তালাক (প্রথম পর্ব)

দালান জাহান ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, সোমবার, ১০:৪৫:০৬অপরাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

(প্রথম পর্ব)

তারিখটা ঠিক মনে নেই। দিনটা ছিলো চৈত্র মাসের শেষ দিন। আকাশের গহীন উদর অতিক্রম করে গেছে একটা দীর্ঘ কালো রেখা তার চারপাশে খেলা করছে কালো কেশিনী কিশোরী মেঘের দল। মেঘেদের কালো ছাপের উপর দ্রুত ডানা ঝাপটাচ্ছে একদল সাদা বক। চোখে চোখে ঝরে পড়ছে আশ্রয়ের তাড়া। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে ভারী গর্জন। দুয়ারে দাঁড়িয়ে শিশুদের ডাকছে চিন্তাসিক্ত জননী। সবাই দুয়ার এঁটে দিলো। তারপর কি হলো কিছুই জানি না এ ব্যাপারে যিনি বলতে পারতেন তিনি এখন বিশিষ্ট শিল্পী তাকে তো আর খোঁজে পাওয়া সহজ কোন ব্যাপার নয়।

রাস্তা দখল করে আছে ঝরো পাতা। গাছগুলো একে বেঁকে আলিঙ্গন করে আছে একে অপরের সঙ্গে । তাদের মধ্যে কারও মাথা ওড়ে গিয়ে পড়েছে সামনের পুকুরে কারও ডাল ভেঙে আটকে আছে বিদ্যুতের খুঁটিতে। আকাশটা ঝলমল করছে। ঝরের পরের নির্মল আকাশটা একটা শিহরণ দেয়। যে শিহরণটা হৃদয় স্পর্শ করে যায় যেভাবে স্পর্শ করে যায় লাল শাড়ি পড়া নববধূর মেহেদী রঙের হাত।

এর মধ্যেই তির্যকভাবে দুটো কণ্ঠ ভেসে আসছে বাতাসে। এর একটি কণ্ঠ অপেক্ষাকৃত হাল্কা যেটি ভেঙে গিয়ে ডোবে যাচ্ছে পুকুরের জলে। আরেকটি কণ্ঠ ভাগাড়ের গন্ধে পরিপূর্ণ যে কণ্ঠটি কর্ণকুহর হয়ে মস্তিষ্কে সৃষ্টি করছে,  এক ভয়ার্ত রণসঙ্গীত। যুদ্ধ আর ঝড়ের চিহ্ন যেন ক্রমশও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

এতো আর নতুন কিছু নয় ডক্সি আর মিথুনের এই শব্দবমি এতোদিনে কমপক্ষে দশ কিলোমিটার বা তার বেশি অতিক্রম করে গেছে। পথে পথে তাদের কথার দুর্গন্ধ বছরের প্রতিদিনের বসন্তের মতো পথিকের নাক চেপে ধরে।

সমস্যাটা প্রায় সকলের সমস্যা। প্রায় সকলকেই এই সমস্যার একটু না একটু সম্মুখীন হতে হয়। এই সমস্যাটা অনেকটা উদর পীড়ার সমস্যার মতো। উদর ঠিক না থাকলে যেমন শরীর ঠিক থাকে না তেমনি ঘরের বউ বা স্বামী ঠিক না থাকলে, পরিবার ঠিক থাকে না।

মিথুন দারোগার চাকরি করেন। একজন নীতিবান পুলিশ অফিসার হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম আছে। অপরাধীরা সহজে তার কাছে ধরা দিতে চায় না। তার নীতি একটাই একবার হেন কাফ পড়িয়েছেন তো চালান করবেনই। জল তেল দিয়ে আর লাভ হবে না।

কিন্তু এই মিথুন সাহেব প্রতদিন বাড়িতে এসে বউয়ের ঝারি খান। মাথা নিচু করে বউয়ের সব কথা শুনেন অবুঝ শিশুর মতো। অতচ তারা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কোন এক ফেব্রুয়ারী মাসের চৌদ্দ তারিখ। তাদের সংসারে রয়েছে এক ফুটফুটে খোকা সাদিনও। যার বয়স এখন ছয় বছর। পাড়াপড়শি বিরক্ত হলেও মিথুন বিরক্ত হোন না। এ নিয়ে পড়শিরা তাকে যথেষ্ট কটাক্ষও করেন। মিথুন মাটির দিকে তাকিয়ে চলে যান কোন উত্তর না দিয়ে।

কিন্তু মিথুন সহ্য করতে পারেন না। যখন মিথুনের মা তার কাছে বেড়াতে আসেন। মা'কে কাঁচা কাঁচা অপমান করেন ডক্সি। মিথুন এ নিয়ে ডক্সিকে কয়েকবার সাবধান ও করেছেন। কিন্তু আধুনিক একক পরিবারে মা বাবা যেন উটকো মামার বাড়িতে মামীর কাছে রবীন্দ্রনাথের ফটিক চরিত্রের মতো।

মিথুনের মা আসলে ডক্সি আর রান্না করতে মন চায় না। তরকারি মাছ মাংস ফ্রিজের সাথে আটকে যায়। কথায় কথাটা অপমান চলে হরহামেশা। "আপনি আসলে বাচ্চাটা পড়তেই চায় না। সারাক্ষণ খেলা খেলা আর আপনার কোলে বসে থাকে"। কিন্তু দুঃখিনী মা চোখের অশ্রু মোছে বলেন "আমিও আমার ছেলেকে তোমার ছেলের মতোই যত্নে মানুষ করেছি, তাকে না দেখলে যে আমার বুক ধড়ফড় করে মা "

খুব তুচ্ছ অর্থে এসবের উত্তর আসে। মিথুন এসব কথা শুনেন আর খেয়াল করেন যখন ডক্সির আম্মু আসেন। তখন সবকিছু চঞ্চল হয়ে যায়। ফ্রিজ সব বরফ ছেড়ে স্লিম হয়ে যায় মাছ মাংসের আমিষ ও প্রোটিন গন্ধ জানিয়ে যায় ঈদের খুশি। একমাস অতিক্রম হলেও তখন খোকার পড়া বা খেলার কোন সমস্যা হয় না। আবার যাওয়ার আগে মিথুনকে সুন্দর করে বলবে রেশনটা তোলে এনো। তারপর তার মাকে ডাল আটা চিনি তেল দিয়ে বোঝাই একটা ট্রাক বানিয়ে একটা সিএনজি ডেকে পাঠিয়ে দিবে একটা শান্ত নদীর চিত্র।

এ নিয়ে মিথুন কখনও কিচ্ছু বলে না। কিন্তু মিথুনের খারাপ লাগে যখন মিথুনের মা বলেন "বউ মা আমাকে একটু আটা আর একটু ডাল দিও তো" তখন ডক্সি কথায় হৃদয়ের মুকুল ঝরিয়ে দেয়। অপমানের কলাগাছ হয়ে যখন মাথা ঘুরিয়ে নেন তখন চার পাঁচ মাসের পোকা ধরা ডাল আটা নিয়ে ডক্সি ধমকের সুরে বলবেন "নেন নেন না দিলেও তো বিপদ আরেকজন বিশ্ব দরদী আছেন তার গাল ভারী হয়ে যাবে "।

মিথুন এসব সহ্য করে আসছেন। নিজের মা'কে খরচটাও তিনি আলাদা করে ডক্সির অজান্তে দেন। কিন্তু এটা নিয়েও ডক্সি মিথুনের নামে অফিসে অভিযোগ করেছেন যে, " মিথুন তার মাকে সব টাকা দিয়ে দেন" তাই অফিস থেকে একটা ফয়সালাও এসেছে যে মিথুন ডক্সির হাতে মাসে নির্দিষ্ট একটা টাকা দিবেন। মিথুন দিয়েও যাচ্ছে এ নিয়ে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। আধুনিক একক পরিবারের মেয়েরা তো স্বামীকে চায় পৈত্রিক সম্পত্তি হিসেবে। (চলবে)

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ