জন্মদিনে মা’কে মনে পরে

রিমি রুম্মান ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, শুক্রবার, ১০:৪০:০১পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২০ মন্তব্য

এক জুনে ছেলেটি জন্মালো। তাঁর জন্মের একমাস আগ অবধি আমি জব করি। জবটি জরুরি ছিল। শরীরের ভেতর আরেকটি শরীর বহন করে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু খেয়ে রওয়ানা দেই কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। এরপর পথিমধ্যে বমি করতে করতে যাওয়া। ট্রেনে উঠে মনে মনে দোয়া করতে থাকি, আজ যেন এস্কেলেটরটা সচল থাকে। বলা বাহুল্য, ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই সেটি রিপেয়ারের কাজ চলতো। কাজ থেকে ফেরার পথে পথিমধ্যে ট্রেন বদল করতে হয়। গ্রাউণ্ড ফ্লোর থেকে অনেক উপরের ৭ নং ট্রেন। কয়েক সিঁড়ি উঠি। দাঁড়িয়ে থাকি। শ্বাস নেই। আবার খানিক উঠি। এভাবে উপরে উঠার সিঁড়ি যে আর শেষ হয় না ! একদিন গুনে দেখি ৯৭ টি স্টেপ ! এভাবেই দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরা প্রতি রাতে। দশ মাস পর সন্তান জন্মদানের সময়কার কষ্টের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি__ পৃথিবীর কোন কষ্টের সাথেই একজন মা'য়ের সন্তান জন্মদানের কষ্টের তুলনা হতে পারে না। ভয়াবহ এক অন্ধকার। সেখান থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না...
এ কষ্ট কেমন করে ভুলে যায় প্রতিটি মা ! কেমন করে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়জন জন্মায় ! ক'বছর বাদেই উত্তর পেয়ে যাই। মনে হতে থাকে__ এত কষ্ট করে যাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে এলাম, তাঁর কোন ভাই-বোন থাকবে না...সুখ-দুঃখ শেয়ার করার কিংবা বাবা-মা'র অবর্তমানে বিপদে এগিয়ে আসার কেউ থাকবে না, এ কেমন করে হয়। এরপর আবারও সেই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। এবার ভয়াবহ আরেক অভিজ্ঞতা। পুরো দশমাসই যমের সাথে লড়াই চলে। যম নিয়ে যেতে চায়। আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার ছয় বছরের ছেলেটির জন্যে। এভাবে আটমাস লড়াই করে করে ক্লান্ত আমি জ্বরে পুড়ে যেতে থাকি। ডাক্তার চিন্তিত হয়ে উঠে। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে পাঠানো হয় ইন্‌টেনসিভ কেয়ারে। মুখে অক্সিজেন,হাতে পা'য়ে, আঙুলে, সমস্ত শরীরে নানান রকম যন্ত্রপাতির তার জড়িয়ে পেঁচিয়ে রাখা। এক একটি মেশিন শরীরের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা জানান দেয়। স্যালাইন দেয়া, ব্লাড নেয়া সহ প্রতিদিন বেশ অনেকবার সুঁই এর আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হই। ডাক্তার, নার্স, সবাই মাস্ক পরে রুমে ঢুকে। আমি কারো মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাইনা। শুধু কুচ্‌কে থাকা কপালটুকু দেখে আন্দাজ করি,আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। বাবা-মা'কে খুব মনে পরে। ভাই বোন দুটোর মুখ ভেসে উঠে। ছেলেটাকে খুব দেখতে মন চায়। কিন্তু ইন্‌টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কারো ঢুকতে মানা। বিধায় ছেলেটিকে নিয়ে ওর বাবা দূরের এক গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখান থেকে আমার রুমের জানালা দিয়ে আমি তাকে এক নজর দেখতে পাই। দূরের সবকিছুই অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট ছোট্ট রিয়াসাত'কে দেখে ভেতরটা হুহু করে উঠে...
দেশে মা রাতভর দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে থাকে। বাবা মসজিদে দোয়া পড়ায়। এদিকে শারীরিক যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে আমার জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যেতে থাকে। জীবনকে বিষাক্ত মনে হয়। মনে হতে থাকে, যত তাড়াতাড়ি মৃত্যু, ততো তাড়াতাড়ি মুক্তি। অজ্ঞাত সেই ফ্লু এর কারনে যখন সারা বিশ্বেই শতশত মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন আমি সবার দোয়া, ডাক্তারদের নিবিড় চিকিৎসা আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে উঠি। বাইরের মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেই। পৃথিবীটাকে আগের চাইতে আরো সুন্দর মনে হতে থাকে। অতঃপর জুলাইয়ের এক ঝলমলে দিনে দ্বিতীয়জনের জন্ম হয়। তাঁর নাম রিহান...
## প্রতিটি মা'য়ের সন্তান জন্মদানের দুঃসহ কিছু গল্প থাকে। গল্পগুলোর মাঝে ভিন্নতা থাকে হয়তো। তবে অসহনীয় কষ্টগুলোতে ভিন্নতা নেই। আমার, আপনার সকলের মা'য়েরা এমন কষ্ট করেই আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন নিশ্চিত।

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ