ইন আ রিলেশনশিপ উইথ…

অপার্থিব ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০৬:৫৯:০২অপরাহ্ন গল্প ২৩ মন্তব্য

জানিস ফার্স্ট ইয়ারে না দারুণ কিছু মেয়ে ভর্তি হয়েছে- এক বন্ধু বলেছিল ছেলেটিকে। সিগারেটের টুকরাটি ফেলে দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে ছেলেটি উত্তর দিয়েছিল-তাই নাকি?
-হ্যা চল না যাই দেখে আসি।
-আমার আগ্রহ নেই।
-আরে চল না?
বয়সের তাড়না, কৌতুহল কিংবা বন্ধুর অনুরোধ যাই বলি না কেন কি যেন মনে করে ছেলেটি সেদিন ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়েছিল। সবে মাত্র ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শেষ হয়েছে। ছেলেমেয়েগুলো হাসতে হাসতে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসছিল। কি যেন একটা বিষয় নিয়ে তারা সেদিন হাসছিল প্রাণভরে। তাদের মধ্যে লম্বা চুলের অধিকারী একটা লিকলিকে মেয়েও ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তটিই ছিল ছেলেটির মেয়েটিকে দেখার প্রথম মুহুর্ত। সেই প্রথম মুহূর্তেই অদ্ভুত এক ভাল লাগাবোধের ব্যথায় আক্রান্ত হয়েছিল ছেলেটি এবং মুহূর্তেই সেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছিল তার হৃদয়ের প্রতিটি গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। ছেলেটির মধ্যে কোন কাব্যময়তা ছিল না, প্রেমময় কোন কবিতা কিংবা সু্রের মধ্য দিয়ে ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সামর্থ্য তার ছিল না তবুও ছেলেটি মেয়েটিকে ভালবাসতো, ভালবাসতে চাইতো জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত।

একের পর এক দিন চলে যেত। ছেলেটিও সুযোগ পেলে কারণে অকারণে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো, কাতর নয়নে খুঁজে ফিরতো একটা পরিচিত মুখ। অধিকাংশ দিনই সেই মুখটি তার দেখা হত না কিংবা দেখা হলেও তার স্থায়ীত্ব হত বড় জোর কয়েক সেকেন্ড কিংবা সেকেন্ডের ভগ্নাংশ। তবুও ছেলেটি ঠায় হয়ে প্রতিদিন ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো। যদি মেয়েটিকে একবার দেখতে পেত তবে অন্তত ঐ দিনটাকে তার কাছে পরম সার্থক বলে মনে হত। মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে তার জন্য জমে থাকা দীর্ঘ দিনের অব্যক্ত ভালবাসার কথা বলতে চাইতো ছেলেটি কিন্ত কোন এক অজ্ঞাত জড়তা তাকে পিছন থেকে টেনে ধরতো। হৃদয় বলতো তার এই তীব্র আবেগময় ভালবাসার আবেদনকে মেয়েটি ফিরিয়ে দিতে পারবে না কিন্ত যুক্তি বলতো অন্য কথা। সে গ্রাম থেকে আসা তথাকথিত আনস্মার্ট ছেলে। ঠিকমত গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। রেজাল্টও খুব একটা ভাল না। মেয়েটি কি রাজী হবে? হৃদয় বনাম যুক্তির এই সুতীব্র লড়াই চলতে থাকলো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কিন্ত সেই লড়াইয়ের কোন ফলাফল হত না। এরপর একদিন ছেলেটি ঠিক করেছিল যে সে কিছুদিন অপেক্ষা করবে এবং এর মধ্যে নিজেকে তথাকথিত স্মার্ট হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবে।

এক বড়ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনটা টিউশনী জোগাড় করেছিল ছেলেটি। এক মাসে বেতন পেয়ে নিউ মার্কেট থেকে নুতুন শার্ট প্যান্ট কিনেছিল। প্রতিদিন শার্ট প্যান্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতো আর উপলব্ধি করার চেষ্টা করতো আর কতটা আধুনিক হওয়া সম্ভব তার পক্ষে। পাশাপাশি গুছিয়ে কথা বলার প্র্যাকটিস করতো নিয়মিত। বন্ধুরা তার এই নুতুন রুপ দেখে অবাক হত। কেউ কেউ বলতো- কিরে প্রেমে পড়েছিস নাকি? ছেলেটা হাসতো। বন্ধুরা বিস্ময় মাখানো দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাদের বিস্মিত দৃষ্টি দেখে ছেলেটির আত্ববিশ্বাস আরও বাড়তে লাগলো। ছেলেটি পড়াশোনাও করতো নিয়মিত। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সে, অনেক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। প্রতিটি স্বপ্নকে সে পূর্ণতার রঙ্গে রাঙ্গাতে চায়, একটি স্বপ্নকেও সে ধুসরতায় মলিন দেখতে চায় না। এভাবেই চলতে লাগলো দিনের পর দিন। এদিকে ছেলেটির হৃদয় গর্ভে জন্ম নেয়া ভালবাসা নামক ভ্রুণটির বয়স প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে। প্রতিদিন সে একটু একটু করে পুর্ণতার দিকে এগোচ্ছে। ছেলেটি সেই ভ্রূণটির পূর্ণতার অপেক্ষায় দিন গুণতে থাকে।

হঠাৎ একদিন ছেলেটির মনে হয়েছিল আচ্ছা ফেসবুক থেকে মেয়েটাকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠালেই তো পারে। ঐ দিনই ফেসবুকে মেয়েটির আইডি খুঁজে বের করে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট পাঠিয়েছিল সে। এরপর প্রতিদিন ফেসবুকে ঢুকে নোটিফিকেশন চেক করে দেখতো কিন্ত না কোনো রেসপন্স নেই। ছেলেটির হতাশা দিনকে দিন বাড়তে লাগলো। তারপর একদিন নোটিফিকেশনে কনফ্রামেশন মেসেজ পেয়েছিল ছেলেটি। সেদিনটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলোর একটি। তার মনে হয়েছিল প্রেম নামক মহাযুদ্ধের প্রথম লড়াইটা সে কোন বিশাল ব্যবধানে জিতে নিয়েছে, আজ সে কোন বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। এরপর থেকে প্রতিদিন ছেলেটি মেয়েটির ষ্ট্যাটাস পড়তো, লাইক দিত। কমেন্টেও মেয়েটির ষ্ট্যাটাসের প্রশংসা করতো সে কিন্ত খুব বেশি আলাপ তাদের মধ্যে হত না কারণ সেই আলাপ জমানোর মত সাহস তখন ছেলেটার ছিল না। এরই মধ্যে এক সময় সেমিষ্টার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেল। অতিরিক্ত টেনশন এবং ফেসবুক আসক্তির কারনে ছেলেটির পরীক্ষা খুব একটা ভাল হল না। পরীক্ষার পর এক সোমবার তাদের ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন ঠিক হয়েছিল। ছেলেটি সেই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের অন্যতম ছিল, মেয়েটিরও সেই অনুষ্ঠানে পারফর্ম করার কথা ছিল। ছেলেটি ঠিক করেছিল ঐ দিন অনুষ্ঠানে শেষে মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে বলবে তার দীর্ঘ দিনের অব্যক্ত ভালবাসার কথা। মেয়েটি যদি রাজী হয় তাহলে ওকে একদিন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একবার তুমি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে চেয়েছিল ছেলেটি। তাই একবার রাত জেগে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পুরো কবিতাটা মুখস্থ করেছিল সে। অনুষ্ঠানের আগের দিন পুরো আয়োজন নিয়ে ছেলেটি অনেক ব্যস্ত ছিল। রাতে ক্লান্ত অবস্থায় হলে ফিরে তার মনে হয়েছিল আজ সারাদিনে তো একবারও একবারও ফেসবুকে ঢোকা হয়নি। তাই তাড়াতাড়ি ফেসবুকে লগইন করে মেয়েটির প্রোফাইলে গিয়েছিল সে। সেখানে সেদিন একটা নুতন ষ্ট্যাটাস ছিল, ইন আ রিলেশনশিপ উইথ..

অনেকদিন পর ছেলেটি সেদিন বুকের ঠিক মাঝখানে তীব্র ব্যথা অনুভব করেছিল। তার মনে হয়েছিল আচ্ছা পৃথিবী কি কোন দিন ধবংস হবে? যদি সত্যিই কখনও পৃথিবী ধ্বংস হয় তবে আজই হোক না কেন, কিবা এসে যায় তাতে। অবাক বিস্ময়ে ছেলেটি লক্ষ্য করেছিল তার বুকের আজকের এই ব্যথা সেই প্রথম দিনের ব্যথা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ব্যাথা হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণের ব্যথা। তার মনে হল কে যেন চাবুকের আঘাতে প্রতিনিয়ত তার হৃদয়টাকে জর্জরিত করছে। একটু একটু করে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে সেখান থেকে।

ছেলেটি প্রায়ই পুর্নিমার রাতে শহরের বাইরে ছোট নদীর তীরটিতে ছুটে যায়। শ্বেতকায় কোন কাশবনের পাশে বসে প্রকৃতির রুপে মুগ্ধ হয়,বিষন্ন মনে জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলায়। রাত যত গভীর হয় পূর্ণিমার উদ্ভাসিত আলোয় আলোকিত হতে থাকে পৃথিবী। শুধু তার হৃদয় কুঠরীতে থাকে অমাবশ্যার তীব্র অন্ধকার। কার সাধ্য সেই কুঠরীতে একটু অপার্থিব চাঁদের আলো পৌছায়?

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ