একটি ভুলে ভরা জীবন

ঘুমের ঘোরে কেটে যাওয়া অনন্ত পথ ৬ ডিসেম্বর ২০১৩, শুক্রবার, ১০:৩৮:২১অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

আজ বহুদিন পর কলিকে তাদের বাসার বারান্দায় বসে থাকতে দেখলাম। কেমন জানি একটা উদাস উদাস ভাব দেখলাম কলির চোখে মুখে। দূরে কোন এক অজানা সীমানায় তার দৃষ্টি আটকে আছে। মুখটা কালো হয়ে আছে, চুল এলোমেলো। আগের তুলনায় অনেক শান্ত লাগছে তাকে আজকে। অথচ ভাগ্যের কি খেলা!! এই তো ৩ বছর আগেও কলি এতটা শান্ত ছিল না। খুব দুষ্ট না হলেও পাড়ায় সবাই তাকে এক নামে চিনতো। দেখতে তেমন অপরূপ সুন্দরী না হলেও কলির চেহারায় এক মাদকতা ছিল। আর সেই মাদকতা দিয়েই সে পুরো পাড়া মাথায় রাখতো। এলাকার বড় ভাইয়ারা তার কথা ফেলতে পারতো না। সবাই তার সান্নিধ্য পেতে চাইতো।

 

একটু কথা বলার জন্য পাড়ার ছেলেরা তাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি। যা একটা নিয়মে পরিণত হয়েছিল। কলি এসবে পাত্তা না দিলেও মাঝে মাঝে কিছুটা ছাড় দিত তাদের। আর তাতেই আস্কারা পেত ছেলেরা। এভাবে করেই কলির দিন কেটে যাচ্ছিল। কলি পড়াশোনা করতো মাষ্টার্স এ।

মাষ্টার্স  এর পড়া যখন শেষ তখন কলির বাবা তার বিয়ের দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু কলি তার বাবাকে বলে দিল, সে আরো পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। বিয়ে করার ইচ্ছে তার নেই। কলিরা ৩ বোন। সে সবার বড় হওয়াতে তার বিয়ে আগে দিতে চাইছিল তার বাবা আর মা। কোনভাবেই যখন তাকে রাজি করানো যাচ্ছিল না তখন কলি নিজে থেকেই মুখ খুললো একদিন তার বাবা আর মায়ের কাছেই। কলি বিয়ে করেছে আরো ২ বছর আগে!  তার বাবা এই কথা শুনে স্ট্রোক করলেন। হাসপাতাল, বাসা, ডাক্তার এসব করে করেই পার হল আরো ২ / ৩  মাস। তারপর যখন সুস্থ হয়ে বাবাকে তারা বাসায় নিয়ে আসলেন। কিছুটা ধাতস্ত হয়ে সে তার বিয়ের কাহিনি জানালো সবাইকে। সে যাকে বিয়ে করেছে সে থাকে আমেরিকায়। আর তার সাথে কলির পরিচয় ইন্টারনেটে। যখন সে কলেজ পাশ করেছিল সেই সময় থেকেই ছেলেটার সাথে তার সম্পর্ক। আস্তে আস্তে এই সম্পর্ক ভালবাসায় রূপ নিতে থাকে। আমেরিকায় ছেলে ভাল বেতনে চাকরি করে। গাড়ি বাড়ি সবকিছুই আছে। ছেলের বাবা আর মা ঢাকাতে থাকেন। আর ছেলের প্রতি বিশ্বাস তার আছে। সময় যত গড়াতে থাকে ততই তারা ২ জন আরো ঘনিষ্ট হতে থাকে। একসময় তারা বিয়ের ডিসিশন নেয় তবে কাউকে না জানিয়ে।

যখন সময় আসবে তখন সবাইকে জানানো হবে তাদের বিয়ের বিষয়টা। কলি আর না করলো না। পরের মাসে  ছেলে বিদেশ থেকে চলে আসে কলির সাথে দেখা করতে। ওটাই ছিল তাদের প্রথম দেখা। সেদিনের দেখার পর তাদের ঘন ঘন দেখা হতে থাকে। পরে তারা বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে। বিয়ের দিন বাসায় কাউকে কিছু না জানিয়ে ভালবাসার মানুষকেই বিয়ে করে কলি। এতে সাক্ষী থাকে কলির এক বান্ধবী আর ছেলের এক বন্ধু। আর বিয়ের কিছুদিন পরই কলিকে রেখে আবার আমেরিকায় চলে যায় ছেলে। এভাবেই সব ঘটনা সেদিন পরিবার কে প্রথম জানায় কলি।

 

সব শুনে প্রথমে কলির বাবা এটা মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে উনি রাজি হন। আর যেহেতু এখন সবাই জেনে গিয়েছে তাই ছেলের সম্পর্কে খোঁজখবর করা দরকার। কলি এতে বাধা দেয় না। ছেলের বাসার ঠিকানা অনুযায়ী কলির বাবা লোক পাঠান খোঁজখবর নেয়ার জন্য। তারা এসে যা জানায় তা শোনার জন্য আসলে কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। কলি যাকে বিয়ে করেছে তার বাবা মা পরিবারের কেউ জীবিত নেই। ছেলে বড় হয়েছে তার এক সৎ মামা এর কাছে। আর সেই ছেলে বিয়ে করেই আমেরিকায় চলে গিয়েছে। দূটো বাচ্চাও আছে তার সেখানে।

 

কলি এই ধাক্কা কিছুতেই সামলে উঠতে পারছিলো না। এরপর আর কখনও সেই ছেলেকে ইন্টারনেটে কিংবা ফোনে পায় নি। জীবনটা যেন তার এলোমেলো হয়ে গেল কলির। কলির মা কলিকে খুব ভালবাসতেন। উনি এসব কথা শুনে সেই যে বিছানা ধরলেন তারপর আর তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারেন নি। এর কিছু দিন পরই তিনি মারা যান।

 

ধিরে ধিরে কলির বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি খুব একটা বাসা থেকে বের হতেন না। সংসার চালাতে কলিকেই চাকরিতে নামতে হয়। কিছুদিন পরই বাবাও দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। এদিকে কলির ছোট বোন আত্যহত্তা করল। কলির শারীরিক অনেক সমস্যা ধরা পরে। তার চোখের জল এখন শুকিয়ে গিয়েছে এত কষ্টের মধ্যে থাকতে থাকতে। একের পর এক ঝড় এসে তাকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। আর এভাবে করেই সুন্দর এক সাজানো পরিবার আজ তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে শুধু ওই একটা ভুলের কারণে।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ