আমি কেমন করে ভুলি ?

রিমি রুম্মান ২৩ মার্চ ২০১৫, সোমবার, ০৮:৩০:০৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২২ মন্তব্য

অবশেষে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বামী'র যখন কোনমতে চলার মতন একটি জব হয়, আমরা আত্মীয়ের বাড়ি ছেড়ে আলাদা বাসায় উঠি। নিউইয়র্ক শহরে খাওয়া খরচ কম। বাড়িভাড়া এক্সপেন্সিভ। আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। বিধায় একটি রুম ভাড়া নেই। ছোট ছোট চার রুমের বাড়িটির তিন রুমেই ব্যাচেলর। একরুমে স্বামী-স্ত্রী থাকেন। তাঁরা একটু গুছিয়ে উঠেছেন, তাই আলাদা বাড়িতে যাচ্ছেন। সেই রুমটিতে আমরা উঠবো। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। ব্যাচেলর ছেলেদের সাথে এক বাড়িতে থাকবো ! অসম্ভব ! সেইসব অসম্ভব অনেককিছুই হেরে গিয়ে সম্ভব হয় বাস্তবতার কাছে। অসহায়ত্বের কাছে। গরীবি হালের কাছে...

 

আমি বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদি। এমন পরিবেশে কেমন করে থাকি ! দেশে আমার বাবার বাসায় যে রক্ষণশীল ভাবে বেড়ে উঠেছি ! স্বামী বোঝালো__ ছেলেগুলো খুব ভালো। তাছাড়া আগেও এইরুমে স্বামী-স্ত্রী ই ছিল। আমাকে ভুলে যেতে হল, দেশে কি ছিলাম... কেমন ছিলাম। তীব্র মন খারাপের মাঝে সেই বাড়িতে সংসার পাতলাম। সারাদিন ব্যাচেলররা জব করে। এই সুযোগে আমি আমার সব কাজ সেরে নেই। সন্ধ্যায় তাঁরা একে একে বাড়ি ফিরে, রান্না করে, ক্যাসেট ভাড়া করে আনে, নাটক দেখে। আমি চুপটি করে রুমে বসে থাকি।

 

ভাগ্য আমার সহায় ছিল। কোন এক অদৃশ্য কারনে তাঁরা সবাই আমাকে স্নেহ করে, ভালোবাসে, সন্মান করে। ভালোমন্দ রান্না করলে ডাকে। বিকেলে চা, মুড়ি, চানাচুর বানালে ডাকে। আমরা একসাথে খাই। গল্প করি। দিন্‌কে দিন তাঁদের সবাইকে ভীষণ আপন মনে হতে থাকে। দু'জনকে আবার আংকেল ডাকি। আমি তাদের দেশে রেখে আসা কন্যা'দের সমবয়সী। ব্যাচেলররা এক একদিন এক একজনের রান্নার দায়িত্ব। সব ঠিকভাবে চলে যদিও, কিন্তু যেদিন সাফা নামের ছেলেটির রান্নার দিন__ সেদিন বাড়িটিতে হৈচৈ লেগে যায়। সাফা'র রান্না মুখে দেবার মতো নয়। সবাই তাকে বকাঝকা করে__ মাছ বা মাংস ভাল করে কসায় না কেন... ভাজে না কেন... ঝোল বেশি দিসে কেন... লবন কম/বেশি কেন। সাফা মুখ বুঁজে থাকে। টুঁ শব্দটি করে না। মন খারাপ করে রুমে চলে যায়। নামাজ পড়ে। দু'হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করে ! কি জানি, রান্না ভাল হবার জন্যে দোয়া করে কিনা, কে জানে...

 

আমার মায়া লাগে। বলি__ সাফা ভাই, আপনি সব কেটে ধুয়ে রেডি করে দিয়েন। আমি না হয় রান্না করে দিবো। তিনি খুশী হন। এরপর সপ্তাহের একটি দিন অন্য সবার অগোচরে আমি সাফা'র রান্না করে দেই। তিনি পাশে দাঁড়িয়ে শেখার চেষ্টা করেন। রাতে সবাই তৃপ্তি নিয়ে খায়। অবাক হয়। সাফা'কে মধুর তিরস্কার করে, এতদিন মনোযোগ দিয়ে রাঁধেনি বলে ! সাফা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয় না। মাথা হেঁট হয়ে থাকে। প্লেটের দিকে চেয়ে নিবিষ্ট মনে খেয়ে রুমে চলে যায়।

 

এদিকে ঠাণ্ডার দেশে আমি ঠাণ্ডাজনিত অসুখে পরি। তাঁরা সবাই মিলে যে যখন বাসায় থাকে, আমাকে আদা-এলাচ-লেবু-লং এসব দিয়ে বিশেষ চা বানিয়ে দেয়। রোযার দিনে ইফতার বানিয়ে টেবিল সাজায়। খেতে ডাকে। যার যেদিন ছুটি, আমাকে রাস্তা চিনাতে নিয়ে যায়। স্ট্রীট, এভিনিউ শেখায়। সাবওয়ে ম্যাপ বুঝায়। হারিয়ে গেলে কিভাবে ফিরবো, বলে দেয়। আমি উপলব্দি করতে থাকি___ কখনো কখনো পরও অনেক আপন হয়...

 

এখন বাংলাদেশী বেড়েছে। বাংলাদেশীদের আধিপত্য বেড়েছে। অনেককিছুই অনেক সহজ হয়েছে। আমি হয়তো এদেশে নতুন আসা পরিচিতদের একটি জব খুঁজে পেতে কিংবা প্রাথমিক সহযোগিতাগুলো করি। কিন্তু একদিন আত্মীয় পরিজনহীন এই ভিন দেশে যারা আমার জন্যে এতকিছু করেছে, আমি তাদের কেমন করে ভুলি ? অচেনা অজানা সেই মানুষগুলো'র টুকরো টুকরো ঋণ কোন কিছুর বিনিময়েই কি শোধ হবার ?

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ