গভীর রাতে গহীন বনে সাপ খোঁজা।

শামীম চৌধুরী ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ০১:৫৯:৫০পূর্বাহ্ন ভ্রমণ ২৯ মন্তব্য

ফটোগ্রাফীর শুরুটা ছিলো শখের বসে। ধীরে ধীরে নেশায় পরিণত হয়। একজন ফটোগ্রাফারের ছবিটাই শুধু ফ্রেমে ভেসে উঠে। অথচ ছবির পিছনের গল্পটা কেউ জানে না বা ফটোগ্রাফার বলতে চায় না। একটি ভালো মানের ছবির শট নিতে, যে পরিশ্রম ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন তা সবার অজানা থেকে যায়। আমি ফটোগ্রাফী শুরু করি ওয়াইল্ডলাইফ দিয়ে। প্রথমে পাখির ছবির জন্য কাজ শুরু করি। পাখির ছবি তোলার সময় বন্যপ্রাণীর দেখা পেলে ছবি তুলতাম। কিন্তু বন্যপ্রাণীর জন্য কখনই সময় দেই নাই। পাখির ছবি তুলতে যেয়ে পাখি সম্পর্কে সম্যক ধারনা ও পরিচিতি মুখস্থ হয়ে যায়। পাখির জন্য বন-জঙ্গল, হাওর-বিল, নদী-নালা এবং উপকূলে ভ্রমন আমার মনে প্রশান্তি এনে দেয় । বাংলাদেশের এমন কোন হাওর বা নদী বা উপকূল নেই যেখানে ভ্রমন করি নাই। যদিও আমাদের দেশে ফটোগ্রাফী থেকে আয়ের কোন সুযোগ নেই। তারপরও ফটোগ্রাফীতে আমার সুখ হচ্ছে মনের শান্তি। এই সুখ ও শান্তি খুঁজে পেয়েছি ভ্রমনে ও ফটোগ্রাফীতে। যা আমাকে সবসময় তরুন ও সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে। এই হলো আমার ফটোগ্রাফী জগতে আসার পিছনের গল্প।

short nosed vine snake বা লাউডগা সাপ।

গত ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় সাতছড়ি বনে যাই । এবার পরিকল্পনা নিয়েই সাতছড়ি ভ্রমন করি। এখন বাংলাদেশে প্রতিটি জায়গায় সাপের ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়ে প্রকৃতির সাথে মিশে আছে। সাপ সম্পর্কে একটু না বললে আপনাদের ধারনা হবে না। সকল প্রাণী জন্ম নেবার পর মা-বাবা  ছানাদের লালন পালন করে। শুধু সাপ হচ্ছে তার ব্যাতিক্রম। সাপ ডিম থেকে বের হবার পর তার খাবার তাকেই খুঁজে খেতে হয়। যার জন্য বিষধর সাপের বাচ্চা ডিম থেকে মুখ বের করার পরই তার বিষ চলে আসে। কারন তাকে খাবার খুঁজতে হলে যে কোন শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। তাই একদিনের বিষধর বাচ্চাটি কামড় দিলে মৃত্যুর আশাংকা থাকে।

আমরা অনেকের ধারনা সাপ মানেই বিষধর। আসলে কি তাই? আমাদের ধারনা নেই বলে এমনটি মনে হয়। আমাদের দেশে ৩৯ প্রজাতির সাপ পাওয়া যায় তার মধ্যে ৭০% ভাগ সাপ নির্বিষ। কামড় দিলে মানুষ বা কোন প্রাণী মারা যাবে না। তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য কামড় দেয়। আর সাপে কামড় দিয়েছে এটা ভেবেই দূর্বল হৃদয়ের মানুষ হৃদরোগ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। আর বাকি ৩০% ভাগ সাপ বিষধর। এর মধ্যে কয়েকটি আছে কামড় দিলে দশ হাত পর্যন্ত যাওয়ার আগেই মৃত্যু অনিবার্য। আর বাকিগুলি ফলস বা অভিনয় কামড় দেয় অন্তত পক্ষে ৮-১০ বার। যখন সে বুঝতে পারে তার আত্মরক্ষার কোন সুযোগ নাই তখন সে বিষ ঢেলে দেয়। সাপ কামড়ালেই মানুষ বা প্রানী মারা যাবে এমনটি নয়। বিষধরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে- King Cobra , Rasel Viper, Red necked snake, short nosed vine snake, pit viper সহ আরো কয়েক প্রজাতির সাপ।

উপরে প্রথম ছবির সাপটি হচ্ছে- Ornet flying snake বা ‘কাল নাগিনী’। নাম তার ‘কাল ‍নাগিনী’ অথচ নির্বিষ একটি সাপ। শত কামড় দিলেও মানুষ বা কোন প্রাণী মরা যাবে না।

দ্বিতীয় ছবির সাপটি মারত্মক ভেনাম বা বিষধর সাপ। যার নাম short nosed vine snake বা আঞ্চলিক ভাষায় লাউডগা। সাপ সম্পর্কে যতটুুকু জেনেছি ও পড়েছি এই হলো মোটামোটি সাপের বর্ণনা।

এবার আসি মুল গল্পে।

আগেই বলেছি  একটি পরিকল্পনা নিয়ে সাতছড়ি আসি। বেশ কয়েক বছর ধরে সাপ নিয়ে কাজ করা ও ছবি তোলার শখ জাগে। সময় ও সর্প বিশারদ না পাওয়ায় আগ্রহটা তেমন নাড়া দেয় নাই। অবশেষে এবার পরিকল্পনা করি এই মৌসুমে সাপের ছবি না তুলি তবে আরেকটি বছর গত হয়ে যাবে। তাই দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটিতে চলে যাই সাতছড়ির গহীন বনে।

সর্প বিশারদ প্রসেনজিৎ ত্রিপুরাকে সঙ্গে নিয়ে রাতে বেরিয়ে পড়ি সাপ খুঁজতে। প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি আর দুই ধারে ঝোপ-ঝাড়ে সাপ খুঁজতে খুঁজতে গহীন বনের ভিতর প্রবেশ করি। রাত তখন ৮টা বাজে। শুনশান বন। কোন সাড়া শব্দ নেই। হাতে টর্চ লাইট ধরে বনের ভিতর সামনের দিকে আগাচ্ছি। মাঝে মাঝে মাটিতে লাইট ধরতে হচ্ছে। কারন গরমের দিনে সাপ মাটিতে চলে আসে ঠান্ডার জন্য। বনের ভিতর প্রচন্ড গরম। এরই মাঝে দেখা পেলাম Fish cat বা মেছো বাঘ। দৌড়ে বনের ঝোপের ভিতর ঢুকে পড়লো। আমাদের পায়ে হাই বুট। তার উপর জিন্সের প্যান্ট। হাতে স্নেক স্টিক। এই পোষাকের অর্থ হচ্ছে নিজেদেরকে সাপের কামড় থেকে রক্ষা করা। কারন মাটিতে সাপ থাকলে অন্ধকারে দেখা যাবে না। সাপ প্রথম কামড় দেবে যদি তার শরীরে বা লেজে পায়ের চাপ পড়ে। মাটিতে থাকা সাপ পায়ে কামড় দেয়। তাই নিজেদের নিরাপত্তা মাথায় রেখেই বনে ঢুকতে হয়।

বনের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে  short nosed vine snake বা লাউডগা সাপের দেখা পেলাম। বনের ভিতর পানি ভরা একটি গর্তের পাড়ে লতার ডালে জড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবি নিলাম। তারপর সাপটিকে স্নেক স্টিক দিয়ে ধরে আনলাম। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে কোন সাপের মাথায় স্পর্শ করলে সাপটি চুপ হয়ে যায়। তার নড়াচড়াও স্থির হয়ে উঠে। সাপটিকে যখন স্নেক স্টিক দিয়ে ধরে আনা হয় তখন বার বার ছোবল দেবার জন্য শোঁ শোঁ শব্দ করছিলো। প্রসেনজিৎ মাথায় স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে যায়। পড়ে ওর কাছ থেকে এই বিষয়ে আরো সম্যক জ্ঞান নেই।

জীবনের প্রথম কোন সাপকে হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম। তাও আবার বিষধর সাপ। সেদিনের রাতের কর্মটি ছিলো আমার কাছে সম্পূর্ন এ্যাডভেঞ্চার মূলক। যেমন আনন্দ পেয়েছি সঙ্গে তেমন ভয়। ছোট বেলা থেকেই যে কোন চ্যালেঞ্জিং কাজে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। কিশোর বয়সে দুঃসাহসিকতার সাথে অনেক কাজ করেছি। ফটোগ্রাফীতে নিজেকে জড়িয়ে সেই দুঃসাহসকে কাজে লাগিয়ে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছি। যেকোন চ্যালেঞ্জিং কাজকে আপন করে নিতে খুব ভালো লাগে। সবসময় নিজের ভিতর দোলা দেয় কখন কাজটি সফলতার সঙ্গে শেষ করতে পারবো।

আজ এই পর্যন্ত থাকুক। পরবর্তীতে কোন নুতন ভ্রমনের ঘটনা নিয়ে আবার হাজির হবো।

সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। যেন সুস্থ্য থেকে কাজগুলি শেষ করতে পারি। নতুন নুতন পাখি নিয়ে আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারি।

আপনাদের কাছে বিশেষ অনুরোধ রইলো কেউ সাপ মারবেন না। সাপ প্রকৃতিতে খুব উপকারী একটি প্রাণী। সাপকে আঘাত না করলে সাপ তেড়ে আসবে না। তাই নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনায় ঝোপ-ঝাড় পরিস্কার রেখে সাপ থেকে ‍নিরাপদে থাকুন।

সাবই ভালো থাকুন ও সুন্দর থাকুন।

 

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ