অবন্তিকা – ১

অনন্য অর্ণব ১ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার, ১০:০০:৫৬পূর্বাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সন্ধ্যাটা যখন একঘেঁয়ে রাতের অন্ধকারে পদার্পণ করে তখনো দিনের আলোর কিছু লালচে আভা আকাশকে রাঙিয়ে রাখে। অনেকটা প্রৌঢ়া রমনীর ভাঁজ পড়া ঠোঁটে উজ্জ্বল লিপিস্টিকের মতো, যা কেবল পুরনো অভ্যাসের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে কিন্তু কোন সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা তাগড়া যুবকের দৃষ্টি কাড়ে না।

চল্লিশ ছুঁই ছুঁই অবন্তিকার বয়সটা যেনো তার চলমান সময়ের চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে গেছে। চোখের নীচে ভাঁজ পড়া কপোলটাকে যতই কৃত্রিম প্রসাধনে আচ্ছাদিত করুক না কেন, বয়সী চোখের অস্পষ্ট আক্ষেপই বলে দেয় সে এখন আর ষোড়শী নেই। তবুও কি আপ্রাণ চেষ্টাই না সে করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত নিজেকে যৌবনাবতী করে তুলতে।

অবন্তিকা একজন উচ্চশিক্ষিত কর্পোরেট। মোটামুটি চলমান সচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে। তারপর কর্মজীবনের শুরু। একের পর এক কর্মস্থল পরিবর্তন করতে করতে পরিবর্তন টা যেনো তার জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য একটা অত্যাবশ্যক সূত্র হয়ে গেছে।

সৌমিকের সাথে যখন অবন্তিকার ছাড়াছাড়ি হয় তখন অবন্তিকা একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাউথ এশিয়ান রিজনের চীফ মার্কেটিং রিচার্স অফিসার। শিক্ষাগত যোগ্যতার দৌড়ে যতটা না পদায়িত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে ঐ কোম্পানির ইউরোপীয় সিইওর সাথে অবন্তিকার ব্যক্তিগত সখ্যতা। অবন্তিকা সৌমিক কে ছেড়ে দিয়েছিল কারণ সৌমিক জানতে পেরেছিলো অবন্তিকা তার ক্যারিয়ার কে পরিবারের চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে।

তারপর এ হাত ও হাত ধরে অবন্তিকা বহুদূরের পথে তার স্বপ্ন চরিতার্থ করার যথাযথ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। চলমান স্রোতে জীবন সঙ্গী বলতে যারা এসেছে তাদের অনেকেই লোকাল বাসের যাত্রীর মতো। একটা নির্দিষ্ট স্টপিজে এসে একজন নেমে সিট খালি করে দিয়েছে তো আরেকজন সেই আসন জুড়ে বসেছে। আর অবন্তিকা কেবল ছুটে চলেছে তার বহুদূরের গন্তব্যে।

সে জানতো তার জ্বালানী প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তবুও পুরনো ফার্নিচারে বার্ণিশ করার মতো প্রসাধনী মেখে নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অবন্তিকা। তারপর একদিন এক গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সন্ধ্যা শেষে চায়ের পেয়ালা হাতে অবন্তিকা তার হিসেবের খাতা খুলে দেখছিলো। তার এই চল্লিশ বছরের জীবনে পাওয়া না পাওয়া আর পেয়ে হারানোর সংখ্যাগুলো কতটা সামঞ্জস্য বহন করে।

কিন্তু ঠিক তখনই অবন্তিকার সেলফোনের মেইলবক্সে একটা মেসেজ আসে। প্রিয় অবন্তিকা আপনি আমাদের কোম্পানির এশিয়ান রিজনের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবে প্রাথমিক বাছাইপর্বে নির্বাচিত হয়েছেন। কোম্পানির চীফ ম্যানেজিং ডিরেক্টর আপনার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট কল করেছেন।
আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝি সিঙ্গাপুরের মারিয়ানা বে স্যান্ডস - হোটেলে আমরা আপনাকে স্বাগতম জানাতে পারি।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অবন্তিকা। দূরের আকাশে তখনো একটা অস্পষ্ট উজ্জ্বল জ্বলজ্বলে সন্ধ্যা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। অনতিদূরের মৎস্য খামারের পাশের ঝোপের ভেতর থেকে অভুক্ত শেয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ ভেসে আসছে। একটা হূতোম পেঁচা সামনের বিল্ডিং এর ছাদের কার্ণিশে বসে একাগ্রচিত্তে অবন্তিকার দিকে তাকিয়ে আছে। কে জানে ঐ পেঁচাটা হয়তো অবন্তিকার সদ্য বিদায়ী যৌবনের জরাজীর্ণতার স্বাক্ষী তার ম্রিয়মাণ খোলা বুকের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।

পেঁচাটার চোখে চোখ পড়তেই অবন্তিকা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সপ্রতিভ হয়ে ঘাড়ের উপর থেকে ওড়না টা টেনে বুকের উপর ছড়িয়ে দেয়। একটু মুচকি হেঁসে অবন্তিকা মনে মনে ভাবে কি জানি সিঙ্গাপুরের হোটেলে আবার কোন প্যাঁচা অপেক্ষা করছে ?

অনন্য অর্ণব
উত্তরা, ঢাকা।
১৪/০৭/২০১৯

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ