চেনা মানুষজন, চেনা গণ্ডী, চেনা শহর ছেড়ে মানচিত্রের উল্টো দিকের এই শহরে শুরু হয় দ্বিতীয় জীবন। বড় বেশী যান্ত্রিক, সংগ্রাময় আর শূন্য শূন্য চারিপাশের এক জীবন। পাঁচ বছর বাদে ফিরে যাই চিরচেনা মানুষদের কাছে। বাড়ীর গেটে অধীর অপেক্ষায় বাবা। পাঁচ বছর তো নয়, যেন পাঁচ যুগ পর পিতা-কন্যার মিলন ! চিরকাল ক্লিনসেভ থাকা, প্যান্টশার্ট পরা, এখানে ওখানে ছুটে চলা কর্মঠ, কঠোর বাবা'র কল্পনাতীত পরিবর্তন ! স্ট্রোক করে একপাশ প্যারালাইজড হবার পর এই প্রথম বাবাকে দেখি। পাঞ্জাবি, দাড়ি-টুপি পরা, লাঠি ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা ছোটখাটো অসহায় একজন মানুষ ! কোনভাবেই মেনে নিতে পারিনা। হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে আসে। হাত দু'টি ধরে বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ। পিতা-কন্যা'র অশ্রুজলে ভেসে যাওয়া এক ক্ষণ !
দেখি, অসীম মনোবলে বাবা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নীচে যান। চারতলার ছাদে গিয়ে পানির সুইস অফ/অন করেন সময়মত। রশি আর রিঙ দিয়ে বানানো কিছু একটা দিয়ে ব্যায়াম করেন একাকী। এসব দেখে আমি একটু একটু করে সাহস পাই, ভাল বোধ করি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই মসজিদে গিয়ে পড়েন। সেখানে সমবয়সী বন্ধুরা, প্রতিবেশীরা বলাবলি করে__ আমেরিকায় এসবের উন্নত চিকিৎসা আছে... শতভাগ ভালো হয়ে গিয়েছে তাদের চেনা-জানা অনেকেই। বাবা'র ভেতরে আশার সঞ্চার হয়। স্বপ্ন দেখে, আবার স্বাভাবিক একটি ছুটে চলা জীবন হবে তার। একদিন বৈকালিক চা'য়ের সময়টাতে গল্পচ্ছলে আমায় বলে__ "জানিস, আমেরিকায় নাকি প্যারালাইজড রোগী'রা পুরোপুরি ভালো হয়ে যায় !" সেই সময় বাবার চোখে মুখে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটা খেলে যায়। সেই আলোয় আমার মুখ আলোকিত হয় না। ভেতরে নেমে আসে মধ্যরাতের নিস্তব্দতা। আমি নিশ্চুপ থাকি। ভাবি, একটু গুছিয়ে নেই। আমার দৈন্যতা, গরীবী হাল, কোনমতে একটি রুম নিয়ে থাকা___ এসব তো আর বাবাকে দেখানো যায় না !
এদিকে দিন, মাস, বছর পেরোয়। বাবার পৃথিবী একটু একটু করে ছোট হতে থাকে। শহর ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে চায় না। বলে, "শরীরে কুলায় না" । চেনা শহর ধীরে ধীরে অচেনা হয়। বেড রুমেই থেমে থাকে আমার বাবা'র পৃথিবী। অতঃপর একসময় থেমে যায় সব... সব। খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া প্রাণহীন দেহখানা সমাহিত হয় পূর্বপুরুষের সমাধি'র পাশে।
ততদিনে আমি গুছিয়ে উঠেছি। আমার সবকিছুতেই বড় বেশি দেরী হয়ে যায়। আমার যে বড় বেশি অসময় ছিল সেদিন। ক্ষমা করো পিতা... ক্ষমা করো আমায়...
শুভকামনা সকল বাবা'দের
শুভকামনা সোনেলা'র বন্ধুদের।
২২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আপনার জন্য রইল শুভ কামনা খুব যত্ন নিয়ে লিখলেন একজন পিতার জীবন চক্রের নানান দিকগুলো যা অন্যসব পিতা এবং আমাদের বেলায়ও ঘটবে।আপনার পিতা বেচে থাকুক অনন্তকাল। -{@
রিমি রুম্মান
আমার পিতা বেঁচে আছে আমার অন্তরে। বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের অনেক অপূর্ণতা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা।পরিশেষে একরাশ গ্লানি।
রিমি রুম্মান
এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা।
নুসরাত মৌরিন
মন খারাপ হয়ে গেল আপু। 🙁
আসলেই কেন যেন আমাদের সবকিছুতেই বড্ড দেরী হয়ে যায়।
বাবা-মায়ের জন্য কিছু করার তীব্র বাসনা জানিনা আমি কখনও পারব কিনা পূরন করতে…।
শুভকামনা রইলো।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও। শুভকামনা নতুন বছরের।
অরণ্য
“ক্ষমা করো পিতা… ক্ষমা করো আমায়…” লাইনটিতে মন বেশি খারাপ হয়ে গেল। আপনার বাবা হয়তো আপনাকে দেখছে এখন যত দূর থেকে তেমনি দূর থেকে আরেকবার দেখতে পারেন আপনার সেই অসময়ের সময়টিকে। আপনার বাবা আপনাকে ক্ষমা করেছেন, দেখতে পেয়েছেন?
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন পিতা-মাতার ভালোবাসায়। নতুন বছরের শুভেচ্ছা।
মেহেরী তাজ
আপু চোখে পানি চলে এলো আমার।ভালো থাকুক আপনার বাবা যেখানেই থাকুক।
রিমি রুম্মান
ওপারে ভাল থাকুক পিতা। আপনাকে শুভেচ্ছা নতুন ভছরের।
ব্লগার সজীব
আপু,আপনার বাবা আপনার অক্ষমতার কথা নিশয়ই এখন জেনেছেন।তার আত্মা শান্তিতে থাক।
রিমি রুম্মান
সবকিছুর পরও বাবারা ক্ষমা করে দেয় জানি। তবুও আমরা কি স্বস্তি পাই ? আমরা কি শান্তি পাই ?
শুন্য শুন্যালয়
অনেক কিছু করবার ইচ্ছে থাকলেও আমরা তা করে উঠতে পারিনা। সন্তানদের এ অক্ষমতা বাবা মা নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। আপনার বাবা অবশ্যই ক্ষমা করেছে আপনাকে। তিনি যেখানেই থাকুক তার আত্মা শান্তি লাভ করুন।
রিমি রুম্মান
নতুন বছরের শুভেচ্ছা রইলো।
মিথুন
এমন লেখা ভেতরটা পুড়িয়ে দেয়—————
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনি। ভাল রাখুন বাবা-মাকে।
স্বপ্ন নীলা
লেখা পড়ে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে এল
রিমি রুম্মান
বাবা- মাকে নিয়ে লিখতে গেলে আমার নিজেরও মন ভারী হয়ে থাকে।
বনলতা সেন
জীবনের কঠিন টানাপোড়ন।যা শুধুই পোড়ায়।
রিমি রুম্মান
সময়ে কিছুই হয় না আমাদের। সবকিছুই হয় বড় বেশি অসময়ে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনার লেখা পড়ে আমার বাবার কথা মনে পরে গেলো……… রিমি রুম্মান।বাবা দেশে,আর আমি কত বছর দেশের বাইরে।ইচ্ছে করে নিয়ে আসি আমার কাছে প্রিয় বাবাকে।পারিনা যে। ভালো থাকুন আপনি।
রিমি রুম্মান
আদতে সবকিছু সুন্দর মনে হয়। গল্পের মত সুন্দর। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। অনেক নির্মম। চাইলেও আমরা অনেক কিছু হয়ে উঠে না। ভাল থাকুন। শ্রদ্ধা আপনার বাবাকে।