কৃষ্ণচূড়ার হৃদয়

রিতু জাহান ১৫ জুলাই ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৪:৩৪অপরাহ্ন অণুগল্প ৩১ মন্তব্য

আমার_লেখা

ছোটোগল্প

*কৃষ্ণচূড়ার হৃদয়*

সাড়াশব্দহীন কেটে গেছে উত্তর পাশের এ বেলকনি আমার অনেক অনেক রাত বই পড়ে গজল শুনে। একটামাত্র বেলীফুল রেখেছিলাম আমি এ বারান্দায়। এমন নিরবতা বেশ শান্তিময় ছিলো আমার বরাবর। বই এর পাতায় কল্পনায় ভেসে যাওয়া যেতো বহু বহু সময়। এক নিজস্ব অবয়ব যেনো সেজে উঠতো প্রচন্ড প্রেমে। বুদ্ধদেব আর যাইহোক আমাকে প্রচন্ডপ্রেমে ভেসে যেতে শিখিয়েছিলো।

বুদ্ধদেবের সেই সব প্রেমবর্ণনায় আমার সে নিজস্ব অবয়ব বাস্তবে খুঁজে পেতে তাই মন করেছে বহু তালবাহানা। বাস্তবে রেদার টানে তার সুস্পষ্ট মসৃণতা আসেনি।

আজকের নিরবতা আমাকে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে যাচ্ছে। আমার এ প্রিয় রুমটাতে আজ আর আমি একা নই। অচেনা অজানা কেউ শান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন। এ বারান্দাও আমার দখল করে আছে তার সে নিঃশ্বাসের শব্দ।

রুমের কোণায় টেবিলের উপরে বোর্ড বইএর পাতা থেকে কেটে নেয়া লাইনে সাজানো খাতার পাতায় কালির আঁচড়ই আজ সব। সে সব অক্ষর পড়ে আছে নির্জিব পড়েও থাকবে হয়তো।

যে সরল অংক মিশতো না আমার কোনোকালে জীবন তাই বেঁকে গেলো অন্যমোড়ে। অচেনা অজানা পথে বাঁক ফেলেছে জীবন।

পাহাড় থেকে নেমে আসা উর্বশী বালিকা জলরেখা যেনো আমি। নদী হতে না পারার আক্ষেপে বসে আছি।

 

কোয়ার্টারের কিছু দূরেই শ্মশান। সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়েছে একটা আস্ত দেহ। চন্দনের সুবাস ছিলো কি তাতে! ছিলো না যতোসম্ভব। কেরোসিন ঢেলেছিলো দ্রুত আরো জোরে আগুন দিতে। তাই তো দাউ দাউ করে জ্বলেছিলো। দূর থেকেও আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছিলো।

ছাদ থেকে শুধু তার ধোয়া ওঠা দেখেছিলাম। এখন কিছুই কি আর অবশিষ্ট নেই? পোড়া শেষ না হতেই আপনজন সংসারে মন দেয়,,,, লাশ পোড়ে একা শ্মশানঘাটে।

 

ঘুমকাতুরে আমি বসে আছি। আমি একা বসে আছি। রুমে ঘুমে বিভোর স্বামী পুরুষটি। মাত্র কিছুক্ষণ আগে কোনোরকম পূর্ব ঘোষনা ছাড়া তিনি আমার স্বামী খেতাব পেয়েছেন। সমস্ত আর্জী খালাস হয়েছে মায়ের আদালতে।

আমার পা কাঁপছে উঠে সেই চিরচেনা প্রিয় একান্ত একার আমার বিছানায় যেতে।

আমি যেনো হাঁটতে ভুলে গেছি। কি করে আমি কেমন করে কি কথা বলব! ডাকব নাকি চুপচাপ শুয়ে পড়ব এই ভাবনায় কেটে গেলো আরো অনেকটা সময়।

আযান পড়ে গেছে। একদম কানের কাছেই মসজিদ। এ ভোরের আযান আমি এর আগে এতো জোরে কখনো শুনিনি। আজকে শব্দ এতো জোরালো কেনো!

বুকের ভিতর শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে যেনো। কেমন এক অসহ্যরকম কষ্ট হচ্ছে আমার হঠাৎ। এতোক্ষণ যেনো নিজের পরিণতির বোধটুকু আমার উপলব্ধির বাইরে ছিলো। অবশ লাগছে। প্রচন্ড ঘুমে আমার চোখ ভারি হয়ে আসছে। রাতজাগা চোখের পাতা ক্লান্তিতে ভারি হয়ে আসে। শ্রবণশক্তি প্রবলবেগে ছুটলেও চোখমুজে আসতে চায়। পা উঠিয়ে কখন বিছানার কোনায় আমি বুঝে যেনো এলো না। মনে হলো কতোক্ষণ আমি অঘোরে ঘুমিয়ে নিয়েছি।

 

সকাল হয়েছে, অথচ আমার যেনো সবকিছু অচেনা। লজ্জা, ঘৃনা রাগ সব মিলে একাকার।

খিদে নেই একচুল পরিমান। তবু বড় যত্নে রুমেই আমার খাবার চলে এলো। অথচ এ বাসায় বরাবর নিয়ম খাবার টেবিলেই সকলের খেতে যেতে হয়।

খেতে হবে। বাধ্য মেয়ের মতো আমি সব মেনে নিয়েই প্রতিটা কাজ করতে লাগলাম। এই মেনে নেবার বিনয়টুকুছাড়া যেনো আমার আর কিছুই করার ছিলো না নেইও।

 

তিনি চলে গেলেন। তার আসা আর এই কয়েকঘন্টার থাকার হিসেব যেনো আমার ঐ বীজগাণিতের নিয়মের মতো মিলছে না কিছুতেই। বোঝার বাইরে যা আজীবন থেকে গেলো। সবচেয়ে দূরন্ত চঞ্চল সকলের চোখে লক্ষী মেয়েটা একেবারে নিরব এক দর্শক যেনো। নিজ জীবনের ঘটনার নিরব দর্শক। যেখানে প্রতিবাদ আর্জীর কোনো দাম নেই।

 

কলেজে যাব! আমি কলেজে পড়ব। কি এক সে উৎসাহ। স্বাধীন এক জীবন একটা উড়ন্ত সময় আমি পার করব।  এসব স্বপ্নকল্পনার বাক্সে বন্দী রেখে আমি আজ কলেজে গেলাম। সবাই খুব খুশি আবার বিস্ময়ও তাদের চোখেমুখে। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

সেদিনের পরে আর কলেজে যাওয়া হয়নি। বন্ধ করে দিলাম।

নাকি দেয়া হলো আমি বুঝতে পারলাম না।

পনেরোদিন পার হতেই উনি এলেন আমায় নিতে। তার কর্মস্থলে।

আমি চলে যাচ্ছি। এ বাসা ছেড়ে আমার সকল প্রিয় কিছু ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি।

আমার লাল ক্যাসেট প্লেয়ার। মেহেদী হাসানের কবিতা,,, মেহেদি হাসান, গোলাম আলীর গজল সব পিছনে ফেলে আমি চলে যাচ্ছি। একদল বাচ্চাপার্টি আমার বিকেলের খেলার সাথী সব সব ছেড়ে।

 

বেশ ছিমছাম করে গোছানো নতুন ঘরে আমার গৃহপ্রবেশ তিনি বেশ সুন্দর করেই করলেন। একেবারে সংসারের কাজ না জানা মেয়েটা সংসার করবে!

ভাবতেই যেনো কেমন লাগা শুরু হলো। দুইজন মানুষের জন্য ঠিক কতোটুকু চাল লাগে! পেরেই গেলাম পাশে ভাবির পরামর্শে সব। খুব আদরে আমাকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন। একেবারে ছোটোবোনের মতো।

জীবন যেনো এমনও হয়, নিজেকে বুঝিয়ে গুছিয়ে নিতে শেখা আমি ধাতস্থ হলাম বেঁধে দেয়া জীবনের সাথে।

এই ভাবনায় আজ সুন্দর একটা দুপুর পার করব ভাবলাম।

একটা খাট, একটা টেবিল দুইটা চেয়ার, তার ট্রাঙ্ক এই নিয়ে এ সাতদিনের সংসার জীবন। নিজের কাপড়গুলো ব্যাগেই রয়ে গেছে। মনে হলো তার ট্রাঙ্কেই তো আমি কিছু কাপড় রাখতে পারি!

খুলে ফেললাম ট্রাঙ্ক এর তালা।

খুব গোছানো একজন মানুষ তিনি। সুন্দর বেশ বড়সড় একটা ট্রাঙ্ক। ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিলো বোঝা যাচ্ছে। থরে থরে সাজানো রাবার দিয়ে মুড়িয়ে রাখা বেশকিছু চিঠি।

পড়ব! মন বলছে পড়তে। আবার কোথাও আটকাচ্ছে যেনো। নাহ! আমি এক এক করে চিঠি পড়তে শুরু করলাম।

মেয়েটির নাম বেশ সুন্দর। সায়রা। এতো আবেগ! প্রতিটা চিঠিতে প্রচন্ড প্রেম আর আবেগে কাটানো তাদের সময়স্মৃতি গেঁথে লিখে ফেলা গোটা বিশেক চিঠি।

দুজনেরই হাতের লেখা বেশ সুন্দর। এতোটুকু কাটাকাটি নেই কোথাও। আমার কোথাও বেশ কষ্ট হচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে।

আরো কিছু চিঠি। নামটা থাক!

এ নামটা নিতে আমার বেশ আপত্তি এখনো। এ প্রেমটা তার চলমান ছিলো,, তবে কেনো আমি??

তাকে কি আমার প্রশ্ন করা দরকার??

দরকারই তো। তবু, প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করতে রুচি হচ্ছে না। তবু একটু তো প্রশ্ন করতেই পারি।

কিন্তু আসলে কিভাবে জিজ্ঞেস করা যায়! এখানে আমি একা একেবারে একা। আমার কান্না পাচ্ছে না এতোটুকু। আমি বসে আছি শুধু।

পাশের ভাবি ডাকছে। বিকেলের আড্ডায় বাড়িআলা চাচা আজ গরম গরম সাধুরমোড়ের জিলাপি এনেছে।

এ ট্রাঙ্কে কি আমার কাপড় রাখা মানায়? নিজেকেই প্রশ্ন করে থেমে গেলাম।

এ বাসার কোনো বারান্দা নেই। খুব অসহ্য লাগে আমার কোনো বাড়ির বারান্দা না থাকলে। এক চিলতে আকাশ দেখা যায় না একান্ত নিজের করে। উঠোন ভরা মানুষ। সেখানে উর্ধমুখে নালিশ জানাব কপলজুড়ে জলরেখা টানবে চোখজোড়া, জবাব দিব কাকে!

বাংলা সিনেমার মতো কেঁদেকেটে বালিশ ভিজাব! কিন্তু আমার তো কান্না পাচ্ছে না এতোটুকু। আমার এখন শুধু এক চিলতে আকাশ চাই একেবারে নির্জঝঞ্জাট এক চিলতে নিরব আকাশ। এ মুহূর্তে বাইরে বের হতে এতোটুকু ইচ্ছে করছে না।

বরং ওরা ভেবে নিক আমি ঘুমিয়ে গেছি। ডাকাডাকি বন্ধ হলো। চাচা গেটের নীচ দিয়ে জিলাপি রেখে গেছেন। মেয়ে নেই তার কোনো। খুব ভালবাসেন আমাদের দুইজনকে তাই।

 

রাত বারোটার মতো বাজে। রান্না হয়নি কিছু। তিনি আসলেন কি সাধারণ ভঙ্গিমায়। হাত মুখ ধুয়ে খাবার চাইতেই মনে হলো আমি তাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দেই। কিন্তু গলা দিয়ে একটা শব্দ বের হলো না। আমি চুপ করে শুয়ে থাকলাম পাশ ফিরে। আবির্ভাব অশ্রু গোপন করে মুখ ফিরালাম যেনো। মনে হলো বলে দেই ট্রাঙ্কটা যেনো সে খুলে দেখে। বলতে হলো না। ট্রাঙ্ক এর পাশে আমার কাপড় পড়ে থাকা দেখে তার সব বুঝে এলো।

ট্রাঙ্ক খুলে সব চিঠি তিনি বের করে রান্না ঘরে গেলেন। পুড়িয়ে ফেললেন এতোদিনের জমানো হৃদয় নিংড়ানো আবেগ।

বিনা কোনো কৈফিয়ত বিনা কোনো বাক্যব্যায়ে শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু আমার ভিতরটা একেবারে গুটিয়ে গেলো। প্রেমিকার একটা ভুলে তিনি বিয়ে করে ফেললেন অন্য একটা মেয়েকে সামান্য কয়েকদিনের পরিচয়ে। আমার ভালবাসার সে অবয়ব সেজে ওঠার আগেই অস্পষ্ট হলো। মাত্র জীবনকে বোঝাতে পেরেছিলাম যেনো, জীবনে এমনও হয়! অথচ কয়েকটা কাগজের টুকরো কিছু শব্দ তার নিরবতা আমার সবকিছু এলোমেলো করে দিলো।

আমি মরে গেলোম নাকি আমাকে মেরে ফেলা হলো!

সেই চিতার মতো জোর করে যাতে ঢালা হয় কেরোসিন।

এতোটা জীবন সেখানে আর প্রেম সাজেনি কখনো। তবু কেটে গেছে কতো কতো বছর! কি-ই বা হতো জমা না রেখে ও সকল দস্তাবেজ! আমারই বা কি-ই বা দরকার ছিলো অন্যের হৃদয়ে উঁকি মারা! থাকতো না হয় কিছু তার গচ্ছিত হৃদয় নিংড়ানো আবেগ। মানুষের হৃদয় আমার ঐ লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো লাগে। লাল রক্তাক্ত। অযথা উঁকি মেরে  মাঝখানে দেয়াল বাঁধে বিরহের দশ উদাসীন-দশা জীবনপুরে।

কেটে গেলো এরই মাঝে জীবন অলিখিত মৃত্যুর সনদ হাতে লিখিত মৃত্যুর অপেক্ষায়।

,,,রিতু জাহান,,,

রংপুর।

আজ মার্চ এর দুই

ফাল্গুনের সতেরো।

কৃষ্ণপক্ষ।

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ