(সোনেলায় আসা হয় না বহুদিন। আসবো , লিখবো, লিখবো করেও হয়ে উঠে নি। হয়ে উঠে না অনেকসময় অনেক কিছু। যাহোক, নিজের কথা অন্য একদিন বলবো। আজকে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে সামান্য একটা লেখা দিচ্ছি। হতেপারে লেখাটিতে অনেক তথ্যের কমতি কিংবা ভুল। সেক্ষেত্রে আপনাদের সহযোগিতা তো আমি চাইতেই পারি...    🙂   !  )

 

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধদের বিচারের ব্যাপারটি প্রাচীন-কাল থেকেই চালু রয়েছে। গ্রীক পুরাণেও যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগেও রয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের নমুনা। ১৪৭৪ সালে হাগেনবাখের স্যার পিটারকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো। ১৮১৫ সালে পরাজিত ফরাসী সম্রাট নেপোলিয়ানকে অপরাধী ঘোষণা করে বৃটিশ সরকারের কাছে তুলে দেয় ভিয়েনা কংগ্রেস।ফলস্বরূপ ফলস্বরূপ সেইন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়া হয়েছিলো তাঁকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য দায়ী জার্মানদের বিচারের দায়িত্ব জার্মান সরকারের ওপর ন্যস্ত করে মিত্র শক্তিসমূহ। ১৯২০ সালে ৪৫টি মামলার দায়িত্ব নিয়ে ১২ জনের বিচার করে জার্মানী এবং ছ’জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। এ-বিচার ‘লাইপজিগ ট্রায়াল’ নামে পরিচিত। যুদ্ধাপরাধীদের লঘুদণ্ড প্রদানের কারণে এ-রায় মেনে নেয়নি মিত্র শক্তি। মিত্র দেশগুলো নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৪৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল মিলিট্যারী ট্রাইবুন্যাল গঠন করে। এটা নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচিত। জাপানের যুদ্ধপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত হয় টোকিও ট্রাইবুন্যাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের এখনও যেখানে পাচ্ছে, সেখানে থেকে ধরে আদালতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। দেশে-দেশে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির অনেক নমুনা রয়েছে। হিটলারের সহযোগী আইখম্যানকে ১৯৬২ সালে আর্জেটিনা থেকে ধরে বিচারের কাঠগড়ায় আনা হয়। ১৯৯০ সালে বসনিয়া, ক্রৌয়েশিয়া ও কসোভোয় গণহত্যার জন্য মিলেসোভিচকে ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের সামনে দাঁড় করানো হয়েছে।

অত্যন্ত আক্ষেপ আর লজ্জার বিষয় হলেও সত্যি যে, ১৯৭১ সালে এদেশে সংঘটিত পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণহত্যার বিচারটি পাবার জন্য এ জাতিকে দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছে।সময়ের হিসেবে আর মানুষ হত্যার হিসেবের অনুপাতে বাংলাদেশের গণহত্যাকেই আমি “পৃথিবীর সবচাইতে বৃহৎ গণহত্যা” বলবো। বর্ণনাতীত নৃশংসতার জন্য হিটলারের নাম বিশ্ব ইতিহাসে সুপরিচিত ; সাথে আরও রয়েছে চেঙ্গিস খান,হালাকু খান,নাদির শাহ্‌।আর সত্তুরের দশকে সেই নৃশংসতার ইতিহাসে আরও যুক্ত হয়েছে তৎকালীন পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান,নিয়াজী,রাও ফরমান আলী ও ব্রিগেডিয়ার বশিরের মতো কিছু নরপিশাচ।১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত থেকে শুরু করে ১৬ ই ডিসেম্বর মধ্যাহ্ন পর্যন্ত এই নর পিশাচেরা এদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, তাতে নাদির,চেঙ্গিস ও হালাকুর আত্মাও সম্ভবত শিউরে উঠবে।আঁতকে উঠবে হিটলারের মতো একনিষ্ঠ ঘাতকের অভিশপ্ত আত্মাও। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি এখনো এ জাতি সেসব ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ইস্যুতে একাত্ম হতে পারে নি। ১৭ কোটির এ দেশটিতে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়াবার মতো লোকের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে এ সমস্ত লোকেরা সর্বপ্রথম যেই প্রশ্নটি করে তা হল “এতো বছর পরে কিসের বিচার!”
এক্ষেত্রে আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই- ফৌজদারি অপরাধের বিচার কখনো তামাদি হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার ২৪ বছর পরে ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ পর্যন্ত মস্কো শহরে ৪ দিনব্যাপী একটি সম্মেলন হয়। যার আলোচ্য বিষয় ছিল “নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার”। উক্ত সম্মেলনে রাশিয়াসহ বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, জার্মান প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, গ্রিস, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, এবং সুইডেনের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। আলোচনা শেষে সকল প্রতিনিধিরা নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে যে মতামত প্রদান করে সেটার সংখিপ্ত অনুবাদ হল-
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে জার্মান ফ্যাসিবাদী ও সমরবাদীরা শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছিলো তা স্মরণে রেখে, যারা ফ্যাসিবাদীদের অত্যাচার থেকে জনগণকে মুক্ত করার জন্য জীবন দিয়েছেন তাঁদের স্মরণে এনে ; এটা লক্ষনীয় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার এক শতাব্দীর চতুর্থাংশ পার হলেও পশ্চিম জার্মানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি বরং তাদের অনেকেই সেখানে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছে। আমরা পশ্চিম জার্মানির গণতান্ত্রিক দলকে আহ্বান জানাচ্ছি কোন যুদ্ধাপরাধী যেন শাস্তি থেকে রেহাই না পায়। তেমন কার্যক্রম জরুরী কারণ নাৎসিদের হাতে অত্যাচারিত ও নিহত লাখ লাখ ব্যক্তির ত্যাগ ও আত্মদান স্মরণে রাখার উদ্দেশ্যে এবং শান্তিময় ভবিষ্যতের নিমিত্তে…”
তাহলে এবার আমি “এতো বছর পরে কিসের বিচার!”- এই প্রশ্নকারীদের পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই- “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এতো বছর পরে যদি নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়, তবে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেন নয়?”
এবার আরেকটি প্রসঙ্গে আসা যাক। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে কিছু লিখলেই অনেকেই অভিযোগ করতে দেখা যায় যে, “কেন ১৯৭২ সালেই এদের বিচার করা হল না?” । অনেকে আবার খানিকটা আক্ষেপ করে বলেন, “যদি ১৯৭২ সালেই এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করা হতো তাহলে স্বাধীনতার পরে এই ৪৪ বছর যাবত এরা এদেশে এদের শেকড় গাঁড়তে পারতো না, এদের পক্ষে কেউ কথা বলার সাহস পেতো না”। অনেকে তো আবার সরাসরি বঙ্গবন্ধুকেই দোষারোপ করে বসেন যে, তিনিই নাকি তখন সেরকমভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কোন পদক্ষেপ নেন নি। আমার এই লেখাটি মূলত তাঁদের জন্যই যারা নিজেদের মনে এরকম সংশয়, রাগ, ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছেন।
প্রারম্ভিকাঃ
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সমগ্র বাঙালি জাতি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব নরপিশাচ পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে সাহায্য করেছিলো তাদের বিচারের প্রত্যাশায়।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এসে রেসকোর্স ময়দানে জনতার উদ্দেশ্যে বলেন-
“বিশ্বকে মানবতার ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল এই বর্বরতার তদন্ত করুক এটাই আমার কামনা”(দৈনিক বাংলা, ১১/১/৭২)
এমনকি সেই সময়ে বহির্বিশ্ব থেকে যারা সহানুভূতি জানাতে এদেশে এসেছিলেন তাঁরাও বিশেষ ট্রাইবুনালে সকল যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানায়। এ প্রসঙ্গে কিছু ঘটনা উল্লেখ করিঃ- বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রতিনিধি দলের নেত্রী মাদাম ইসাবেলা রুম ১৯৭২ সালের ২০ শে জানুয়ারি ঢাকায় সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-
“শিয়াল বাড়ি বধ্যভূমিতে বাঙালি হত্যাযজ্ঞের যে লোমহর্ষক নৃশংসতার স্বাক্ষর আমি দেখেছি তাতে আমি শোকাভিভূত ও সন্ত্রস্ত হয়ে গিয়েছি। এই হত্যাকাণ্ড নাৎসি গ্যাস চেম্বারের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও অনেক বীভৎস”
তিনি সাংবাদিকদের আরো জানান যে, তিনি দেশে ফিরে গিয়ে পরিষদের সভাপতির কাছে এই গণহত্যার জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করতে বলবেন। (দৈনিক আজাদ, ২২/১/৭২) [তথ্যসূত্রঃ দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী- এ এস এম সামছুল আরেফীন ; পৃঃ০৭]
স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থক মার্কিন সিনেটের ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এডলাই স্টিভেনস কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের বধ্যভূমিগুলো পরিদর্শন করে ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি বলেন-

“বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নৃশংসতা ছিল ভয়াবহ ও মানবজাতির ইতিহাসে তার কোন নজির নেই। এই বর্বরতা মানুষের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে” (দৈনিক আজাদ, ৩১/১/৭২) [তথ্যসূত্রঃ দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী- এ এস এম সামছুল আরেফীন ; পৃঃ০৭]

মার্কিন সিনেটের অপর সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন-
“মানুষের মস্তিষ্কে এ ধরনের বর্বরতার চিন্তা আসতে পারে এ কথা ভাবতেও কষ্ট হয়” (দৈনিক আজাদ, ১৭/২/৭২) [তথ্যসূত্রঃ দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী- এ এস এম সামছুল আরেফীন ; পৃঃ০৭-০৮]

ফরাসী সাহিত্যিক আঁদ্রে মালরো বলেছিলেন-
“দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় নাৎসিদের নৃশংসতার নিদর্শন আমি দেখেছি। কিন্তু এখানকার নৃশংসতা তার চেয়ে অনেক বেশি” (দৈনিক আজাদ, ১৩/৩/৭২) [তথ্যসূত্রঃ দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী- এ এস এম সামছুল আরেফীন ; পৃঃ০৮]
এবং এরা প্রত্যেকেই পাক বাহিনীর এই নৃশংসতার জন্য যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করতে বলেন।

দালাল আইনের গোড়াপত্তনঃ
১৯৭১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে মন্ত্রী পরিষদের এক বৈঠকে যুদ্ধাপরাধী বিষয়ে গণহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হাইকোর্টের কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত কোন বিচারপতি বা সমপর্যায়ের কোন মনোনীত ব্যক্তির নেতৃত্বে কমিশনটি পাক বাহিনী ও তাদের দালালদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মৌখিক ও লিখিত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে ব্যাপক রিপোর্ট পেশ করবেন বলে ঘোষণা করা হয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছে তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২ বা দালাল আইন আদেশ শিরোনামে আইন প্রণয়ন করা হয়।
শহীদদের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ঢাকার রাজপথে মিছিল বের হয়। সেদিনের সেই মিছিলে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করা হয়। পরবর্তীতে সেই মিছিলের ৯ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের-ই ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ও টিভি ভাষণে পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি আবার সামনে নিয়ে আসেন। পাক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচলাখ বাঙ্গালীকে ফেরত দেয়ার বিষয়টি পাক যুদ্ধবন্ধীদের মুক্তির সঙ্গে শর্তযুক্ত করায় শেখ মুজিবুর রহমান এ ভাষণে বলেন,
‘তাঁদেরকে (পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালী) ফিরিয়ে দেয়া হোক। এ ইস্যুকে কোনোক্রমে যুদ্ধবন্দীদের সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের (পাক যুদ্ধবন্দীদের) মধ্যে এমন অনেক আছেন যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যার অপরাধে অপরাধী। তারা মানবিকতাকে লঙ্ঘন করেছে এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে বিচার হবে।’
২৬শে এপ্রিল দিল্লী স্টেটসম্যান পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন-
“যারা গণহত্যা করেছে তাদের এর পরিণতি থেকে রেহাই দেয়া যায় না। এরা আমার ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। এদের ক্ষমা করলে ভবিষ্যতে বংশধরগণ এবং বিশ্বসমাজ আমাদের ক্ষমা করবেন না” (দৈনিক বাংলা, ৩০/৪/১৯৭২)
একই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারী , ১ জুন ও ২৯ আগস্ট তারিখে তিন দফা সংশোধনীর পর আইনটি চূড়ান্ত হয়।শুধু দালাল আইন নয়, আরও কিছু আদেশ জারী করা হয় সে-সময়ে। নিজ-নিজ জেলা আদালতে গোলাম আজম ও তার সঙ্গীদের হাজির হওয়ার নির্দেশ জারী হয় ১৯৭২ এর ১৪ ফেব্রুয়ারী । ১৯৭২ সালের ১৬ মে বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়,
‘বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্ডিন্যান্স প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে কলাবরেটের আইনের অধীনে কলাবরেটর-দালালদের বিচারের কাজ শুরু হয়ে গেছে।’
১৯৭২ সালের ২ জুলাই কুষ্টিয়ার এক জনসভায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু পুনরায় জোর দিয়ে বলেন,
‘পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’
১৯৭২ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বলেন,
‘সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের সম্পর্কিত তদন্তের পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা প্রকাশ করা হবে।’
একই বছরের ১৫ ডিসেম্বরে জারী করা হয় বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন।নভেম্বর সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক ধর্ম নিয়ে রাজনীতি রহিত করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস রিলিজে বলা হয়,
তদন্তের মাধ্যমে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর মধ্য থেকে ১৯৫ জনকে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, জেনেভা কনভেনশনের আর্টিকেল তিন এর লংঘন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটের অপরাধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালের ১ জুনের এক খবরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে বলা হয়,
‘টোকিও ও নুরেমবার্গ বিচারের সময় যে মূল নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জাতীয় সংসদে বাজেট অধিবেশনে একটি বিল পেশ করা হবে।’
১৯৭৩ সালের ৮ জুন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সাক্ষাৎকারে জানান,
‘ইতিপূর্বে তালিকাভুক্ত পাক যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ১২০০ থেকে কমে ১৯৫ জন হয়েছে। এই ১৯৫ জন পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।’
এরপর ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল গ্যাজেট-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গোলাম আজমদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।একটা চলমান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম। গোলাম আজমরা এ-সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

দালাল আইনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারঃ
একাত্তরে যেসব রাজাকারেরা পাকি বাহিনীর সাথে এ দেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো তাদেরকে “দালাল আইনে” গ্রেপ্তার করা শুরু হয় ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে এবং বিচার কাজ শুরু হয় এপ্রিলে। ১৯৭৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে অর্থাৎ ৩১ শে অক্টোবর পর্যন্ত দালাল আইনে গ্রেপ্তারকৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৭ হাজার ৪৭১ জন। এদের দ্রুত বিচারের জন্য তৎকালীন সরকার সারাদেশে ৭৩ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এর পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে কর্মরতদের কেউ দালালি এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না তা যাচাই করার জন্য ১৯৭২ সালের ১৩ জুন একটি আদেশ জারি করে যা তখন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ ১৯৭২ এ দন্ডপ্রাপ্ত বিভিন্ন ব্যক্তির সাজা এখানে উল্লেখ করলামঃ-
• ১৯৭৩ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি, বাংলার বাণী পত্রিকার একটি খবরের শিরোনামে বলা হয় “দালাল মন্ত্রী ইসহাকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড”।এই ইসহাক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থনে গঠিত ডা.মালিক মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।স্বাধীনতার পর ওই মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সঙ্গে একেও গ্রেপ্তার করা হয়।রায়ের প্রায় ১০ মাস পর ’৭৩-এর ৫ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি পান। মুক্তিযুদ্ধের পর সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ২৪ মাস কারাগারে ছিলেন।

• ১৯৭৩ তারিখে দৈনিক পূর্বদেশ এ পাওয়া যায় -’দালাল আইনে সা’দ আহমদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড’।খবরে বলা হয়, কুষ্টিয়া সেশন জজ-৩-এর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য আর কে বিশ্বাস কুষ্টিয়া শান্তি কমিটির সদস্য সা’দ আহমদকে পাক বাহিনীকে সহযোগিতা, অপহরণ ও নরহত্যার অভিযোগে এবং কুষ্টিয়া-১১ আসনে সাজানো উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। রায়ে আদালত বলেন, ‘অভিযুক্তের আরও বেশি শাস্তি দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই জেলার একজন সফল আইনজীবী হিসেবে অতীতের কাজের জন্য তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হলো।’

• ১১ জুন, ১৯৭২ তারিখে দৈনিক বাংলায় প্রধান শিরোনাম ছিল−‘দালালির দায়ে মৃত্যুদন্ড’। কুষ্টিয়ার দায়রা জজ ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সদস্য রবীন্দ্র কুমার বিশ্বাস ৮ জুন রাজাকার চিকন আলীর বিরুদ্ধে এ রায় দেন। কুষ্টিয়ার মিরপুর গ্রামের চিকন আলীর বিরুদ্ধে ’৭১ সালের ১৯ অক্টোবর একই গ্রামের ইয়াজউদ্দিনকে গুলি করে মারার অভিযোগ ছিল। পরে উচ্চ আদালত সাজা কমিয়ে চিকন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। আট বছর চার মাস জেল খাটার পর দালাল আইন বাতিলের সুযোগে চিকন আলী ছাড়া পায়।

• ৬ অক্টোবর, ১৯৭২ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, প্রখ্যাত শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ হত্যার অভিযোগে ১৯৭২ এর ৫ অক্টোবর ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনালের জজ সৈয়দ সিরাজউদ্দীন হোসেন আইয়ুব আলী, মকবুল হোসেন ও যোবায়ের নামের তিন আলবদর সদস্যকে মৃত্যুদন্ড। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আজিমপুরের দায়রা শরিফের বাসভবন থেকে ড. আজাদকে অপহরণ করে আলবদররা।

• দালাল আইনে সবচেয়ে বেশি কারাদন্ড হয় কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ গ্রামের দালাল আবদুল হাফিজের। হত্যা, লুট ও দালালি মামলায় বিভিন্ন ধারায় তাঁকে আদালত ৪১ বছরের দন্ড দেন। ১৯৭৩ সালের ১২ এপ্রিল বাংলার বাণী পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয়।মামলার বিবরণে দেখা যায়, ’৭১-এর ১৫ অক্টোবর রাতে আবদুল হাফিজ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নিজ গ্রামের ইয়াসিন মিয়ার বাড়িতে ঢুকে তাঁর ভাগ্নে শাহ আলমকে হত্যা এবং ইয়াসিন মিয়ার বাবাকে অপহরণ করেন। ইয়াসিন মিয়া বাড়ির পেছন দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে দুই হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁর বাবাকে মুক্ত করেন তিনি।

• ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে বগুড়ার ধুনট উপজেলার কালেরপাড়া ইউনিয়নের সরুগ্রামের আয়েজ মন্ডলের তিন ছেলেকে দন্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে মফিজুর রহমান ওরফে চান মিয়াকে মৃত্যুদন্ড, মোখলেছুর রহমান ওরফে খোকা মিয়া ও মশিউর রহমান ওরফে লাল মিয়াকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ধুনট উপজেলার নান্দিয়ারপাড়া গ্রামের নুরুল ইসলাম তাঁদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। উচ্চ আদালত পরে চান মিয়াকে মৃত্যুদন্ডের বদলে ২০ বছর সাজা দেন। অপর দুই ভাইয়ের সাজাও কমিয়ে প্রত্যেককে ১০ বছর কারাদন্ড দেওয়া হয়।

• মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চর শিলমন্দি (এখন পূর্ব শিলমন্দি) গ্রামের মাতবর কেরামত আলী কাজীর বিরুদ্ধে দুটি মামলায় মোট আট বছর কারাদন্ড হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে দড়ি চর শিলমন্দি গ্রামের সামসুদ্দিন মাস্টার ও সিরাজ নামের দুই মুক্তিযোদ্ধা মামলা করেন। উভয় মামলায় কেরামত আলীর সাজা হয়। কেরামত কাজী ১৯৯০ সালে মারা যায়।

• ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি আজাদ পত্রিকার খবরে বলা হয়, ডা. মালিকের মন্ত্রিসভার পূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।

• ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, ঢাকার বিশেষ আদালত পূর্ব পাকিস্তান বিবিসির সংবাদদাতা নিজামউদ্দীনের অপহরণের সঙ্গে জড়িত আলবদর সিদ্দিকুর রহমান ও মোহাম্মদ গালিবকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ১৯৭১-এর ১২ ডিসেম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজামউদ্দীনের ঢাকার তৎকালীন রোকনপুর হাউস থেকে অন্য আলবদরদের সহায়তায় অপহরণ করে।

• ১৯৭৩ সালের ১২ জুলাই দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, রাজশাহীর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল শ্রী কান্তি দাস হাওলাদারকে হত্যার অভিপ্রায়ে অপহরণ করায় মুজিবুর রহমান নামে এক রাজাকারকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন।

• ১৯৭৩ সালের ১৪ এপ্রিল তৎকালীন পূর্বদেশ পত্রিকায় একটি খবর ছিল, পাক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ এবং তিন পল্লীবধুর শ্লীলতাহানির অভিযোগে মৌলভীবাজারের দীরুল আজীর আসিফ আলীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ২০ এপ্রিল দৈনিক সংবাদ-এর একটি খবরে দেখা যায়, কুমিল্লায় বিশেষ আদালত আবদুল হামিদ ও আজিজউল্লাহ্ নামের দুই দালালকে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। রফিক উদ্দিন নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরিয়ে দেওয়ার অপরাধে তাঁদের সাজা দেন আদালত।

১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালের দৈনিক পত্রিকাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কয়েক দিন পরপরই তখনকার পত্রিকায় দালাল আইনে সাজা হওয়ার খবর প্রকাশিত হতো। তাই “কেন ১৯৭২ সালেই রাজাকারদের বিচার করা হল না?”- এ ধরনের প্রশ্নগুলোকে আমি সম্পূর্ন অযাচিত ও ভিত্তিহীন বলবো। সেই সাথে যারা এরকম প্রশ্ন করে, তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, এরা যেকোনভাবেই প্রমান করতে চায় যে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে কোন উদ্যোগ-ই নেন নি। যার ফলে এখনো রাজাকারের বিচার চলছে। কিন্তু এতোসব তথ্য প্রামান থাকায় এরা কখনোই সফল হতে পারবে না ।

সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার প্রেক্ষাপটঃ
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধের বিচার করে যাননি। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে গেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর যুক্তি হিসেবে অনেক মিথ্যা প্রচারের ভেতর এটা একটি চমৎকার উদাহরণ। বঙ্গবন্ধু কোনোদিন যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে যাননি।বরং তিনই সেই বিচারকার্য বিচারিক কাঠামোয় শুরু করে গিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে অনেকে ইনিয়ে বিনিয়ে “ বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার” অপব্যাখ্যা করতে চায়। কিন্তু ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়ে কোন ধরনের অপব্যাখ্যাই গ্রহনযোগ্য হবে না। কারণ ১৯৭৩ সালের ৩০শে নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছিল না তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। এ ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের অধিক ব্যক্তির ভেতর থেকে প্রায় ২৬ হাজার ছাড়া পায়। তবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার ৫নং ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়ঃ-

‘যারা আদেশের নিচের বর্ণিত ধারাসমূহে শাস্তিযোগ্য অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত অথবা যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে অথবা যাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত ধারা মোতাবেক কোনটি অথবা সব ক’টি অভিযোগ থাকবে অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান করেছে সেসব অপরাধী কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য ননঃ -
১. ১২১ (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানো অথবা চালানোর চেষ্টা),
২. ১২১ ক (বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ষড়যন্ত্র),
৩. ১২৮ ক (রাষ্ট্রদ্রোহিতা),
৪. ৩০২ (হত্যা),
৫. ৩০৪ (হত্যার চেষ্টা),
৬. ৩৬৩ (অপহরণ),
৭. ৩৬৪ (হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ)
৮. ৩৬৫ (আটক রাখার উদ্দেশ্যে অপহরণ),
৯. ৩৬৮ (অপহৃত ব্যক্তিকে গুম ও আটক রাখা),
১০. ৩৭৬ (ধর্ষণ)
১১. ৩৯২ (দস্যুবৃত্তি),
১২. ৩৯৪ (দস্যুবৃত্তিকালে আঘাত),
১৩. ৩৯৫ (ডাকাতি),
১৪. ৩৯৬ (খুনসহ ডাকাতি),
১৫. ৩৯৭ (হত্যা অথবা মারাত্মক আঘাতসহ দস্যুবৃত্তি অথবা ডাকাতি),
১৬. ৪৩৫ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে ক্ষতিসাধন),
১৭. ৪৩৬ (বাড়িঘর ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার),
১৮. ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৩৬ (আগুন অথবা বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে কোন জলযানের ক্ষতিসাধন) অথবা এসব কাজে উৎসাহ দান।
সুতরাং এ বিষয়গুলো জানার পরেও যারা বলে যে বঙ্গবন্ধু রাজাকারদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে বঙ্গবন্ধুকে অপমান করার জন্য এবং নিলজ্জতার সীমা অতিক্রম করে রাজাকারদের পক্ষ নেবার জন্যই কথাগুলো বলে।

জিয়াউর রহমান কর্তৃক দালাল আইন বাতিলঃ
সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি এ সকল অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম চলমান ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ এর ১৫ই অগাস্ট শেখ মুজিবর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যে দিয়ে পাল্টে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান।১৯৭৫ সালের এর ৩১শে ডিসেম্বর জেনারেল জিয়া সামরিক অধ্যাদেশ জারী করে দালাল আইন বাতিল করে । থেমে যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম।শেখ মুজিবর রহমান সরকারের জারী করা আইনগুলো একের পর এক অধ্যাদেশ জারী মধ্য দিয়ে রহিত করা হয়।
১৯৭৬ সালে ‘Second proclamation order no. 2 of 1976′ জারী করে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেয়া হয়। ১৯৭৬ এর ১৮ জানুয়ারী নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আবেদন করতে বলা হয় গোলাম আজমকে। এছাড়াও ‘proclamation order no. 1 of 1977′ দ্বারা সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া হয়। মার্শল ল’র আওতায় এসব অধ্যাদেশ জারী করে জেনারেল জিয়ার সরকার। এসব অধ্যাদেশে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম।

আমি জানি এতোসব তথ্য উপাত্ত থাকার পরেও অনেকে তাদের অযাচিত প্রশ্নগুলো বার বার করে যাবেন। তাদের উদ্দেশ্য করে কিছুই বলার নেই। ইতিহাস হল সময়ের হিসেব।ঘটনাচক্রে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের হিসেবটা অতন্ত রক্তাক্ত।তাই যখনই সেই ইতিহাসের হিসেবের খাতার পৃষ্ঠাগুলো উন্মোচন করে, তখন সুকান্তের একটা কথা মনে পরে-“হিসেবের খাতা যখনই নিয়েছি হাতে,দেখেছি লিখিত রক্ত খরচ তাতে…”
মানুষ মরে যায়, পচে যায়, নিঃশেষ হয়ে যায় একসময়।কিন্তু ইতিহাসের কোন মরণ নেই,কোন শেষ নেই।ইতিহাস সত্যিটাই আমাদের সামনে তুলে ধরে। বরং আমরাই বারবার ইতিহাসকে বিকৃত করি, মিথ্যাচারের আশ্রয় নিই। কিন্তু আদতে তাতে কোন লাভই হয় না। ইতিহাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করবার সাধ্য কারোর-ই নেই, থাকে না।

তথ্যসূত্রঃ

০১. দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী- এ এস এম সামছুল আরেফীন।
০২. ৭৩-এর আইনের সহজপাঠ এবং ৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার।
০৩.https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B2_%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8_%28%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B7_%E0%A6%9F%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%87%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B2%29_%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6_%E0%A7%A7%E0%A7%AF%E0%A7%AD%E0%A7%A8
০৪. https://www.amarblog.com/SKhan/posts/184305
০৫. 298. Bangladesh Collaborators (Special Tribunals) Order, 1972 – Alimuzzaman Choudhury

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ