*ঘুম ও জীবন*
--জুহায়ের আফতাব মেমন
রংপুর ক্যাডেট কলেজ।
ক্যাডেট কলেজের জীবন শুরু হবার পরে বুঝতে পারি ঘুম কি মধুর।
ক্লাস ফাইভ থেকে আমার খুব ভোরে উঠার অভ্যাস। কি শীত কি গরম আম্মু আর আমি ভোর ছয়টার মধ্যেই পড়ার টেবিলে বসে যেতাম।
ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ার সময় আম্মু স্কুলের রেজাল্ট নিয়ে কখনো টেনশন করেনি। ক্লাস ফাইভে পিএসসি এর কারনে আম্মু খুব ভোরে উঠতো আমার পড়ার জন্য। আমাকে কোলে করে মুখ ধুয়ায়ে চা করে টেবিলে নিয়ে বসাতো। আমি কিন্তু এখনো আম্মু আর বাবার কোলে উঠি।
কিছুক্ষণ চলতো আম্মুর এ কথা ও কথা। তখন রাগ হতো মনে মনে কেঁদে ফেলতাম। এখন বুঝতে পারি, আম্মুও তো আরো আগে উঠতো। রাত জেগে পরের দিন আমাকে কি পড়াবে তা রেডি করে রাখতো।
একসময় আমারও আর ভোরে উঠতে কষ্ট হতো না।
এখন তো কলেজে পাঁচটায় আমাদের ড্রিল শুরু হয়ে যায়। ভোরের বেল পড়লে চোখ খুলে যায় ঠিকই কিন্তু শরীর উঠতে চায়না। তবু সকল আলসেমি ছেড়ে কোনোরকম বিছানা থেকে একবার উঠে গেলে পৃথিবীর সকালটা সত্যিই অন্যরকম সুন্দর মনে হয়।
প্রথম প্রথম কলেজে উঠে একদিকে বেল পড়ার শব্দ শুনতাম অন্যদিকে মনে হতো মা উঠে বসে আছে। আম্মু বলছে,"বাবু ওঠ মা, ছাত্র জীবন আরাম করলে বাকি জীবন কষ্ট পাবি।" আম্মু কিন্তু আমাকে মা বলে ডাকে। বাবা এটা নিয়ে আমাকে ক্ষ্যাপায়। বলে,"তুমি কি মেয়ে বলো, যে তোমার আম্মু তোমাকে মা বলে!" আমি হাসি।
আমার চোখ ভিজে যায়। সকালে খুব বেশি দেখতে ইচ্ছে করে আম্মুকে। বলতে ইচ্ছে করে,"মা তোমার হাতের এক কাপ চা খাব।"
আম্মুর স্বপ্নের এই ক্যাডেট কলেজে এখন আমি।
একবার নাট্যকার তৌকির আহম্মেদ এর একটি সাক্ষাৎকার আম্মু আমাকে দেখাইছিলো। ওখানে তার কথাগুলো আমার খুব ভালো লেগেছিলো। উনিও একজন এক্স ক্যাডেট। কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের। উনার আম্মু চেয়েছিলো উনি ক্যাডেট কলেজে পড়বে এবং ইঞ্জিনিয়ার হবেন। কিন্তু উনি চেয়েছিলেন উনি একজন অভিনেতা ও ফিল্ম মেকার হবেন উনি তা হয়েছেনও। আবার উনি উনার আম্মুর কথাও রেখেছেন।
আম্মুরা খুব চালাক হয়, তাই না অ্যালবিটল? অ্যালবিটল আমার ডায়রির নাম। আমি ওর নাম দিয়েছি অ্যালবিটল। কারণ, আইনস্টাইনের মা-বাবা তাকে অ্যালবিটল ডাকতেন। নামটা তাই আমার খুব পছন্দের।
আমার আম্মুও এ ব্যাপারে খুব চালাক। না চালাক না। আমার আম্মু চালাক শব্দটাকে কেনো যেনো ভালোর ক্ষেত্রে ব্যাবহার করতে ঘৃণা করে। মায়েরা বুদ্ধিমতী হয়। আমার আম্মু বুদ্ধিমতী।
আমার আম্মুর আর একটা বুদ্ধির কথা বলি, আম্মু সব সময় আমার সামনে এমন সব মহান মানুষদের উপস্থাপন করে যে তাদের সবার কাছ থেকে যেনো আমি অনেক কিছু শিখতে পারি।
সত্যজিত কাকুর কথাই যেমন-
সত্যজিত কাকু আম্মুর স্কুলের সিনিয়র দাদা। আমি ঢাকায় কাকুর বাসায় গিয়েছি। আম্মু তাকে খুব সন্মান করে। কাকু দিনের আলোতে পড়াশুনা করার পরে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলতো না। কি পড়েছেন তা শুয়ে শুয়ে রিভাইজ দিতেন।
আমাদের ক্যাডেট কলেজের ব্যাপারটাও ঠিক সেরকম। লাইট ডাউন হয় সবার একসাথে। প্রেপ ক্লাসে কি পড়েছি শুয়ে শুয়ে যেনো আমি তা মনে মনে আওড়াতে পারি এটার জন্য কাকুর এ গল্পটা আমাকে বলা।
কিন্তু কলেজে আমার পরপর ক্লাস পরীক্ষার রেজাল্টটা ঠিকমতো হচ্ছে না। আসলে পরীক্ষার সময় আম্মু ছাড়া আমি কিছুই গোছায়ে উঠতে পারি না। এখানে এখন পরীক্ষার সময় মনে হয়, আম্মু কতো কি ঠিক করে রাখতো আমার পড়ার। প্রতিটা জিনিস আম্মুর মুখস্ত থাকতো। কতোবার পড়া হলো, কতোবার রিভাইজ দেয়া হলো তা সময় দিয়ে ওকে করে রাখতো। কোনো পড়া আটকে গেলে তা গোলচিহ্ন দিয়ে মার্ক করে রাখতো। পরে ওটা বেশি করে রিভাইজ দিতাম। রাত জেগে আম্মু প্রশ্ন তৈরি করতো ও নোট তৈরি করে রাখতো আমার। পরের দিনের পড়া রাতেই ঠিক করে রাখতো। আমার কোনো কোচিং ছিলো না। বাসায় সুজিত স্যার আর আম্মুর কাছে পড়তাম। ক্যাডেটে ভর্তির জন্য ক্লাস সিক্সে এসে ইংলিশ পড়েছি স্বপন স্যাররর কাছে। পরে ক্যাডেটে ভর্তির জন্য শেষের দিকে এসে চার মাস কোচিং করেছি কুড়িগ্রাম স্ক্যাফ কোচিংএ।
কলেজ লাইফে আমার দুই বছর প্রায়। প্রথম দিন পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েই বাবাকে বলেছিলাম,"রয়েল লাইফ বাবা এখানে।"
একদম পরিপাটি কোনো কোলাহল নেই। অকারণ শব্দ নেই।
কলেজে আমরা একসাথে অনেক প্রজেক্ট তৈরি করি। মজা করি। একদিন কলেজ প্রোগ্রামের জন্য আর্ট করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছিলো। আমরা অবশ্য বেশ কয়েকজনই ছিলাম। সিনিয়র ভাইয়ারাই বেশি ছিলো। আমার ক্লাসে আমি একা। আমার খুব ঘুম পাচ্ছিলো। প্রচন্ড রকম ঘুম। চোখ খুলতে পারছিলাম না আমি। রাত সাড়ে বারোটার দিকে কাজ শেষ করে কোনোরকম বিছানা পর্যন্ত পৌছে দেখি কখন সকাল হয়ে গেছে টেরই পাইনি।
উফ! কি করে মানুষ রাত জেগে থাকতে পারে।
সত্যি! আমাদের বেয়ারা ভাইয়াদের কতো কষ্ট হয়। যারা রাত জেগে আমাদের পাহারা দেয়। পাহারা দেয় মানে, আমাদের প্রতিটা হাউজে বেয়ারা ভাইয়ারা বসে থাকে। কারণ, অনেক রাতে কে কখন বাথরুমে ওঠে। কার কোনো সমস্যা হয় কিনা তার জন্য।
আমি যখন উঠি তখনও দেখি ভাইয়ারা জেগে থেকে জিজ্ঞেস করে, "কোথায় যাবা জুহায়ের?"
ঘুমকে কন্ট্রোল করে কি করে ভাইয়ারা?
বাবাদেরও কতো কষ্ট হয় এখন বুঝতে পারি।
বাবাকে ছোটোবেলায় আমি কখনো পাইনি। বাবা খুব কম বাসায় থাকতো। প্রচুর পরিশ্রম হয় বাবার। বাসায় এসে বাবা এলিয়ে পড়তো।
এখন আমি গরমের সময় আমার কলেজ ইউনিফর্মের পোশাকটা পরে বুঝতে পারি, দীর্ঘক্ষন এটা পরে থাকার কি কষ্ট। বাবারা রাত নেই দিন নেই ঘন্টার পর ঘন্টা এটা পরে থাকে। একটু রেস্ট নেবার সময় নেই।
ঘুমকে যারা পরাজিত করতে পারে তারা সত্যিই অনেক পরিশ্রমী। আর তাই তারা সফল।
২০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
অনেক আবেগ আর যুক্তিপুর্ন লেখা, লেখার শেষে উপসংহার দারুন হয়েছে। ঘুমকে যারা পরাজিত করতে পারে তারাই সফল – দারুন কথা।
লেখায় মেমন তার মা বাবাকেও চিনিয়েছে। নতুন করে চিনলাম মেমনের মা বাবাকে।
শুভ কামনা সবার জন্য।
রিতু জাহান
ধন্যবাদ ভাইয়া। দোয়া করবেন ভাইয়া। এক তারিখে তার পরীক্ষা।
জিসান শা ইকরাম
দোয়া করি ও যেন সফল হয়।
মায়াবতী
ছোট্ট বাবা টা কত কিছু বুঝতে শিখে গেছে গো রিতূ! মাশাল্লাহ । বাবার লেখায় আবেগ যেন চোখের কোনায় কোনায় ঝাপসা করে দেয় । লক্ষি সোনা আব্বু টার জন্য অনেক অনেক দোয়া খালামনির । (3
রিতু জাহান
ওর ডায়রি লেখার অভ্যাস ক্লাস ফোর থেকে! ভাবতে পারো। আমি দিয়েছিলাম প্রথম কিনে। সেই থেকে ডায়রি লেখে।
হুম, খুব চুপচাপ থেকে সব দেখে আর পর্যবেক্ষণ করে।
দোয়া করিও আপু।
ছাইরাছ হেলাল
ছেলেতো দেখছি মা-অন্ত-প্রাণ।
অনুভুতির সুন্দর উপস্থাপনা, অনেক বড় হয়ে এ লেখাগুলো দেখবে ভাবতেই অন্য রকম লাগছে।
আপনার ভয়-জাগানো লেখার অপেক্ষায় আছি!
রিতু জাহান
লেখা আসছে না মোটে। মাথার উপর দুইটা পরীক্ষার ঘন্টা টুংটাং করে বেজে যাচ্ছে। খুব টেনশন হচ্ছে।
দোয়া করিয়েন গুরু।
লেখা আসবে আসবে।
ছাইরাছ হেলাল
অবশ্যই আপনার জন্য দোয়া থাকবে।
মোঃ মজিবর রহমান
মেমন যা শিখেছে তা অকপটে তাঁর লেখায় মা-বাবার কথা পরিপাটি করে লিখেছে। এই না বাবা-মা। এইভাবে পড়ালে সন্তান আদর্শবান হবেই, আল্লাহ রহমতে।
লেখাটা কপি করলাম ব্যাক্তি প্রয়োজনে।
ধন্যবাদ আপু।
রিতু জাহান
ডায়রি লেখার অভ্যাস থেকেই মূলত ওর লেখার আইডিয়া চলে এসছে।
দোয়া করবেন ভাই। ও যেনে এরকমই থাকে।
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ ভাল রাখুক। আমিন।
মাহমুদ আল মেহেদী
প্রতিটা কথা ই আমার কাছে মনে হয়েছে শিখার অনেক কিছু বাকি আছে আমার যা হারিয়েছি জীবনে যা আর হারাতে চাই না.অনেক শুভকামনা ।
রিতু জাহান
প্রতিটা সন্তান গভীর মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠুক এটাই কামনা।
দোয়া করবেন ভাই।
শুন্য শুন্যালয়
মাত্র এতটুকু বয়সে এমন অভিজ্ঞ লেখা! ও অনেক বড় হবে একদিন ভাবী, দোয়া রইলো অনেক অনেক।
তুমি কিন্তু মেমনকে একটা আইডি করে দিতে পারো চাইলে। লেখালেখিতে ইন্সপায়ার্ড করো।
ভালো থাকুক।
রিতু জাহান
ওকে আমি খুব উৎসাহ দেই লেখালেখিতে।
ক্লাস ফোর থেকে সে ডায়রি লেখে।
দোয়া করিও।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এক কথায় চমৎকার একটি লেখা পড়লাম।বিভিন্ন ঝামেলায় এখন আগের মত ব্লগে আসতে পারিনা এ লেখাটা আমাকে টেনে আনল।মেনন বাবাটার সাফল্য কামনা করছি।ওযে এখনি বুঝতে পেরেছে মা বাবারা সন্তানদের মানুষ করতে কত কষ্ট করে তাতেই জনম স্বার্থক।ভাল থেকো মামা সব সময় প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণ -{@
রিতু জাহান
ধন্যবাদ মনির ভাই। দোয়া করবেন কালকে ছেলেটার পরীক্ষা শুরু।
আমার তো খুব টেনশন হচ্ছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ! মেমন সোনা বড়ো মনের মানুষ হয়ে ওঠো বাবা।
মা-বাবাকে এভাবেই অনুভব করো আজীবন। অনেক কষ্ট করে একেকজন মা এবং বাবা।
অনেক আদর।
রিতু জাহান
তোমার দোয়ায় রেখো আপু। কালকে আমার কলিজাটার পরীক্ষা।
নীলাঞ্জনা নীলা
ও অনেক বড়ো হবে আপু, দেখে নিও।