেলিকা
আশাবাণী শুনতে ভালো লাগে সাহস পাই মনের মাঝে। লিখে যান একদিন হয়তো তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাবে। শুভকামনা রইল।
আজিম
আসলেই ।
আজিজুল ইসলাম
Aponader sokolke antorikvabe dhonyobad .
Jonab Prohelika amar kache kichu jobab ceyechilan amar ‘zevabe asbe shuddhota’ namok likhay . ami diyechi . montobyo korte hobena . porben asha kori .
Ovro ei muhurte nei bidhay english-e likhchi bole onutopto .
খসড়া
ভাল লাগলো।