মানুষের ইতিহাস এক অর্থে নিষ্ঠুরতারই ইতিহাস। আমরা ইতিহাস পড়ে দেখেছি এক একটি সভ্যতার পিছনে নির্মম সব কাহিনী। যুদ্ধ হত্যা আর এই দাসপ্রথা। হ্যাঁ, যে কোনো সৃষ্টিরই একটা প্রসব বেদনা আছে, আমি তা অস্বীকার করছি না। সভ্যতার পেছনে এই দাসপ্রথা হয়ত এমনই এক প্রসব বেদনা। লক্ষ লক্ষ মানুষের লাশের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সভ্যতা।
দাসপ্রথা এমন এক নির্মম পদ্ধতি, যেখানে মানুষকে সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। ফলে আর দশটি পণ্যের মতো ক্রীতদাস ও বেঁচাকেনা হতো। এই বেঁচাকেনার মূল কারন ছিল সস্তায় কিংবা নাম মাত্র মূল্যে শ্রম পাওয়া। যখন কোনো ব্যক্তি ক্রীতদাস হয়ে যেতেন তখন সেই ব্যক্তি মালিকের ইচ্ছেমতো চলতো। কারন তার আর ব্যক্তি ইচ্ছা বলে কিছুই থাকতো না। এমনকি ঘুম, খাওয়া সবই মালিকের ইচ্ছার উপর প্রাধান্য পেতো। কোনো নারী ক্রীতদাস কোনো সন্তান জন্ম দিলে সেই সন্তানও ঐ মালিকের দাস হিসেবে গণ্য হতো। সে আমলে দাস প্রথার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু কালের পরিবর্তনে অনেক আন্দোলনের পরে আইন করে বন্ধ করা হয় এই দাস প্রথা। কিন্তু এতে করে চোরাই পথে ক্রীতদাসদের আনা নেওয়া শুরু হলো নির্মমভাবে।
সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে মানবসমাজে প্রবেশ করে ক্রীতদাস প্রথা। আদি মানুষ যখন শিকার করে জীবন ধারন করত কিংবা আদিযুগের কৃষক সমাজে ক্রীতদাসের কোনো প্রয়োজন হয়নি। কারন তারা খুব সহজেই শিকার করতে পারত। আর তারা কখনো স্থায়ীভাবে এক যায়গা বসতি গড়ার চিন্তা করেনি। তারা তাদের জন্য শুধুমাত্র তাদের প্রয়োজনের মতোই খাদ্য সংগ্রহ করত। ছিল না কোনো পরিবারের দায়ভার। তাই তখন মানুষের জন্য তার দুটি হাতই যথেষ্ট ছিল।
এক সময় মানুষ জঙ্গল ছেড়ে বসতি গড়ল শহরে। এবং নানা সুবিধার কথা চিন্তা করে স্থাপনা করতে লাগল নগরের পর নগর, অট্রালিকা, এবং খাদ্য মজুত করতে শিখলো। তারা খুঁজতে শুরু করলো সস্তায় শ্রমিক। অনেকে বাহুবলে, অনেকে অন্যের দুঃখ দুর্দশা অর্থাৎ দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে ক্রীতদাস প্রথা চালু করলো।
প্রত্যোক সভ্যতার পিছনেই রয়েছে ক্রীতদাস প্রথার নির্মম ইতিহাস। আমরা ইতিহাস পড়লে দেখতে পাই, মানেষ যখন গুহা ছেড়ে একটা সমাজে বসবাস করা শুরু করল তখন গোত্রে গোত্রে শুরু হলো যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের মাধ্যমে যারা পরাজয় বরন করত তাদের মধ্যে কর্মক্ষম মানুষগুলো হয়ে যেতো ক্রীতদাস। অন্যদের তারা মেরে ফেলতো। তখন শহরগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো না আর তাই গ্রামঞ্চল থেকে পর্যাপ্ত ফসল ফলাতে এবং তা সরবরাহ করতে প্রয়োজন হতো প্রচুর শ্রমিকের।
অনেক সংস্কৃতিতেই দাস প্রথার লিখিত রেকর্ড পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৮,০০০০ বৎসর পূর্বে, মিশরের নিন্মাঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের এক কবরের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় তৎকালীন লিবিয়ার অধিবাসীরা আফ্রিকার গভীর জঙ্গলের উপজাতিদের দাস হিসেবে রাখত।
ক্রীতদাস প্রথা মোটামুটিভাবে সব সভ্যতার সমাজেই ছিল, যেমনঃ সুমের, প্রাচীন মিশর, প্রাচীন আক্কাদিন সাম্রাজ্য, আসিরিয়া সাম্রাজ্য, প্রাচীন ভারত, প্রাচীন গ্রিস, রোমান সাম্রাজ্য, আরবে খলিফাদের শাষনামলে, ইহুদী সম্রাজ্যের প্যালেস্টাইন, আমেরিকার কলম্বাস-পূর্ব সভ্যতা ইত্যাদি।
আমি প্রতিটা সভ্যতার ক্রীতদাস প্রথার বর্ণনা করার চেষ্টা করব। তবে আমার পড়ামতে, এই ক্রীতদাস প্রথার নামে নারীদের প্রতি যে নির্মমতা দেখানো হয়েছে তা সত্যিই খুব নির্মম।
ব্যাবিলনের ক্রীতদাসঃ খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতক
খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫৪ অব্দের প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সম্রাজ্যের যে আইন ছিল তা ব্যবিলনের আইন কোড বা কোড অব হামমুরাবি(Code of Hammurabi) নামে পরিচিত। ব্যাবিলনের ষষ্ট সম্রাট হামমুরাবি এই আইনের প্রতিষ্ঠাতা। তাই এই আইনগুলোকে কোড অব হামমুরাবি বলা হয়। এই আইনে মোট ২৮২ টি আইন ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল এমন যে,যদি কেউ সম্রাটের বা অন্য কারো সম্পদ চুরি করে তবে তার হবে মৃত্যুদন্ড এবং তার স্ত্রী সন্তান ছেলে বা মেয়ে সম্রাটের অধীনে তিন বছর দাস জীবন যাপন করবে। তবে হামমুরাবির সময়ে দাস আইন একটু সহনশীল পর্যায়ে ছিল। যদিও কোনো ক্রিতদাসই কখনোই কোনো সম্পত্তির মালিক হতো না কিন্তু হামমুরাবির সময়ে অনেক ক্রীতদাসই কিছু সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। আদি সভ্যতার সমাজে ক্রীতদাসদের বিস্তারিত জানা যায় এবং প্রাচীন গ্রীক সমাজ গঠনে ক্রীতদাসদেরই ভূমিকা ছিল সব থেকে বেশী। যেমনঃ বড় বড় অট্রালিকা নির্মানে এবং ব্যাবিলনিয় পরিকল্পনার অধীনে একটি শহরের পানি সরবরাহের জন্য ইউফ্রেতিসের একটি শাখা নদী থেকে খাল কেটে পানি আনার ব্যাবস্থা করেছিল এইসব ক্রীতদাসরাই।
গ্রীক ক্রীতদাসঃ প্রাচীন গ্রিসের দুই শীর্ষ রাষ্ট্র স্পার্টা ও এথেন্স সম্পূর্ণ শ্রমিকের উপর নির্ভরশীল ছিল যদিও তা ছিল জোরপূর্বক বাধ্যতামূলক শ্রম। স্পার্টাতে ক্রীতদাসরা ছিল মূলত ভূমিদাসের মতো। এথেন্সের ক্রীতদাসদের সাথে পার্থক্য ছিল এই যে, স্পার্টার হেলট যোদ্ধা জাতি নিজস্ব পরিচয় নিয়ে থাকলে ও তারা তাদের মালিকদের শ্রম দিতে বাধ্য ছিল।
এথেন্সের ক্রীতদাস প্রথায় ক্রীতদাসদের কোনো স্বীকৃত অধিকারই ছিল না যা ছিল রোমের বিপরীত। তাদের জীবন যাপন অনেকটাই নির্ভর করত তারা কোন কাজ করছে তার উপর। ক্রীতদাসদের মধ্যে সব থেকে হতভাগ্য ছিল যারা খনিতে কাজ করত তারা। মালিকের নির্দেশে অনেকটা অনাহারে রাতদিন কাজ করতে হতো জীবন বাজি রেখে। এথেন্সে অনেক ক্রীতদাস গৃহশ্রমিক হিসেবেও কাজ করতো। তাদের জীবন যাপন ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভর করত মালিকের সাথে তার সম্পর্ক কতোটা গভীর তার উপর। নারী ক্রীতদাসদের সাধারনত মালিকের শিশুদের লালন পালন এ দেখভাল করতে হতো একই সাথে মালিকের কনকুবাইন হিসেবেও থাকতে হতো। অনেক ক্ষেত্রে মালিকের ঔরষে ক্রীতদাসের গর্ভের সন্তানও ঐ মালিকের ক্রীতদাস হতো। শিশুটি মেয়ে শিশু হলে তারই ঠিক এমনি পরিনতি হতো। দেখা যেতো বাবাও তার সন্তানের পিতা।
২০টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মেসোপটেমিয়ার সম্রাজ্যের আইনগুলো ছিল বড় নিষ্ঠুর।সুন্দর একটি প্লট হাতে নিয়েছেন।এগিয়ে যান ইতিহাস জানান।
মৌনতা রিতু
চেষ্টা করব বেশ কিছু বই এর সবগুলো তথ্য মিলায়ে নিজের মতো করে লিখার।
ধন্যবাদ জানবেন ভাই।
ইঞ্জা
আপু আপনাকে সাধুবাদ জানাই অসাধারণ এই পোষ্টের জন্য, যুগে যুগে দাস নামক মানুষদের উপর অত্যাচার চলেছে এবং চলে এসেছে যা এখনো চলছে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে এখনো অন্য নামে হলেও এই প্রথা বন্ধ নেই, আপু লিখে যান, পাশে আছি।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ, ভাইজু। 🙂
চেষ্টা করব।
ইঞ্জা
শুভকামনা আপু
জিসান শা ইকরাম
অনেক কিছু জানলাম এই পোষ্ট পড়ে।
কৃতদাসের মত একটি জঘন্য পেশায় মানুষকে জোর করিয়ে করতে বাধ্য করা হতো।
সভ্য মানুষ তাঁদের সভ্যতা গড়েছে তাদের এমন হীন মানসিকতা থেকে।
এমন পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে।
মৌনতা রিতু
হুম ভাইয়া তা ঠিক। আমরা সেই সব মানুষের উত্তরসূরি।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
সৈয়দ আলী উল আমিন
ভাল একটি বিষয় বেছে নিয়েছেন। লেখাটি খুব ভাল লাগলো।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাই। শুভকামনা রইলো।
মোঃ মজিবর রহমান
দাসপ্রথার বিলুপ্ত এখন হয় নাই আমার মতে, শুধু ব্যাবহারে প্রয়োজনে গতিধারা পাল্টিয়েছে মাত্র।
তবে অতীতে এটা ছিল খুবই নির্মম আর লোমহর্ষক। কোন নির্যাতনের বা ব্যাবহারের একটুকু স্বাভাবিকতা ছিলনা।
সুন্দর আপনার এই লেখাটি।
মৌনতা রিতু
হুম ভাই। তবে পার্থক্য আছে।
দেখি ভাই কতোটুকু পারি সবার মান রাখতে।
পাশে থাকবেন।
নীহারিকা জান্নাত
কোথাও কোথাও এখনো দাসপ্রথাটা অন্য নামে চলছে।
অবশেষে শুরু করলেন?
লিখতে থাকুন, আমরা জানতে থাকি।
মৌনতা রিতু
পুরোটাই তোমার উৎসাহ। ধন্যবাদ সোনা।
শুভকামনা ও ভালবাসা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
এত্ত কঠিন পড়াশোনা আমাদেরও কাজে লেগে যাচ্ছে, চলুক।
তবে আমারা সভ্যতার দাবী জোরেশোরে করলেও দাস প্রথা জোর কদমে
সামনে নিয়ে যাচ্ছি।
মৌনতা রিতু
তখন এবং এখনকার দাস প্রথার মধ্যেও একটা পার্থক্য আছে।
দেখা যাক পড়াশুনা কতোটুকু সফল হয়।
ধন্যবাদ ভাই। পাশে থাকবেন ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন।
শুন্য শুন্যালয়
ছাইরাছ ভাইয়া যেন কী একটা মুভির নাম দিয়েছিল, এখন মনে করতে পারছিনা। দাসপ্রথার উপর। চমৎকার একটা মুভি। পড়ার পাশাপশি সময় পেলে মুভিগুলো দেখো, লেখায় আরো প্রাণ আসবে।
হ্যাটস অফ ভাবী তোমাকে। ভালো প্রজেক্ট। যেহেতু বই হাতে পাচ্ছিনা, তোমার লেখার উপরেই পুরোপুরি নির্ভর করছি আরো আরো জানার জন্য।
মৌনতা রিতু
আমি যখন ইতিহাস পড়ি তোমার ভাইয়ার সাহায্য নিয়ে বইগুলো কিনি। Civilization এর উপর কিছু বই এর অর্ডার করেছি খুব শিগ্গিরই পাব আশা করছি।
দেখতে হবে তো কেমন ভাই বোন!
নীলাঞ্জনা নীলা
যেদিন দিয়েছো, সেদিনই পড়েছি।
জানোই তো কেমন লেগেছে আমার! 🙂
মৌনতা রিতু
হুম আপু, তুমি বলেছিলে সেদিন। তুমি এখন কেমন আছো?
নীলাঞ্জনা নীলা
বেশী হাত নাড়ালে ব্যথা করে কিছুটা। ব্যাপার না! 😀