একটা কিশোরী আরেকটা কৈশরে পা দিবে এমন দুইটা মেয়েরে মায়ের কাছে রেখে আমার বাবা চিরকালের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের দুইবোনের পড়াশুনাসহ যাবতীয় সব বাবাই দেখতেন। হঠাৎ করে সব হারানো আমরা তিন নারী একজন আরেকজনকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরলাম। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ছিলো মায়ের। মা ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। আমার দাদু তখনও বেঁচে, বৃদ্ধ। বোন বিপদে পড়লে তার ভাইবোনেরা পাশে দাঁড়ায়, আমার মায়ের তাও ছিলো না। উল্টা বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে বলে দাদুর কথাও মায়ের ভাবতে হতো।

 

মা আমাদের দুইবোনকে পাখির মতো আগলে বুকে রাখলেন। বাবার মৃত্যুর সময় যেতে লাগলো, আর আশেপাশের অনেকের আসল চেহারা সামনে আসতে লাগলো। উপকারের বদলে অপকার করলেন অনেকে। আমি বছরখানেক অস্বাভাবিক ছিলাম, বাবার মৃত্যুটা মেনে নিতে পারিনি। এরপর একদিন নিমেষে বড় হয়ে গেলাম, মনে হলো আমি বড় সন্তান, আমার কতো দায়িত্ব! মা ছিলেন হাই স্কুলের শিক্ষক। আমাদের দুইবোনের জন্য মা যে কষ্ট করেছেন তা আমরা নিজে দেখেছি। স্কুল থেকে মা কোনদিন ভ্যানে আসতো না, চিরকাল হেঁটে, বলতেন হাঁটা ভাল, রোদের মধ্যে ৩৫/৪০ মিনিট হেঁটে কেন আসতেন আমরা ঠিক বুঝতাম। আমরা সারাজীবন বাবার বাইকে চলাফেরা করেছি। বাবা সকালে মাকে স্কুলে দিয়ে এরপর আমাদের স্কুলে দিয়ে নিজে কলেজে যেতেন। মায়ের হাঁটা দেখে আমিও কলেজে পড়ার সময় আমাদের বাজার থেকে আধাঘন্টা হেঁটে বাড়ি আসতাম। একদিন হাঁটছি পাশের এক মহিলা বলছেন শুনলাম আহারে মেয়েটা কোনোদিন হাঁটেনি, বাবা মারা গেছে এখন হাঁটছে।

 

ভার্সিটি ওঠার পর নিজের দায়িত্ব নিজে নিলাম, মায়ের উপর চাপ কমলো। এরপর খালি মনে হতো দ্রুত জবে ঢুকতে হবে। না আমার মায়ের টাকা আছে ঘুষ দেবার, না আছে মামা খালু। যা করতে হবে নিজে করতে হবে। সরকারি জবে ঢোকার চিন্তা ছিলো এজন্য মাথায়, মাস্টার্স করতে করতেই পরীক্ষা দিলাম, কয়েকমাসের মধ্যে ঢুকেও গেলাম। আমার বোনও দুনিয়ার লক্ষ্মী মেয়ে। মায়ের দরদ আমরা কখনও ভুলিনা। দুইবোন কথা বলতে গেলে মূল টপিক থাকে মা!  যতোদিন যায় আমরা একজন আরেকজনের সাথে আরও জড়িয়ে থাকি। সেসব কষ্টের দিন চলে গেছে। বাবা মারার যাবার পর আজকে আমরা যেটুকু তার পুরোটাই আমাদের অর্জন। আমাদের তিনজন নারীর। পেছনে আর কেউ নেই। আর সবার উপরে আমার মা। মা শিখাইছিলেন কি করে ভালবাসতে হয়, পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়, নিজে একা বাঁচতে হয়, কারো উপর নির্ভর না করে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়, যতো ঝড় আসুক কিভাবে সামলাতে হয়, প্রতিবাদ করতে হয়, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। বাংলাদেশের সমাজে দুইটা মেয়ে নিয়ে একা চলা যারা চলেছে তারাই জানে সেইটা কেমন! আমি নিজে অনেক খারাপ সময় কাটিয়েছি, যখন ভেঙে পড়তে গেছি তখন মায়ের কথা মনে পড়লে আমার সব কষ্ট জল হয়ে গেছে! শুধু ভাবতাম মায়ের চেয়ে বেশি কষ্ট আমার? তা তো নয়! এমন শক্ত নারীর মেয়ে আমি, হার মানা যাবে না।

 

আমি এখন একটাই স্বপ্ন দেখি আবার সবাই একসাথে থাকার। আমার মায়ের মতো যে সব মায়েরা একা যুদ্ধ করে সন্তান আগলে রেখেছেন, আমাদের মতো মাথা তুলে দাঁড়ানোর, একলা চলার মতো শক্ত করে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো করে মেয়েদের গড়ে তুলতে পেরেছেন সেইসব মায়ের জন্য আমার আজকের নারী দিবস। তোমরা ছিলে বলেই আমরা আছি।

হ্যাপি উইমেন্স ডে....... মায়েরা।

পুস্পিতা আনন্দিতা,
নিউইয়র্ক।

0 Shares

৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ