আজব ঠোঁটের পানিকাটা

শামীম চৌধুরী ১১ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ০২:৫৪:০২পূর্বাহ্ন পরিবেশ ২০ মন্তব্য

পাখির ছবি তোলার শুরুর পর থেকে নানান প্রজাতির পাখি দেখেছি। একেক পাখির একেক রকম বৈশিষ্ট্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার ফটোগ্রাফি লাইফে এটি বড় একটি অর্জন। আমার কাছে পাখির ছবি তোলার চেয়ে, খালি চোখে পাখি দেখার আনন্দ বেশি মনে হয়। নানান বর্ণিল রঙে পাখির পালক সুসজ্জিত থাকে। কারো সঙ্গে কারো রঙের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও এখনও অনেক পাখি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে যতগুলো দেখেছি তাতে সুখ ও শান্তি খুঁজে পেয়েছি। প্রকৃতির সৌন্দর্যই হচ্ছে বন্যপ্রাণী ও পাখি। এদের মধ্যে আবার কিছু পাখি আছে জলচর। বৃক্ষচারী পাখি ও জলচর পাখির বৈশিষ্ট্য ও স্বভাব ভিন্নতর। তেমনি একটি পাখি হচ্ছে পানিকাটা।

পানিকাটা পাখি Rynchops পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মাঝারি আকারের জলচর সামুদ্রিক পাখি। পাখিটির দেহের দৈর্ঘ্য ৪০ সে.মি.। আজব ঠোঁটের পাখি এই পানিকাটা। এদের ঠোঁটের দৈর্ঘ্য দুই ভাগে বিভক্ত। নিচের ঠোঁট ধারালো চাকুর মতো এবং উপরের ঠোঁটের চেয়ে অনেক বড়। পানির উপর ভেসে ভেসে সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটার সময় নিচের ঠোঁট দিয়ে পানি কাটতে থাকে এবং সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ঠিক সেই সময় কোনো খাদ্যবস্তু বা মাছ নিচের ঠোঁটের নাগালে পড়লেই উপরের ঠোঁট দিয়ে সাড়াশির মতো চেপে ধরে।

এদের পিঠের রং কালচে বাদামী। দেহের নিচের অংশ ধবধবে সাদা। কপাল ও গলা সাদা। ডানার অগ্রভাগ ছাড়া ঘাড়ের পেছন দিক, কাঁধ ডানা ও লেজ সব কালো। চোখ বাদামী বর্ণের এবং ঠোঁট দুটি হলুদ-কমলা বর্ণের। ঠোঁটের গোড়া উজ্জ্বল লাল এবং অগ্রভাগ হলুদ; পা ছোট। পায়ের পাতা উজ্জ্বল দাগাঙ্কিত। প্রজননের সময় এদের পিঠ উজ্জ্বল বাদামী বর্ণ ধারণ করে। এমনিতে পিঠ অনুজ্জ্বল থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির ঠোঁটের অগ্রভাগ অনুজ্জ্বল কমলা বর্ণের।

এরা নদী বা সমুদ্রের পানির সামান্য উপর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। ওড়ার সময় মাঝে মাঝে পানিতে ঠোঁট ডুবিয়ে পানি কাটে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কোনো মাছ শিকারের জন্য হয়তো পানিতে ঠোঁট ডুবিয়েছে। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে প্রধানত পানির উপর ভেসে বেড়ানো ছোট ছোট মাছ। খুব ভোরে এবং সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে এরা খাদ্য সংগ্রহ করার জন্য খুবই কর্মচঞ্চল থাকে। একমাত্র পানিকাটা পাখি জোৎস্না রাতে খাবার সংগ্রহ করে। এদের ডাক তেমন সুরেলা মধুর নয়। ক্যাৎ ক্যাৎ শব্দে ডাকতে শোনা যায়।

পানিকাটা পাখি বড় নদী, মোহনা ও উপকূলে বিচরণ করে। এরা দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তবে মাঝে মাঝে দলছুট হয়ে একাকীও চলাফেরা করে। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এদের প্রজনন সময়। প্রজননকালে এরা দলে দলে নদীর চরে বালুতে গজে ওঠা ঘাস বা লতাপাতার পাশে বালু খুঁড়ে বাসা বানায়। একসাথে অনেকগুলো জোড়া পানিকাটা পাখি মিলিত হয়ে বালু চরে নিজেদের বানানো বাসায় ডিম পাড়ে। প্রতিটি মেয়েপাখি একসঙ্গে ৩-৪টি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়েপাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। মানুষের পায়ের চাপে এদের ডিম নষ্ট হয়ে থাকে। তাছাড়া সাপ, গুইসাপ ও কুকুর জাতীয় প্রাণীও এদের বংশবিস্তারে হুমকির কারণ।

পানিকাটা পাখি আমাদের দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। ভোলার মনপুরা, হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপের দমার চর, মহেশখালির সোনাদিয়া দ্বীপ, রাজশাহীর পদ্মার চর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নদীতে বা উপকূলে শীত মৌসুমে এদের দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমার ও এশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এদের দেখা  যায়। জানা যায় শীত মৌসুমে পরিযায়ী পানিকাটা পাখি আমাদের দেশের আবাসিক পানিকাটা পাখির সঙ্গে মিলে মাসচারেক বিচরণ করে। পানিকাটা পাখি বিশ্বে সংকটাপন্ন ও আমাদের দেশে বিপন্ন। স্বাধীন বা মুক্তভাবে এদের প্রজননে সহায়তা করলে হয়তো এরা বংশবৃদ্ধিতে সচেষ্ট হতে পারবে। অদূর ভবিষ্যতে বিপন্ন পাখির তালিকা থেকেও বেঁচে যাবে।

বাংলা নাম: পানিকাটা

ইংরেজি নাম: Indian Skimmer

বৈজ্ঞানিক নাম: Rynchops albicollis

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ