গৃহবাসী ছুটি

রেহানা বীথি ১৭ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ১১:০৩:৫৫পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৯ মন্তব্য

এই থমকে যাওয়া সময়ে সব ভাবনা এলোমেলো উড়ছে যেন। একসময় মনে হতো, যদি একটানা দশদিন ছুটি পাওয়া যেত, মনের পেখম মেলে দিতাম। মেয়েদের বহুদিনের শখ, সবাই কত বেড়াতে যায় সাগরে নয় পাহাড়ে, আমরা কোথাও যাই না। ওদের সে শখ পূরণ করে দেবো। এখন ছুটি। দীর্ঘ দীর্ঘ ছুটি। কিন্তু এ ছুটি গৃহবাসী ছুটি। অনিশ্চিত এ দীর্ঘ ছুটিতে প্রাণ নেই কোনও, আছে মনের ঝিমোনো ভাব। ক্ষণে ক্ষণে বুকের ভেতর ডুমডুম করে উঠছে, ছুটি কবে শেষ হবে, আর ছুটির শেষ অব্দি দেখার জন্য বেঁচে থাকবো তো?

হিসেবের বাইরে চলে গেছে তারিখ, বার। সেদিন শুক্রবার ভেবে ভেবে চলছি সকাল থেকে, দুপুর সাড়ে বারোটা পেরিয়ে গেল জুম্মার আযান হয় না, কারণ কী? জানলাম শুক্র নয়, বুধবার সেদিন। কী অবস্থা!
এই অবস্থাতেই বন্দি জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্যে, বিশেষ করে কন্যাদের ভালোলাগার কথা মাথায় রেখেই পহেলা বৈশাখ পালন করে ফেললাম। অনেকদিন পর যেন প্রাণ এসেছিল আমার ভাঙাচোরা বাড়িটিতে।

প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এপ্রিলের শুরু থেকেই ব্যস্ততার সীমা থাকে না। কন্যারা যেহেতু গান করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করার জন্য চলে প্রতিদিন রিহার্সাল। আমাদের স্থানীয় উকিল বারেও বেশ ঘটা করে পালন করা হয় নববর্ষ। সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি আমিও। শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান করার পরে আমাদের বারেও কন্যাদের গান পরিবেশন শেষে কিছুক্ষণের জন্য দুপুরে বাড়ি ফিরে আসি। বিকেলে আবার মেয়েদেরকে নিয়ে ছুটতে হয় মেলায়। ওখানে গান এবং ঘোরাঘুরি শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ভোর থেকে শুরু করে সারাদিনের এই আনুষ্ঠানিকতায় একেবারে কাহিল অবস্থা সবারই। প্রতিবারই মেয়েরা বলে, বৈশাখের অনুষ্ঠানে আর গান করবো না কোনদিন। কিন্তু আবার যখন উঁকি দেয় পহেলা বৈশাখ, ওদের উৎসাহের ঘাটতি থাকে না কোনও।

এবার এই গৃহবাসী ছুটিতে মনে পড়ছে সেই ব্যস্ততার দিনগুলো। এমন ছুটি তো আমরা চাইনি! ব্যস্ততাহীন নিরুত্তাপ ছুটি কেন তবে ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের? তবে কি আমরা বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলাম, এ ছুটি তারই ফল?

গাছে গাছে ছোট ছোট আম। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তারা, একসময় পাকবে। আমগুলো পাকার জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন, সে সময়ের আগে তাদের পাকার কথা নয়। তারপরেও দেখা যাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই ঝাঁকা ভর্তি পাকা আম বাজারে। কিন্তু কেমন করে?
আমাদের অসহিষ্ণুতা কেমিক্যাল প্রয়োগে তাদেরকে পাকতে বাধ্য করে আগেই। আমরা যারা ক্রেতা, তারা আনন্দিত হই পছন্দের ফলটি পেকে গেছে দেখে। কিনেও ফেলি চড়া দামে। যখন পাকার কথা তার আগেই আমগুলো পেকে গেল কিভাবে, এ প্রশ্ন একবারও ভাবিত করে না আমাদেরকে। টাকা আছে, কিনবো না কেন? কিন্তু যদি না কিনি, বর্জন করি ওই কেমিক্যাল দেয়া আম সম্মিলিতভাবে, তাহলে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য। তবুও চলে বেচাবিক্রি। ক'টা দিন সবুর করে গাছপাকা আম খাওয়ার মতো ধৈর্য আমাদের নেই। এতটাই অসহিষ্ণু আমরা।

এই অসহিষ্ণুতার তাণ্ডব চলছিল পুরো বিশ্বজুড়ে। চারিদিকে ভয়াবহ অস্থিরতা। যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে গোটা মানবজাতি। আর সেই ভয়াবহ অস্থিরতাই বোধকরি আমাদেরকে টেনে এনেছে আজকের এই ভয়াবহতম বিপর্জয়ের মুখে। এখন আমাদের পালাবার কোনও পথ নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পিঠ ঠেকে যাওয়া ওই দেয়াল ভেদ করার শক্তি অসহিষ্ণুতার কবলে বন্দি। এই অপ্রকৃতিস্থ মানবজাতির জন্য এ এক চরম শিক্ষা। যদি বেঁচে থাকে কেউ, শিক্ষাটা হয়তো কাজে লাগাবে আগামীদিনে। প্রয়োজন ছিল এ শিক্ষার। পৃথিবীটা বড় বেশি জর্জরিত হয়ে গেছিল যে!

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ