একেবারেই ছোট যখন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় যখন যুক্ত হয়নি কোন নদী, মোটামুটি তখনকার কথা!
বয়োজ্যেষ্ঠদের গল্পের নানা সূত্রে এবং বহু ধরনের শিশুতোষ বইয়ের অক্ষর ছুঁয়ে একটা নদী জন্ম নিল আমার বুকের ভেতর! কাকচক্ষু জলের নিস্তরঙ্গ সেই নদীর বাঁকে বাঁকে সরলতা! দৈর্ঘে-প্রস্থে-রূপে-সৌন্দর্যে অনন্য সেই নদীর দুকূল জুড়ে প্রণিধানযোগ্য পরিচ্ছন্নতা!
নদীটির একটা নাম দেয়া দরকার! নামহীন কোন কিছুর সাথে আত্মীয়তা যেন ঠিক জমে না!
কি নাম দেয়া যায় নদীটির? সমবয়সীদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম প্রথমে।
তারা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে! অনোন্যপায় হয়ে বড়দের দ্বারস্থ হলাম!
আমার কথা তাঁরা ভাল করে শুনলোই না। বরং স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যে এসব উদ্ভট চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার আদেশ দিল আমাকে।
কিন্তু আমার তখন শয়নে স্বপনে নদী! নদীর নাম আমার অবশ্যই চাই! আমি নিজেই তখন নদীর নাম খোঁজার চেষ্টা করলাম! একটা ভীষণ সুন্দর নদীকে নামহীন রাখার অপরাধ কাঁধে নেয়া যায় না কিছুতেই!
কয়েকদিন কয়েকরাত চেষ্টার পর একটা নাম শিশিরস্নাত শিউলির মতো ঝরে পড়লো ভাবনার সবুজ আঁচলে! 'মালঞ্চ'। চেতন কিংবা অবচেতনের কোন স্তর থেকে, কোন আধিভৌতিক অভিজ্ঞতার আদ্যকেন্দ্র থেকে এই নামের জন্ম কে জানে, তবে মালঞ্চ নামটা বেশ মানিয়ে গেল আমার বুকের গহীনে বাসা বাঁধা নদীটির সাথে!
নদীর নাম দেবার ব্যাপারে কারো কোন আগ্রহ কিংবা উৎসাহ না থাকলেও নদীর নাম শুনে এবার কিন্তু নড়েচড়ে উঠল সকলে। শুরু হল নানাজনের নানামুখী আলোচনা, সমালোচনা, মন্তব্য!
দূর! নদীর নাম আবার মালঞ্চ হয় নাকি!
এমন কথা শুনে আমার শিশুমুখটা ম্লান হল স্বাভাবিকভাবেই। পাশাপাশি আবোধ্য একটা জেদও তৈরী হল ভেতরে। যে যাই বলুক, আমার নদীর নাম মালঞ্চ-ই! মালঞ্চ নামের নদী অবশ্যই হয়! বড় হয়ে মালঞ্চ নামের নদী খুঁজে বের করে আমি দেখিয়ে দেব সবাইকে!
এই জেদ আমার অটুট রইল পরবর্তী জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে।
বিভিন্নমুখী কাজ কিংবা অকাজের পাশাপাশি শুরু হল একটা নদী খোঁজার খেলা।
শৈশবের শেষপর্যায়ে বাস্তবিকঅর্থে প্রথম নদী দেখলাম আমি। আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত মহল্লার পাশেই ছিল ধোপাপাড়া। ধোপাপাড়ার মানুষগুলো ছিল জলের আত্মীয়। বিভিন্ন জলাশয়ের সাথে ঘনিষ্ট পরিচয় ছিল তাদের। শুধু বড়রাই নয়, ধোপাপাড়ার ছোট ছোট অসীম সাহসী শিশুরাও নিকটবর্তী জলাশয়গুলোর খোঁজখবর রাখতো বেশ ভালভাবেই। অভিভাবকদের নিষেধ মানার দেয়াল টপকে একদিন ধোপাপাড়ার শিশুদের সাথে বেরিয়ে পড়লাম আমি। চেনা পৃথিবী পেছনে ফেলে মালঞ্চ নদী খুঁজতে গিয়ে পরিচয় হল বাস্তব জীবনের প্রথম নদী শীতলক্ষ্যার সাথে ।
তারপর অতিবাহিত হয়েছে অনেক সময়। বুকের ভেতরে থাকা নদীর বাস্তব অস্তিত্ব অনুসন্ধান করতে করতে কত নদ-নদীর বাঁকে ঘুরেছি আমি! পদ্মা-মেঘনা-যমুনা! গঙ্গা-বুড়িগঙ্গা-নবগঙ্গা! ব্রহ্মপুত্র-আঁড়িয়াল খাঁ-কপোতাক্ষ! মাতামুহুরি-হালদা-কর্ণফুলি! কুমার-নারদ-ভৈরব! পুর্নভবা-করতোয়া-মহানন্দা! সোমেশ্বরী-ধলেশ্বরী-ফুলেশ্বরী! সন্ধ্যা-সুগন্ধা-কীর্তনখোলা! ইছামতি-শঙ্খ-বিষখালি!
নানা নদীর বাঁকে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ খুঁজে পেলাম ময়ূর নামের একটি নদীকে। খুলনা মহানগরীর প্রান্ত ছুঁয়ে প্রবাহিত হয়ে রূপসা নদীর সাথে মিলিত হওয়া এই নদীটি আশা বাড়িয়ে দিল আমার। কেন জানি মনে হল মালঞ্চ নদী খুঁজে পাওয়া মূলত সময়ের ব্যাপার!
ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ থেকে সাতক্ষীরার জেলার কালিগঞ্জ উপজেলায় গেলাম। কাকশিয়ালি নামের একটা খরস্রোতা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে লোকালয়। বাসস্ট্যাণ্ডের পাশেই মাছের আড়ত। প্রখর বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন আড়তদার মো.আফসারের সাথে পরিচয় হল। তিনি বললেন সুন্দরবনের কথা।
কালিগঞ্জ থেকে খুব বেশী দূরে নয় সুন্দরবন! একবার ঘুরে গেলে মন্দ হয় না! ভাবনার সূত্র ধরেই চেপে বসলাম বাসে। কালিগঞ্জ পেছনে ফেলে শ্যামনগর। শ্যামনগর পেছনে ফেলে মুন্সিগঞ্জ।
মুন্সিগঞ্জ পৌঁছে থেমে গেল বাস। আমাদের নামতে হবে এখানেই। এরপর হাঁটতে হবে আবার।
কিন্তু সুন্দরবন কোথায়? সামনে দাঁড়ানো একজন ডাববিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম।
তিনি আঙুল তুলে নিস্পৃহ স্বরে বললেন, এইতো!
কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমি তাকালাম তার আঙুল নির্দেশিত দিকপ্রান্তে। একি! এ যে সত্যি! সত্যিই তো সুন্দরবন আমার দৃষ্টিপ্রত্যক্ষে! কী ভীষণ অপার্থিব ঔদাসীন্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দ্যসুন্দর বনটি!
বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের একটা স্বর্গীয় নদীও আছে সামনে!
সুন্দরবনের সাথে লোকালয়ের বিভাজন রেখা টেনে কি মৌনমুখরভাবে নদীটি বয়ে চলেছে অমরাবতীর দিকে! আবেগের আতিশয্যে প্রায় বাকরুদ্ধ আমি অস্ফুটস্বরে জানতে চাইলাম, কী নাম এই নদীর?
কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোন এক অচেনা গ্রহ থেকে যেন উত্তর ভেসে এল, 'মালঞ্চ'!
অভূতপূর্ব আনন্দে অবগাহন করতে করতে আমি আবিষ্কার করলাম, আমার বুকের ভেতর বসবাস করা মালঞ্চ নদীর চেয়ে বাস্তবের মালঞ্চ নদী অনেক বেশী রূপবতী, অনেক বেশী নান্দনিক, অনেক বেশী ঐশ্বর্যশালী!
ছবি: সংগৃহীত
২৬টি মন্তব্য
ইলিয়াস মাসুদ
কি যে অপুর্ব! মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে ফেল্লাম, অসাধারন লিখেছেন দীপদা অসাধারন, আমারো একটা নদী আছে,আপনার এত সুন্দর করে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই দাদা।
অনেক বার পড়লাম, পড়তেই মন চাইছে……. যেত বার পড়ছি কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছি….. (y)
দীপংকর চন্দ
কি যে বলেন!!
প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে প্রথম দেখায় বাস্তবের মালঞ্চ নদীর প্রেমে পড়ার স্মৃতি। যতটুকু দেখেছিলাম, যতটুকু স্পর্শ করেছিলাম প্রথমবার, বিরল সেই অনুভূতি প্রকাশ করার সাধ্য আমার মতো মানুষের থাকে না, থাকতে নেই সম্ভবত!!
উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞতা জানবেন কবি।
জানবেন আমার শুভকামনা। অনিঃশেষ।
অনেক ভালো থাকবেন। অনেক ভালো।
ইকবাল কবীর
ভাল লেগেছে দাদা লেখাটি। শুভ কমনা রইল আপনার জন্য।
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ অনেক। অনেক।
কৃতজ্ঞতা উপস্থিতিতে।
শুভকামনা থাকছেই বরাবরের মতো। অনিঃশেষ।
ভালো থাকবেন ভাই। অনেক ভালো। সবসময়।
ইকবাল কবীর
ভাল লেগেছে দাদা লেখাটি।
দীপংকর চন্দ
ভুলবশত মন্তব্য দুবার হয়েছে মনে হচ্ছে!!
কিন্তু মোছার নিয়ম তো জানিনা ভাই!!!
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন অজ্ঞতাকে।
শুভকামনা পুনরায়।
ব্লগার সজীব
অসাধারন, মালঞ্চ নদী উপখ্যান খুবই ভাল লেগেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত পঠন করলাম।
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ জানবেন ভাই। অনেক।
আপনাদের আন্তরিক ভালোবাসায় কতোটা যে আপ্লুত আমি, প্রকাশের ভাষা নেই!!
তাই কৃতজ্ঞতার কথা বলি।
শুভকামনার কথাও। বারবার।
অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক ভালো।
নীলাঞ্জনা নীলা
মন ভালো করে দেবার মতো একটি পোষ্ট। বহু বছর আগে সেই ১৯৯৬ সালে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম,
“প্রতিটি নিম্নবিত্ত মানুষের একটি নদী থাকে
মধ্যবিত্তের থাকে সমুদ্র
আর উচ্চবিত্তের পাহাড়।”
আমাদের সকলেরই একটি নদী থাকে আসলে।
দীপংকর চন্দ
//“প্রতিটি নিম্নবিত্ত মানুষের একটি নদী থাকে
মধ্যবিত্তের থাকে সমুদ্র
আর উচ্চবিত্তের পাহাড়।”//
মুগ্ধতা শব্দাবলীতে!!
কিন্তু আমি কি নিম্নবিত্ত!!! নাহ!! প্রায় বিত্তহীন সম্ভবত!!! আমার একটা পুকুর থাকলে মন্দ হতো না!!!
হা হা হা হা
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন সুলেখক।
ভালো থাকবেন। অনেক। সবসময়।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনি লেখক। লেখকরা হলো বিত্তবান।
দীপংকর চন্দ
হা হা হা হা
আরে না!!
লেখক হয়ে ওঠা কখনও হবেনা মেনে নিয়েই তো লেখার চেষ্টা সামান্য!
শুভকামনা নীলাঞ্জনা নীলা। পুনরায়।
জিসান শা ইকরাম
মালঞ্চ নামটি যেমন মিষ্টি, লেখাটিও তেমনি।
দীপংকর চন্দ
মালঞ্চ অসম্ভব সুন্দর একটি নদী আমার একান্ত দৃ্ষ্টিতে।
প্রথম দেখার অতিলৌকিক অভিজ্ঞতার কথা লেখার সাধ্য অন্তত আমার মতো সাধারণ মানুষের নেই জিসান ভাই।
উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞতা জানবেন।
জানবেন শুভকামনা। অনিঃশেষ।
অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক ভালো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অদ্ভুত সুন্দর করে একটি নদীর কাল্পনিক বর্ণনা প্রকাশ করলেন। মুগ্ধতা নিয়ে পড়লাম।
দীপংকর চন্দ
শ্রদ্ধা জানবেন সুলেখক।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা উপস্থিতিতে, পাঠে।
অনিঃশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক।
লীলাবতী
কল্পনা যখন বাস্তব হয়ে যায়, আমরা তখন ভাবনা প্রকাশে থেমে যাই। আপনি কিন্তু সফল ভাবেই আপনার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন দাদা ভাই। এত ভালো লেখায় কিভাবে মন্তব্য করবো বুঝতে পারছি না। মুগ্ধ পাঠ বললেও কম হয়ে যাবে।
ভালো লাগছে আপনার লেখা নিয়মিত পাচ্ছি। সময় দিচ্ছেন সোনেলায়। মন্তব্য দিয়ে উৎসাহিত করছেন অন্যদেরকে। ভালো একজন লেখকের উৎসাহ কতটা টনিকের মত কাজ করে আপনাকে তা বুঝায়ে বলতে পারবো না। এতে নতুন লেখকরা প্রেরণা পায়, লেখা ভালো করার চেষ্টা করেন।
শুভেচ্ছা আপনাকে দাদা ভাই -{@
দীপংকর চন্দ
//ভালো একজন লেখকের উৎসাহ কতটা টনিকের মত কাজ করে আপনাকে তা বুঝায়ে বলতে পারবো না।//
জ্বি। এই যেমন, আপনার মতো একজন ভালো লেখক, জনপ্রিয় লেখক আমার মতো একজন অভাজনের লেখার চেষ্টায় উৎসাহব্যঞ্জক উপস্থিতি রেখে যাচ্ছেন আন্তরিকভাবে, তা অবশ্যই ভীষণ অনুপ্রেরণাদায়ক।
কৃতজ্ঞতা এবং কৃতজ্ঞতা লীলাবতী।
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
উত্তর প্রদানে বিলম্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থণা।
ভালো থাকবেন। সবসময়।
অপার্থিব
সুন্দরবনটা এখনো দেখা হল না। সময় করে একবার ঘুরে আসতে হবে। লেখা ভাল লেগেছে।
দীপংকর চন্দ
ধন্যবাদ। অনেক। অনেক।
সময় করে ঘুরে আসার চেয়ে অসময়ে যদি ঘুরে আসেন, ভালো লাগার সম্ভাবনা বেশি।
অনেক অনেক ভালো লাগলো উপস্থিতি।
কৃতজ্ঞতা। অনেক।
আমার শুভকামনা জানবেন। অনিঃশেষ।
ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন উত্তর প্রদানের বিলম্ব।
সবসময় ভালো থাকবেন। অনেক।
খসড়া
আমার একটা নদী ছিল,
যা আমি একটি দ্বীপের বিনিময়ে দিয়ে দিয়েছিলাম।
দীপংকর চন্দ
হা হা হা হা
আমি কিন্তু বিনিময়ে যাবো না কখনও। নদী আর দ্বীপ দুটোই আমার চাই। কথা শেষ।
হা হা হা হা
উপস্থিতিতে কৃতজ্ঞতা অনেক।
উত্তরের বিলম্বের জন্য ক্ষমাপ্রার্থণা।
শুভকামনা। অনিঃশেষ।
মোঃ মজিবর রহমান
নদী আপনার ব্যাখ্যাতেই অসাধারন
সুন্দর একটি লেখা দাদা।
দীপংকর চন্দ
পাঠকের আন্তরিক ভালোবাসাই যে কোন সাধারণ লেখায় আরোপ করে অসাধারণত্ব!
ভালোবাসার প্রতি কৃতজ্ঞতা ভাই।
আমার শুভকামনা অনিঃশেষ জানবেন।
অনেক ভালো থাকবেন। সবসময়। অনেক ভালো।
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল থাকবেন।
-{@
দীপংকর চন্দ
পুনরায় উপস্থিতিতে শুভকামনা পুনরায় মজিবর ভাই।
ভালো থাকবেন। অনেক।