আলিম সাহেবের বর্ষবরণ

নাজমুস সাকিব রহমান ১৪ এপ্রিল ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০৮:৫৩:১৫অপরাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য
আলিম সাহেব অদ্ভুত লোক, সকালবেলা অফিসে যাবার সময় কিংবা কোথাও গেলে তিনি তাঁর দুই পুত্র, এক কন্যা, এবং একমাত্র স্ত্রী উর্মি— সবার কাছ থেকেই বিদায় নিয়ে যান। পুত্রকন্যারা তাই বাবার অভ্যাস নিয়ে কিছু রসিকতাও করে। এইতো সেদিন চৈত্র মাসের এক ছুটির দিনে তাঁর স্ত্রী উর্মি বড়পুত্রকে ডেকে বললেন,— ‘তোর বাবা হঠাৎ করে কোথায় গেল বল তো?’ সে নির্বিকার কণ্ঠে উত্তর দিল,— ‘বাবা, আমাকে কিছু বলে যায় নি। আপনি বরং ঘরের দরজাকে জিজ্ঞেস করেন। কাউকে না পেয়ে হয়তো দরজার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন, সেরকম সম্ভাবনাও আছে।’ পুত্রকন্যাদের ধারণা তাদের পিতা ঘর থেকে বেরোবার সময় দরজা জানালাকেও বলেন— ‘বাইরে যাচ্ছি। ফি আমানিল্লাহ।’
ঘটনার ঠিক দু’মিনিট পরেই আলিম সাহেব অনেকগুলো ভেজা কাপড় নিয়ে উপস্থিত হলেন। বৃষ্টি নেমেছে, অথচ কারোর মনে নেই ছাদে কাপড় শুকাতে দেয়া হয়েছে। তাড়াহুড়া করে ছাদে যেতে হয়েছিল, তাই কাউকে বলে যেতে পারেন নি। চৈত্র মাসের বৃষ্টির ঠিকঠিকানা নেই, হুট করে নামে, হুট করে সব ভিজিয়ে চলে যায়।
এক সন্ধ্যাবেলায় আলিম সাহেব কাউকে কিছু না জানিয়ে ছোটপুত্রকে নিয়ে বেরিয়েছেন। সামনেই বৈশাখ, এমন সময় সাধারণত বৃষ্টি হয় না, তীব্র গরম পড়ে, তবুও ছাদে কাপড় আনতে গিয়েছেন কি-না দেখা হল। না, সেখানেও তিনি নেই। তাঁর বড়পুত্র পিতার খোঁজে কয়েকবার গলির মোড় থেকে ঘুরে সিগারেট টেনে এলো, তবুও তাঁর খোঁজ পাওয়া গেলো না। তিনি বেরোবার সময় সেলফোনটাও সঙ্গে নিয়ে যান নি। খোঁজাখুঁজির সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর তাঁর স্ত্রী উর্মি হাল ছেড়ে দিয়ে কন্যার সঙ্গে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে বসলেন।
আলিম সাহেব ঘরে ঢুকলেন রাত ন’টার দিকে। তাঁর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কোন একটা অপকর্ম করে এসেছেন। টিভি রুমে স্ত্রী-কন্যা তখনো হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে ব্যস্ত। তাদের ব্যস্ততা দেখে তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন। যা-ক এখুনি স্ত্রীর ধমক শুনতে হবে না। সুযোগ পেলেই সময় অনেককিছু গ্রাস করে, তাঁর স্ত্রীকে ধমক গ্রাস করে নিয়েছে। ঊর্মি যখন বলে ‘আজ অফিসে যাবে না?’, কেন জানি তাও ধমকের মত শোনায়। তিনি তাদের এড়িয়ে বড়পুত্রের কাছে গিয়ে বললেন,— ‘জানিস, এক কেজি ওজনের একটা ইলিশ কিনে এনেছি। এবারের বৈশাখে আমরাও পান্তা-ইলিশ খাব।’ তাঁর ধারণা ছিল পুত্র আনন্দিত হবে। অথচ সে মুখে একরাশ বিরক্তি এনে বলল,— ‘পান্তা খেতে তো ইলিশ লাগে না, পানি আর লবণ দিয়েই খাওয়া যায়।’
আলিম সাহেব বড়পুত্রের উদাসীনতায় পুরোপুরি নিভে গেলেন। তাঁর আর দোষ কী! তিনহাজার টাকা দিয়ে এক কেজি দুইশ গ্রাম ওজনের মাছ কিনে আনার পর, এমন উত্তর শুনলে যে কেউ নিভে যাবেন। তাছাড়া এটি যেমন তেমন মাছ না, জাতীয় মাছ। প্রবাদ আছে, মাছের রাজা ইলিশ।
ইলিশ কেনার ছোট্ট একটা কাহিনী আছে। সন্ধ্যার কিছু আগে স্কুল পড়ুয়া ছোটপুত্রটি বলল, সে নাকি কখনো বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খায়নি। তার কিছু ক্লাসম্যাট এবারের বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কথাটা শুনে তাঁর খুব খারাপ লাগল। কারণ, ছোটবেলায় তিনি নিজেও বাবা কখন ইলিশ আনবেন, সে প্রতীক্ষায় থাকতেন। তাঁর মা প্রায় সময় ইলিশের মাথা দিয়ে কচু শাকের ঘণ্ট রান্না করতেন। এখনো মনে পড়লে জিভে জল এসে যায়। নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আলিম সাহেব তখনই ছোটপুত্রকে নিয়ে বাজারে গেলেন। সেখানেও অনেক ঝামেলা, আলো আঁধারি পরিবেশে ইলিশের ভিড়ে স্যাডন-চৌক্কা এসব বিক্রি হচ্ছে। বাঙলাদেশ হল নদীর দেশ, আর নদী মানে হরেকরকম মাছ। অথচ তিনি দেখলেন কিছু লোক ইলিশ ভেবে স্যাডন-চৌক্কা এসব কিনছে! যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ভেজাল। মাছ তো কেনা হল, তাঁর ধারণা এবার টানাটানির সংসারে হঠাৎ এতগুলো টাকা খরচ করে ফেলার জন্য স্ত্রীর কাছে ধমক শুনতে হবে। ফেরার পথে তিনি ছোটপুত্রকে বললেন,— ‘তোর মা বকবে না তো?’, সে নিখুঁত কোলকাতার উচ্চারণে বলল,— ‘সে আমি কী জানি বাপু! হতচ্ছড়া বকাটকা একটু খেতেই হয়, বুঝলে?’
উর্মি মাছ দেখে স্বামীকে বললেন,— ‘বিয়ের আগে শুনেছিলাম তোমাদের বংশে পাগলের রক্ত আছে, আজ প্রমাণ পেলাম। এত টাকা দিয়ে কেউ মাছ কিনে?’ তিনি একবার ভাবলেন ছোটপুত্রের ইচ্ছেপূরণ করার জন্য কিনেছেন, তা বলবেন; পরক্ষণেই আবার মনে হল, বলে কী লাভ! সংসার করতে হলে আপোষ করতে হয়, তিনি তা মেনে নিয়েছেন। যার যত আপোষের ক্ষমতা, তার জীবনে ততো শান্তি।
রাতের বেলা পরিবারের প্রায় সব সদস্যের কাছ থেকে বাস্তববাদী কথাবার্তা শুনে আলিম সাহেব মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছেন; এমন সময় শুনলেন তাঁর কন্যা ফোনে তার বান্ধবীকে বলছে,— ‘ফারিয়া, জানিস আজ কি হয়েছে? বাবা কাউকে কিছু না বলেই বিশাল একটা ইলিশ মাছ কিনে এনেছে। এবার আমরা পান্তা ইলিশ খাচ্ছি। কোন চিন্তা নেই, ইলিশের টুকরো রাখতে না পারলেও তোর জন্য মাছের সবগুলো কাঁটা রেখে দেব। তোর চেহারা দিনদিন বিড়ালের মতো হয়ে যাচ্ছে, কাঁটা খেলে ভাল লাগবে। হি হি হি।’ নিয়মিত সিরিয়াল দেখার কারণে কন্যার কণ্ঠস্বরে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আহ্লাদ ছাড়া কথা বলতে পারে না। তবুও একমাত্র কন্যার মুখে এরকম কথা শুনে তাঁর মন ভালো হয়ে গেলো।
আলিম সাহেব এখন গুনগুন করে গান ধরেছেন,—‘ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা … এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।’ কেউ তার গান শুনুক, তিনি সেটা চাচ্ছেন না। তবে, এই মুহূর্তে বৈশাখকে গোপন আমন্ত্রন জানিয়ে তিনি খুবই আনন্দ পাচ্ছেন।
১৪.০৪.১৬
0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ