ইরার ডাইরী- পর্ব-৩

নীরা সাদীয়া ৩ এপ্রিল ২০২০, শুক্রবার, ০৮:১৯:২৩অপরাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

ওসমানের কাছে সব শুনে ইরা কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবলো।তারপর বললো,
: ওসমান, আমি আপনাদের বস্তিটা দেখতে যাবো,এমনকি আপনার বাড়িতেও যাবো।
:বস্তিতে নিশ্চই যাবেন ম্যাম। তবে আমাদের এখন আর বাড়ি বলতে কিছুই নেই। আপাতত মামাবাড়িতে আছি। মামা বাড়ি গোড়ানের দিকে, যাবেন?
: নাহ্, থাক। বস্তিটাই দেখা জরুরী।

পরদিন সকালে অফিস যাবার আগে ওসমানকে সাথে নিয়ে সখীপুর বস্তিটা ঘুরে দেখে এলো ইরা। চারদিকে ধূ ধূ করছে শুধু। এদিক ওদিক পোড়া ছাই। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু ঘর বাড়ির ভাঙা অংশ। আর তাতে মিশে আছে মানুষের হাহাকার...

অফিসে বসে আবারও সেই কেসটা নিয়ে ভাবছিলো ইরা। কেসটার ডেট পড়েছে সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহে। এরই মাঝে শক্ত কিছু যুক্তি প্রমাণ সাজাতে হবে। এমন সময় শফিক ফোন করল।

:ইরা
:শুনছি
:ঐ ওসমান ছেলেটা তোমার কাছে গেছিল, না?
:কে বললো?
:চারদিকে আমার লোক লাগানো আছে। তোমার সকল খবরাখবর মুহূর্তেই আমার কানে চলে আসে, হাহাহাঃ
:বাহ্, সে তো খুব ভালো। সব যখন জানোই, তবে অযথা প্রশ্ন কর কেন?
: সবসময় চ্যটাং চ্যটাং কথা! তুমি খুব ভালো করেই জানো, তুমি আমার দূর্বলতা। তাই সুযোগ নিচ্ছো। তবে মনে রেখ, আমাকে বেশি চটালে এর ফল কিন্তু ভালো হবে না। তোমাকে ওকালতি পড়িয়েছিলাম আমার পাশে থাকার জন্য, আর তুমি?
:ভুল বললে। তুমি আমাকে পড়াওনি। পড়েছি আমি নিজেই। তবে হ্যাঁ, তুমি টাকা দিয়ে খরচটা চালিয়েছ।
:ওসব টাকার হিসেব আমি করি না...
:তা করবে কেন? টাকাগুলো তো কালো টাকা।
:মুখ সামলে কথা বলো ইরা। নইলে...
:নইলে কি? কি করবে? যা পারো করে নাও।

ইরা বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিল। অথচ একটা সময় সারাটা দিন কেটে যেত এই ভেবে কখন ঐ নাম্বার থেকে একটা ফোন আসবে? কখন জানতে পারবে ঐ পাশের মানুষটা কেমন আছে,খেয়েছে কিনা ইত্যাদি খবরাখবর। এসব এখন আর সে ভাবতে চায় না। অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম করছে ইরা। রাতের খাবারের জোগাড় করতে হবে।কিন্তু তার এসব কিছুই করতে মন চাইছে না।আজ অব্দি কত আসামীর বিরুদ্ধে লড়েছে। কোনদিন একটুও মায়া জাগেনি।অথচ আজ কেন বারবার এমন হচ্ছে তার, নিজেই ভেবে পাচ্ছে না।

সামনের মাসে কেসটা কোর্টে উঠবে। এর আগেই বাদী এবং নিজ জুনিয়রদের সাথে এটা নিয়ে বসতে হবে। কি করবে, কিভাবে আগাবে তা নিয়ে একটা ছক করে ফেলবে। এসব চিন্তা মাথায় আসতেই সাথে সাথে ফোন করল স্নিগ্ধাকে। স্নিগ্ধা তার জুনিয়রদের মাঝে সবচেয়ে মেধাবী। আগামীকাল শুক্রবার, ছুটির দিন। তাই তাকে বাসায় আসতে বললো। প্রাথমিক কাজটা তাকে নিয়েই সেরে ফেলতে চায় ইরা।

পরদিন যথারীতি সকাল বেলা স্নিগ্ধা এলো। তাকে নাশতা দিয়ে বসে গল্প করতে করতে কেসটার কথা বিস্তারিত বললো। তবে বিবাদীর সাথে তার কি সম্পর্ক তা কেউ জানতে পারল না।মোটামুটি একটা ভালো ছক কষে তারপর তাদের আলোচনা শেষ হলো। দুপুরে খেয়েদেয়ে স্নিগ্ধা চলে গেলো। এবার একটু বিশ্রাম নিতে নিজ ঘরে গেলো ইরা। শুক্রবারটা তার কাছে একটু অন্যরকম। এই দিনটা এলেই তার মনে পরে সেই দিনগুলোর কথা... বিয়ের পর পর শফিকের সাথে কাটানো খুব সুন্দর কিছু শুক্রবার। একেক বিকেলে একেক জায়গায় ঘুরতে যেত। কোন কোন দিন কোথাও না গিয়ে বাসার ছাদে বসেই চলতো আড্ডা। ইরা খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারে। শফিক মূলত কবিতার 'ক' ও বুঝতো না। কিন্তু ইরার সাথে থেকে থেকে অনেকটাই বুঝে গেছে। ধীরে ধীরে কবিতা তাকে আকৃষ্ট করতে শুরু করেছিল। আচ্ছা, শফিক কি এখনো কবিতা শোনে? নিজের মনকেই প্রশ্ন করছিলো ইরা। তার ভাবনায় ছেদ পড়লো, হঠাৎ একটা অজানা নাম্বার থেকে ফোন এলো।

:হ্যালো
:ইরা ম্যাডাম বলছেন?
:বলছি। আপনি কে?
:আমাকে চিনে আপনার লাভ নেই৷ আপনি সখীপুরের কেসটা ছেড়ে দিন। এজন্য আপনি যে পারিশ্রমিক পেতেন, তার দ্বিগুণ আপনাকে দেয়া হবে।
:থামুন! টাকা দিয়ে ইরাকে কেনা যায় নাহ্। আপনি ভুল করছেন। আর হ্যাঁ, আমি কোন পারিশ্রমিক নিচ্ছি না এটার জন্য।
:বাহ্ ম্যাডাম! খুব তো সমাজ সেবা করছেন। এবার দেখুন আপনার সেবা কে করে...
:আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? হ্যালো...হ্যালো...

লাইনটা কেটে গেলো। ইরা স্পষ্ট বুঝতে পারল এটা কার কাজ। মনে পড়ে গেলো সেই দিনটার কথা...
শফিক বাসায় ফিরে চা চাইলো।ইরা বললো,
:কাল আমার একটা চাকরীর পরীক্ষা আছে। তুমি একটু কষ্ট করে আজ নিজেই চা টা করে নাও।
:তুমি কেন চাকরী করবে? কিসের অভাব তোমার?
:অভাবের জন্যই কি সবাই চাকরী করে? ধরে নাও এটা আমার জীবনের লক্ষ্য।
:লক্ষ্যটা বদলে ফেল।
:কেন?
:আমার জন্য।
:তবে বলো, আমার জন্য তুমি কি কি বদলেছ? আমি আমার পুরো পরিবারকে ছেড়ে তোমার সাথে এসে বসবাস করছি। ওখানে যেমন ছিলাম, যেভাবে ছিলাম তার সব পাল্টে এখানে নতুন করে শুরু করেছি। তোমার বাড়ির হেঁসেল থেকে ধরে বসার ঘর অব্দি সব সামলাচ্ছি। এইতো আজ এক কাপ চা নিজে করে নিতে বললাম বলে এই অবস্থা তোমার। আমি যা যা পারতাম না, তা শিখে নিয়েছি। আর তুমি? এক গ্লাস জল ও গড়িয়ে খেতে পার না! কতটুকু নিজেকে পাল্টেছ তুমি?
:থাক থাক! খুব হয়েছে। তোমাকে কিছু বলতে গেলেই যত ডাইলগ জানো সব উগড়ে দাও।
:ওটা ডাইলগ নয়, ডায়লগ।
:থাক তোমার কাছে ইংরেজি শিখতে চাই না। ওটা ছাড়াই আমার চলে।
:কেউ ভুল শুধরে দিলে তাকে সম্মান জানাতে হয়।
:বাদ দাও। কাজের কথায় আসি।
:বলো...
:আমি ভাবছি, তোমার নামে একটা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিব। ১ কোটি টাকার। কেমন হবে? তাতে করে তোমাকে আর চাকরী করতে হবে না।
:বাহ্! চমৎকার!
:খুশি হয়ে বললে?
:একদম! এতদিনে আমাকে তুমি এই চিনেছো? আমার সারা জীবনের অর্জনকে তুমি টাকা দিয়ে কিনে নিতে চাইছো। অবশ্য এরচেয়ে বেশি তোমার কাছ থেকে আর কিইবা আশা করা করা যায়? তুমিতো পৃথিবীতে টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝনা৷
:তুমি সবসময় আমার সাথে এমন কর কেন?
:শফিক, আমি একটা আস্তো মানুষ। আমার ভেতরেও কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে। সেগুলোকে সম্মান দিতে শেখো। ভুলে যেওনা, আমি কোন রোবট নই।
:হ্যাঁ, দুনিয়ার সবার বৌ দেখি শাড়ি, গয়না, গাড়ির চাবি এসব নিয়ে খুশি। আর আমার বৌ?...
: তোমার বৌ কি? থেমে গেলে কেন?
:মেয়ে মানুষ কিনা তাতেই যথেষ্ট সন্দেহ জাগে।
:মেয়ে মানুষ হবার আগে আমি ভীষণভাবে মানুষ।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে মাগরিবের আজান হয়ে গেলো, ইরা টেরই পেলো না। হঠাৎ খেয়াল করলো চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে এলো, এক ফোঁটা জল যেন মুক্তোর মত গড়িয়ে অযত্নে ঝড়ে গেল... যা শফিক কোনদিনই জানতে পারবে না।

চলবে...

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ