অভিসারিণী

গোধূলি ৪ অক্টোবর ২০১৪, শনিবার, ০৯:১৮:৪৫অপরাহ্ন গল্প ৫৭ মন্তব্য

ঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। রাজ্য ঘুমাচ্ছে। এই একটা ছুটির দিনে সারাদিন বিছানাতেই পড়ে থাকে রাজ্য। অহনা বারান্দায় চেয়ারে বসে বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টির ছাট এসে এসে মুখে লাগছে। সেলফোন বেজে উঠলো অহনার। অহনা ফোন ধরে বলল, “হ্যালো”

ওপাশ থেকে বলল, “হ্যালো। কেমন আছিস, অহো?”

“ভালো। তুই?”

“ভালো”

“আজ তোর শ্যুটিং নেই?”

“তুই কি কোন খোঁজই রাখিসা না? আপাতত কোন প্রজেক্ট হাতে নেই নি।”

“ও”

“বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে”

“হুম”

“তোর কি মনে আছে?”

“কি?”

“তুই একদিন বৃষ্টিতে ভিজতে চেয়েছিলি?”

“হুম। তুই রাজী হোস নি। ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়াতে বসে কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছিলি আর লেকচার কপি করছিলি।”

“কেন রাজী হই নি জানিস?”

“কেন?”

“ঐ দিন তুই সাদা রঙের ড্রেস পরেছিলি।”

“তোর হঠাৎ সেদিনের কথা মনে পড়ল!”

“আজ বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে।”

“তো ভেজ না। কে বাঁধা দিয়েছে?”

“তোর সাথে। কিন্তু তুই তো নেই। তোর কি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে না?”

অহনা গ্রিলের মধ্য দিয়ে বাইরে তাকালো। কোন উত্তর দিল না।

অপু আবার বলল, “তোর কি বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে না?”

“জানি না। বড় হয়ে গেছি। এখন বৃষ্টি দেখলে আগের মত আবেগ কাজ করে না। মনে হয়, চ্যাপচ্যাপা কাদার কথা, উনার কাদালাগা প্যান্টের কথা। মনে হয়, কখন থামবে বৃষ্টি?”

“এতো বদলে গেলি কেন, অহো?”

“‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ পড়িস নি? মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারনে অকারণে বদলায়।”

“হুম”

“অপু, আজ রাখিরে। পড়ে কথা হবে। Bye.”

অহনা খেয়াল করলো, সে আজও সাদা রঙের একটি শাড়ি পরে আছে। সাদার উপর লাল, সবুজ ও কালো রঙের নকশা।

অহনা বারান্দা থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো রাজ্যকে। কি অসহায়ভাবে ঘুমাচ্ছে লোকটা। অহনা বিছানার কাছে দাঁড়ালো। রাজ্য নাক ডেকেই চলেছে। অহনা রাজ্যের পাশে বসে আলতো করে ধাক্কা দিল রাজ্যকে। বলল, “উঠুন। আর কতক্ষণ ঘুমোবেন?”

রাজ্য চোখ মেলে তাকাল। তারপর মৃদু হাসি দিয়ে হেঁচকা টান দিয়ে অহনাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর অহনাকে জড়িয়ে অহনার পিঠে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, “তুমিও ঘুমোও না আমার সাথে।”

“এভাবে নাক ডাকলে কেউ ঘুমোতে পারে?”

“এতদিনে তো অভ্যাস হয়ে যাওয়া উচিৎ। যেসব স্বামীরা নাক ডাকে, তারা বউকে অনেক বেশি ভালোবাসে। ঘুমোও তো।” ক্ষনিকবাদেই নাক ডাকতে আরম্ভ করল রাজ্য।

অহনা কোমরের কাছে থেকে রাজ্যের হাতটা ঠেলা মেরে সরিয়ে উঠে পড়ল। বলল, “ধ্যাৎ। খালি মরার মত পড়ে পড়ে ঘুমোয়।”

রাজ্য চোখটা হাল্কা মেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

 

অহনা ওয়ারড্রব খুলে শাড়ি দেখতে লাগলো। তারপর গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা টেনে বের করল। শাড়িটার উপর কালো ও রুপালি সুতো দিয়ে কাজ করা। সাদা শাড়িটা বদলে গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা পরল, সাথে কালো রঙের ব্লাউজ। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টেনে টেনে চোখে কাজল দিল। বড় গাঢ় নীল রঙের একটা টিপ পরল কপালে।

তারপর চা বানিয়ে বিছানার পাশের টি-টেবিলে রাখল। আস্তে করে রাজ্যর কানের কাছে বলল, “এই, শুনছেন? চা বানিয়ে এনেছি।” তারপর রাজ্যর মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল।

রাজ্য কোনমতে উঠে বসল। বলল, “আচ্ছা, দাও, চা দাও।”

চায়ে চুমুক দিল রাজ্য। অহনা বলল, “আপনি কি আরো ঘুমোবেন?”

“কেন?”

“না, এমনি।”

“তুমি কি বাইরে যাচ্ছ?”

“না। তবে যেতে তো ইচ্ছে করে। ছুটির দিনে সবাই প্রিয়জনের সাথে এদিকওদিক যায়। আমার স্বামী নাক ডাকলেও সেই সৌভাগ্য আমার নেই।”

“স্বামী ভালবাসলেই যে রমণী সৌভাগ্যবতী হবে- এমন কোন কথা আছে? জানো, রাজা অডিসিউসের জন্য তার ওয়াইফ পেনেলপে কত বছর অপেক্ষা করেছিল?”

“জানতে চাইও না।”

“আহা, শোনো না। যখন রাজা অডিসিউস নিরুদ্দেশ, তখন প্রজারা রানী পেনেলপেকে চাপ দিচ্ছিল বিয়ে করার জন্য যাতে রাজাহীন রাজ্য আর রাজাশুন্য না থাকে। তখন রানী প্রজাদের বলেন, ‘আমি উল দিয়ে যে বুননকর্ম করছি সেটা শেষ হতেই আমি বিয়ে করব। প্রতিদিন যতটুকু বুনতেন, রাতে ততটুকুই খুলে ফেলতেন। এভাবে অপেক্ষা করতেন কবে ফিরে আসবেন তার প্রিয়তম স্বামী।”

“তার মানে আমি সারা সপ্তাহ জুড়ে উল বুনবো, শুক্রবার আসতেই খুলে ফেলব। তাই তো?”

“থাক। তুমি আমার কথার মর্মার্থ বুঝবে না। তা শাড়ি বদলেছো কেন?”

“আমি তো শাড়ি বদলাই নি। এটাই পরেছিলাম।”

“উহু, তুমি সাদা রঙের ঐ শাড়িটা (আলনার দিকে আঙুল উঁচিয়ে) পরেছিলে।”

“তাও ভালো। একটু হলেও খেয়াল করেন আমাকে। বলুন তো, আমি এখন কি রঙের শাড়ি পরেছি?”

“নীল, more specifically royal blue। আর এই শাড়িকে বলে মেঘডম্বর শাড়ি।”

“কানাইয়ের বাঁশীর সুরের আবেশে উন্মত্তা রাধা বর্ষার রাতে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি অভিসারের জন্য বের হতো যাতে রাতের অন্ধকারের সাথে তাকে পার্থক্য করা না যায়। বৃষ্টির শব্দের সাথে রাধার পায়ের নূপুরের নিক্বণ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত।”

“Significance কি? তুমিও অভিসারে যেতে চাও? তাহলে ঢাকার বাইরে পোস্টিং নেই, কি বলো। তুমি যাবে রাতের ট্রেনে আমার সাথে দেখা করতে।”

“ধ্যাৎ। মুডটাই মাটি হয়ে গেল। ঘুমোন, ঘুমোন আর ভুঁড়িটা আরো বাড়ুক।” বলেই অহনা চায়ের কাপ রেখে বারান্দায় চলে এল। রাগে ফুঁসতে লাগলো। এই লোকটিই বিয়ের আগে দেখা করতে এসে বলেছিল, ‘যাদের ঠোঁটে তিল থাকে,তাদের প্রেম করে বিয়ে হয় শুনেছি। আপনি বললে আপনার সাথে কয়েক মাস চুটিয়ে প্রেম করতে পারি’। ভন্ড কথাকার, এই লোকটাকে বিয়ে করাই ভুল হয়েছে। লোকটা জানে শুধু মেয়েপটানো কথা বলতে। গ্রিলের মধ্য দিয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগলো অহনা। বৃষ্টি অবিরত পড়ছেই।

 

অহনা গ্রিলের মধ্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানির ছোঁয়া নিল। এমনসময় অহনা অনুভব করল, একজোড়া হাত ওর কোমর বেষ্টন করলো। তারপর অহনার কাঁধের কাছে নাক ঘষতে লাগলো। বলল, “চল, বৃষ্টিতে ভিজি।”

অহনা ফিরে তাকালো। সাথে সাথে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট স্পর্শ করল রাজ্য। বলল, “কি ভিজবে না?”

“আপনি হিমু হয়ে এসেছেন কেন?”

“আমি তো এটা পরেই ঘুমুচ্ছিলাম।”

অহনা হেসে দিল। বলল, “হুম। নাটক করা হচ্ছে?”

“তোমার মত অভিনেত্রীর কাছে আমার অভিনয় তো তুচ্ছ।”

“এতো পাঞ্জাবী থাকতে হলদেটাই কেন? আপনি এতো হুমায়ূনভক্ত তাতো জানতাম না”

“উহু, এটা হলদে নয়।”

“পীত রঙ”

“পীত রঙ?”

“রাধে, তুমি অভিসারে যেতে চাও, আর প্রেমিকের বসনের রঙ জানো না?”

“মানে?”

“মানে কৃষ্ণ পীত রঙের ধুতি পরতেন। আমার না আছে পীত রঙের ধুতি, না আছে লুঙ্গি। কোন পাজামাও নেই। টিশার্ট একটা আছে অবশ্য।

কিন্তু রাধে পরবে শাড়ি, আর কানু পরবে টিশার্ট। How funny! তাই পাঞ্জাবীটা পরলাম।”

অহনা হাসতে লাগলো।

রাজ্য বলল, “আমার কি মনে হয় জানো?”

“কি?”

“হুমায়ূন আহমেদ পীতাম্বর শ্রীকৃষ্ণ ও নীলাম্বরী রাধা থেকেই হয়ত হলুদ হিমু ও নীল শাড়ি পরিহিতা রুপার কনসেপ্ট তৈরি করেছেন। আবার রাধার মতই রুপার অপেক্ষাও শেষ হবার নয়।”

“হুম। কি জানি? আপনি কি এতক্ষন ধরে হলুদ I mean পীত রঙের জামা খুঁজছিলেন?”

“কি করবো বল? তুমি তো উল বুনতে রাজীই হলে না...”

 

বিঃ দ্রঃ অহনা, অপু ও রাজ্যকে নিয়ে লেখা আরো দুটি গল্প-

"অহো-কথা"
"খণ্ডিতা"

এবং অপুকে নিয়ে গল্প-
"প্লট"

0 Shares

৫৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ