"তেল-ই- আমারনা" প্রাচীন মিশরের বিতর্কিত এবং বিপ্লবী ফ্যারো অ্যাখেনঅ্যাটেনের এক হারিয়ে যাওয়া রাজধানী

 

বিতর্কিত ফ্যারো অ্যাখেনঅ্যাটেন  মিশরের প্রচলিত দেবদেবীর ধর্ম বাদ দিয়ে এক দেবতা এটেনের উপাসনা করার ধর্ম প্রচলিত করেন। তা বাস্তবায়িত করার জন্য  তিনি থিবস থেকে সরে  এসে নীলনদের পাশে নুতুন রাজধানী গোড়ে তুলেন ।

যা কিনা 'আমারনা'  বলে প্রচলিত।প্রাচীন মিশরের যতো স্থাপনা,  মনুমেন্ট,মন্দির আছে তার মধ্যে আমারনা একটি গুরুত্ব পূর্ণ ।কারন এখানে তাদের জীবনকালের একটি অধ্যায় অতিবাহিত হয়েছে । যেখান থেকে অনেক ইনফরমেসান পাওয়া যায় যা তাদের সম্বন্ধে জানার একটা দরজা খুলে দায়।

'আমারনা' অ্যাখেনঅ্যাটেনের রাজধানী জুড়ে  প্রাচীন মনুমেন্ট,টেম্পেল,স্তেলা ছড়িয়ে আছে,তারা যেন বলছে আমরাকে আবিষ্কার করো । আরকেওলজিসস্টের  কাজ এই না জানা বিষয়  গুলো এবং তার পেছনের গল্প উদ্ধার করা।উন্মোচন করা কে,কেন এবং কি এর উত্তর ।

অ্যাখেনঅ্যাটেন  বিখ্যাত হয়ে আছেন তার সমলচিতো বিতর্কিত নুতুন ধর্মের প্রবর্তনের জন্য।যার জন্য তিনি বিতর্কিত এবং তাকে বিপ্লবী বলা হয়।

এই আমারনা নিয়ে জানার আগ্রহী তারা,  যারা কিনা  প্রাচীন মিশর নিয়ে যানতে চাই এবং ইজিপ্টলজিসট এবং আরকেওলজিস্ট তো তার সাথে আছেই।

এখন পর্যন্ত এখানে খনন কার্জ চলছে এবং অনেক গোপন রহস্য আমাদের কাছে উন্মোচিত হচ্ছে।

'আমারনা' ক্যাপিটালের ম্যাপ'

আমারনা অ্যাখেনঅ্যাটেন  এর রাজধানীঃ

১৮ ডাইনেষষ্টি প্রাচীন মিশরীয় ইতিহাসে সবচেয়ে শৌর্জবির্জের তুঙ্গে থাকা একটি সময়কাল। এই সময়ে বেশ কিছু শক্তিশালী শাসক বের হয়ে আসে ,কিন্তু সে সময়ে সবচেয়ে কুখ্যাত ফ্যারো এখেনএটেনের শাসন কাল ছিল। প্রচলিতো ধর্ম পরিত্যগের জন্য তিনি জনগণের বিরুদ্ধে  চলে যান । সময়টা ছিল ১৩৫০ BCE। তার শাসনকাল ছিল ১৭ বছর।

পুরো আমারনা জুড়ে দেখা যায় মন্দির,প্যালেস, নোবেল ম্যানদের আবাসস্থল,ফ্যারোদের কবর এবং দেয়াল জুড়ে পারিবারিক ক্রন্দন রত ছবি, মন্দিরে তার ছয় মেয়ে এবং তার রানী নেফারতিতির ছবি। ওয়ার্কম্যান  ভিলেজ এবং তাদের কবরস্থল।

তিনি তার রাজধানী কে নামকরণ করেন 'এখ্যেটাটেন' । তার মৃত্যুর পর এই রাজধানী মৃত্যুপুরী তে রুপান্তরিত হয়। বিল্ডিং এর ইটপাথর হরেনহেব (সেনা প্রধান)  সরিয়ে নিয়ে অন্য প্রজেক্টে দিয়ে দায়। স্থানীয় লোকজন এর গুরুত্ব বুঝতে না পারায় সেখানে বসবাস শুরু করে। এবং ১৮২৭ সালে  কৃষিকাজ করতে গিয়েই সেই বিখ্যাত চিঠি পায় যা থেকে জানা যায় শাসন আমলের অনেক তথ্য ।

আমারনাকে খুঁজে পাওয়া

আমারনা প্রথম দৃষ্টি গোচরে আসে যখন 18th সেঞ্চুরিতে নেপলিয়ান যখন এখানে খনন কার্জে আসে। আমারনায়  তিনি রয়্যাল কবর পান কিন্তু সেখানে কোনো মৃতদেহ ছিলনা ছিল দেয়ালে আঁকা তাদের ছবি,তাদের নাম,কখন এবং কে মৃত্যু বরন করেছে আর ক্রন্দনরত তাদের পরিবার।

আমারনা অনেকবার আরকেওলজিস্ট দের খনন কার্জের আওতায় আসে। ১৯১১ সালে প্রথম খনন কার্জ চালায় Dentsche Orient Gesell Schot । তারপর ১৯২১-১৯৩৬ সাল পর্যন্ত Egypt Exploration Society এখানে খনন কার্জ চালান তারপরে  ১৯৬০ সালে Egyptian Antiquities Organization  গবেষণায় আসে । ১৯৭৭ সালে তারা আবার গবেষণায় আসে যা এখন পর্যন্ত চলমান ।

আমারনার অবস্থান

নীল নদের পূর্ব পাশে ১৩৫০ BC তে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন হয় এবং এর  ২০ বছর পর পরত্যাক্ত হয়। আনুমানিক  অধিবাসী ছিল ২০-থেকে ৫০  হাজার।সীমানা দেখানোর জন্য ১৪ টি ট্যাবলেট নদীর দুই পাস এবং পাহাড়ের চুড়া সহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত আছে। এর মধ্যে ভিলেজ এবং কৃষিজমিও ছিল । এই স্তেলা গুলোর মধ্যে স্তেলা U সবচেয়ে চিত্যাকর্ষক । যাকিনা ৭.৬ মিটার লম্বা। প্রত্যেক স্তেলায় পাথর কেটে পুরো পরিবারকে নাম সহ দেখা যায়।  আমারনা সিটির  দৈর্ঘ্য ৩৬৫ মাইল এবং প্রস্থ ৫ কিলমিটার ।

স্থাপনা

নর্থ প্যালেস বা প্যালেস অব নেফারতিতি

এটি একটি বিরাট বিল্ডিং কমপ্লেক্স যেখানে রয়্যাল পরিবার বাস করতো এই প্যালেসে বাগান এবং রিসেপসান রুম ছিল । প্রত্যেক রুমে জানালা ছিল যেখান থেকে বাগান দেখা যেতো এবং বাগান থেকে  ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে প্রবেশ করতো । প্রত্যেক রুমে ডেকোরেসান করা টাইলস থেকে প্রমান মিলে কি ভাবে ডেকোরেসান করা ছিল । প্রাপ্ত টাইলস থেকে বোঝা যায় কোনটার কি ব্যাবহার। । নর্থ প্যালেসটি প্রধান রানী নেফারতিতির জন্য এবং পরে তার প্রিন্সেস মেরেটাটেন অবস্থান করতো ।

কবরস্থান ( necropolises)

রয়্যাল টুম্ব

রয়্যাল টুম্ব,  থিবসের ভ্যালি অব দি কিং এর মতো ডেকোরেসান করা নয় হয়তো  ধর্ম আলাদা হওয়ার জন্য।সেখানে তাদের পুরানো দেবদেবীর  ছবিও ছিলনা।   রকের কোয়ালিটি ভালো না থাকার জন্য জিপ্সান প্লাস্টার দ্বারা  প্লাস্টার করা হয়। এখানে রাজা এবং কুইন টিয়া ( Tiy) এর কবর ছিল এবং আনফিনিসড আরও দুটো কবর ছিল  নেফারতিতি এবং প্রিন্সেস  মেরেতাতেন এর জন্য।

এছাড়া পাহাড়ের ক্লিফকে  ভিত্তি  করে প্রায় ২৫ টির  বেশী  কবর পাওয়া গেছে যা কিনা ৮৫ মিটার উঁচুতে । প্রত্যেক কবরে তাদের নাম , স্ট্যাচু এবং পদের পরিচয় আছে।

সেন্ট্রাল সিটি

এই সেই লেটার যা  আমারনায় পাওয়া যায়

সেন্ট্রাল সিটি ছিল গোছানো । সেখান থেকেই শাষন কাজ চালানো হতো । এর কাছেই ১৮৮৮ সালে একজন মহিলা কৃষক কৃষি কাজ করতে গিয়ে উদ্ধার করেন 'আমারনা লেটার ' যে  লেটার গুলোতে ছিল  শাসন কাজ এবং ডিপ্লোম্যাসি কলাকানুন । এখানে রাজা ব্যাতিত অন্যান্য গুরুত্ব পুর্ন ব্যাক্তিদের কোয়াটার পাওয়া যায় । তারা হলেন ভাইজার নাখত প্রিস্ট প্যানেসি, প্রিস্ট পাওয়াক ,জেনারেল রামসে ,আর্কিটেকট মানেখতাওিফ এবং স্কাল্পচার থাতমসে thutmose

স্কাল্পচার থাতমসের ওয়ার্কশপ থেকেই নেফারতিতির আবক্ষ মূর্তিটি পাওয়া গেছে ।

র‍্যামেসেস ৩ এর সময়ে ও এখানে তারা বসবাস করতো এবং কাজ চালাত ।

দি  স্মল টেম্পেল অফ দি  এটন (Aton)

সাম্প্রতিক সময়ে এটেন টেম্পেলের পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। এর কাছে মাড ব্রিক দিয়ে তৈরি একটি ছোটো প্যালেস আছে , যেখানে রাজার পরিবার সম্ভবত  নর্থ প্যালেস থেকে এসে ভিজিট কোরতে  এসে থাকতেন । সেখানে শস্য রাখার সাইলেজও পাওয়া যায়। এখেনএটেনের টেম্পেল যেমন গ্রেট টেম্পেল বা স্মল টেম্পেল এর প্ল্যান প্রাচীন মিশরের প্রচলিত টেম্পেলের মতো নয়। সব স্থানেই সান গডের উপাসনা করার ছবি আঁকা ।

ওয়ার্ক ম্যান ভিলেজ

সাম্প্রতিক সময়ে আরকেওলজিস্ট রা খুঁজে পান একটি স্যাটেলমেন্ট এবং তাদের কবর। তাদের ব্যাবহ্রিত তৈজসপত্র এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে। কবরের মৃতদেহ গুলোর মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয়প্রাপ্ত এবং অল্প বয়স যা  প্রমান করে অতিরিক্ত বোঝা টানা হয়েছিল তারাকে দিয়ে।খুব অল্প সময়ে শহর গোড়ে তুলার জন্য শ্রমিকদের উপরে পরিশ্রমের চাপ পড়ে।

এখেনএটেন এর পরিবারের শেষ পরিনিতিঃ

অ্যাখেনঅ্যাটেনর  পরিবার

নেফারতিতি,  অ্যাখেন অ্যাটেনের  প্রধান রানী হোলেও তার পুত্র তুতেনখামন  নেফারতিতির পুত্র নয় । তুতেনখামনের মা হল  'কিয়া' । আর তিনি  অ্যাখেনঅ্যাটেনের   বোন , কারন সে  সময় রয়্যাল পরিবারে বোনের সাথেও বিয়ে হতো কিন্তু  তা সাধারণ পরিবারে হতোনা । কারন রয়্যাল ব্লাড রাখার জন্য এই প্রথা চালু ছিল ।

অ্যাখেনঅ্যাটেনের এবং নেফারতিতির ছয় মেয়ে । তারা হলেন ১) মেরে তাতেন ২) মেফে তাতেন ৩) এঙ্কেসেনাপ্যাতেন ৪) নেফেরফেরুএতেন টাসহেরিত ৫) নেফেরনেফেরুরে ৬) সেটে পেনার

ধারনা করা হয় , অ্যাখেনঅ্যাটেনের  সাকসেসর ফ্যারো smenkhkare মেরেতাতেনের স্বামী। আবার একটা Inscription পাওয়া যায় মেরে তাতেন এবং জুনিয়র মেরে তাতেন tasherit এবং সিনারি তারিখ অ্যাখেনেটেনের  সময় কাল অর্থাৎ এই মেয়েটি তার বাবার ওয়রসজাত ।

অ্যাখেনঅ্যাটেনের  মৃত্যুর পর ঠিক কি হয়েছিল এবং কে রাজত্ব করেছিল তা ধোঁয়াসে। এবং একেক আরকেওলজিসট একেক ব্যাখ্যা দায় ।

মোটামুটি ভাবে বলা যায় অ্যাখেন অ্যাটেনের শাসন কাল ১৭ বছর , Ankhkheeperure Neferneferuaten ২ বছর

Ankhkheperure Smenkhkare ২ বছর Tutankhamon ৯ বছর, Ay ৪ বছর, Horemheb ১৪ বছর।

তুতানখামনের আগের দুইজন সাকসেসর নারী । সম্ভবত সে ছিল মেরে তাতেন । কেউ কেউ বলেন নেফারতিতি । তবে গবেষণা করে  দেখা গেছে তুতেন খামনের কবরটি তার ছিলনা ছিল মেরেতাতেনের । সেখানে মেরেতাতেন নাম কারতুসের মধ্যে  লেখা একটা বাক্স পাওয়া গেছে, এল্যাবাস্তারের জার যেখানে তুতেন খামনের অরগ্যান ছিল তা দেখতে মেয়ের মতো। একটা জুয়েলারি ব্রেসলেটে  মেরেতাতেনের নাম লেখা ছিল, একটা কফিন বাক্সের মাস্ক একজন নারীর মতো, একটি স্ট্যাচু ১৫/১৬ বছোর    বয়েসি  ফিমেল ফিগারের মতো। যা  কিনা মেরেতাতেনের বয়সের সমান।

অনেকের ধারনা তুতেন খামনের বয়স কম ( ৪ বছর ) থাকার জন্য মেরেতাতেন সাকসেসর হয়েছিলেন রয়্যাল ওয়াইফ হিসেবে । তারপর সে সরে গিয়ে তুতেন খামন কে ক্ষমতা  দিয়ে দেন এবং তার কবরটিও তাকে দিয়ে তিনি অন্য কোনো স্থানে সমাহিত হন । তবে কোথায় কেউ জানেনা।

অ্যাখেন অ্যাটেনের শাসনকালে সম্ভবত প্লেগে আক্রান্ত হয়ে তার তিন কন্যা মারা যায়। সম্ভবত নেফারতিতি  মারা যায় প্লেগে। তবে তার কবর কোথাও পাওয়া যায়নি।

মেরে তেতান অ্যাখেন অ্যাতেনের মৃত্যুর পর মেরেতাতেন তার বাবার ধর্ম পরিত্যাগ করে  থিবসে চলে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন সবার মৃতদেহ এবং তার দাদা এমেনহতেপ ৩ এর কবরে তাদেরকে রাখেন। আমারনার গ্রেট টেম্মেল   ধ্বংস করা হয়  এবং অ্যাখেন অ্যাটেন এর  সমস্ত চিহ্ন নষ্ট করা হয়।

তৃতীয় কন্যা এঙ্কেসুনামেনের সাথে তুতানখামনের  বিয়ে হয় কিন্তু তুতেন খামনের  মৃত্যুর পর  তার কি হয়েছিল কেউ জানেনা।

একটা আংটি প্রমান করে যে কিং টাট মৃত্যু বরন করলে সিংহাসনে  বসে নেফারতিতির বাবা অ্যায় (AY) ।একটা আংটি পাওয়া গেছে যেখান আঙ্কেয়সেনামুন এবং অ্যায় ( ay ) এর নাম ছিল এবং এ থেকে বোঝা যায় সে ক্ষমতায় যাওয়ার পর  আংকেসুনামনের সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো। তার বয়স  সে সময়ে সত্তুর বছরের উপরে ছিল । আংকেসুনামনের বয়স মাত্র ২২/২৩ ।অর্থাৎ একবার নানার সাথে ,একবার সৎ ভাই এবং খুব সম্ভবতো  তার  বাবার সাথেও তাকে বিয়ে করতে  হয়।

এঙ্কেসুনামেনের  ১৩২৫-১৩২১ BC সালের মধ্যে তাকে আর কোথাও  দেখা যায়নি । আরকেওলজিসট রা তাকে 'Lost Prinsses' বলে আখ্যায়িত করেন।

শুধু মাত্র রয়্যাল ব্লাড রাখার জন্য ভাই বোন বিয়ে বা হাফ সিস্টার বিয়ের  কারনে এই ডাইনেসটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তুতেন খামন নিজেও দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন এবং তার সন্তানরাও অকাল মৃত্যুকে বরন করে,  হয়তো একই পরিবারে বিয়ে করার এই পরিনতি ।

এই ছিল অ্যাখেনঅ্যাটেনের পরিবারের শেষ পরিনাম  ।

তথ্য সূত্রঃ

Middle Egypt Survey Project

Kemp Barry ,The City Pf Akhenatenan and Nefertiti

Norwich,john Julius ,Cities That Shapel the world

Amarna National Geographic Search ,National Geographic

Kimberly Graf Anthropologe

Middle Egypt Survey Project

Photo Wikipedia

লেখক ও গবেষকঃ হুসনুন নাহার নার্গিস ,লন্ডন

ইতিহাস ও ঐতিহ্য , প্রবন্ধ

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Shares

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ