বেশ কিছুদিন যাবত এক অপ্রকৃতস্থ মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করে শেষমেশ তাঁর সাথে কথা বলার সাহস হলো। প্রথম যেদিন তাকে দেখলাম, দেখি ফুটপাতে এসে সে তার সংসার গুছানোর পায়তারা করছে। অফিস ট্র্যান্সপোর্টের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আমি। শীতের সোনাঝরা রোদে এক গাট্টি ময়লা কাপড়চোপড় খুলে ফুটপাতের অনেকাংশ জুরে একবার মেলে দিচ্ছে, আরেকবার তুলে নিচ্ছে। একটা কাঠের টুকরা, একটা ভাঙাচোরা হাতপাখা, দুরকমের দুখানা আধাছেড়া স্যান্ডেল, একটা প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া ফুলকপি, আরো কতো কি! আর সমানে আপনমনে কথা তো আছেই। এরই মধ্যে ট্র্যান্সপোর্ট চলে আসায় রওয়ানা আমি।
প্রায় প্রতিদিন অই পথ ধরেই আমার আসাযাওয়া। কোনদিন দেখা হয় আর কোনদিন তাঁর দেখা না পেয়ে সাজানো সংসারটাই খুটে খুটে দেখি। একদিকে একটা কাঠের টুকরা আর অন্যদিকে কয়েকটা ইট দিয়ে একটা শাড়ী প্যাঁচিয়ে একখানা ঘর মতো সে দাঁড় করিয়েছে। অন্যপাশে ফুটপাতের ওয়াল তো আছেই। তারমানে এখানেই সে বসতি গেড়েছে! ভেতরে উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। কেবল কয়েকটা ময়লা পানির বোতল উঁকি দিচ্ছে।
৫/৬ দিন পর একই নিয়মে তাঁর সংসার দেখছি, এমন সময় পেছন থেকে সে জানতে চায়, কিতা দেখ মাঁইয়ু? ভয়মিশ্রিত মনে চমকে উঠায় সে আশ্বস্ত করে। এরপর থেকেই দেখা হলে কমবেশি কথাবার্তা হতে থাকে। অনুভব করি, সে ষোলআনা অপ্রকৃতস্থ নয়। তবুও খুব বেশি কথা বলার সাহস পাই না তার বিব্রতকর মুভমেন্টের জন্য। কখনো চলন্ত গাড়ীর লোকদের ভয় দেখায়, কখনো তাদের দেখে হাসি বিনিময় করে, কখনো হাত দিয়ে মাইর দেখায়, খিলখিল করে হাসে।
আরেকদিন গিয়ে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে শব্দ এলো, কিমুন আছো মাঁইয়ু? দেখি সে ভেতরে শুয়ে আছে একটা কম্বল গায়ে। আমাকে দেখেই উঠে আসলো। খেয়াল করে দেখলাম যেখানে সে শুয়েছিলো, সেখানে কয়েকটা কাগজ বিছানো! ভাবনার গতিতে আমার তুমুলবেগে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। সাহস করে কিছু প্রশ্ন রাখলাম, কিছু শুনলাম, কিছু শুনার আগেই যথারীতি গাড়ী চলে আসায় আলাপ থামিয়ে চলে আসলাম। বলেছে তার ছেলেমেয়ে আছে। বিস্তারিত জানার এখনো সাহস এবং সময় করে উঠতে পারিনি। সারাটাদিন অফিসে খুব বিপর্যস্ত সময় কাটিয়েছি। কবে শুক্রবার আসবে আর কবে আরো একখানা কম্বল তাকে কিনে দিতে পারবো। এরই মধ্যে কলিগ একজন আবদার করে বসলো, সে কিনে দেবে। তার আসা-যাওয়ার পথেই কিনে নিতে পারবে। অইরাতে আমার ঘুমাতে গিয়েও বারবার ব্যাপারটা পীড়া দিচ্ছিলো।
পরেরদিন অফিসে আসাকালীন তার দেখা পাইনি। যথারীতি কলিগ হাতে করে একখানা কম্বল নিয়েও এসেছে। আমার অফিসে যাওয়ার পথ একটা, ফেরার পথ আরেকটা। কলিগ বারবার করে বলছিলো, আপু রাতেরবেলা অই দিকটায় যেয়ো না, বরং সকালেই দিও। ভাবলাম, একটু নাহয় হাঁটতেই হবে, তবুও তার হাতেই দেই। কম্বল নিয়ে সেদিন সকালের পথ ধরেই নামলাম। অনুমান করছি রাতেরবেলা তাকে পেয়েই যাবো, শীতের রাত। একটু এগিয়ে যেতেই পেয়ে গেলাম। হাতে দিয়েছি, বিকারহীন অবয়ব হলেও সে খুশি হয়েছে।
শুক্রবারদিন খাবার দিয়ে এসেছি। মাঝে একদিন নাস্তার জন্য টাকা দিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্য, সে কিছু চায় না! শুধুই কথা বলে! কখনো লোকের সাথে, কখনো আপনমনে!!
★শুকরিয়া, পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে এখনো সুন্দরভাবে বেঁচে আছি।
১৯টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
কেন যে মানুষ এমন অপ্রকৃতস্থ হয়ে যায়! সংসার করার বাসনা ওনার আছে বলেই ঘড় গুছিয়েন। আপনার তাকে সময় এবং সাহায্য করার মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাই।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সাহায্য আমি তেমন কিছুই করছি না। যতোটুকু তা যৎসামান্য। আমি মুলত যে ব্যাপারটা এখানে তুলে আনতে চেয়েছি তা হলো মানুষ হয়েও মানুষ কতোটা অস্বাভাবিক জীবন যাপন করে যখন তার চিন্তাশক্তি ঠিকঠাক কাজ করে না।
অথচ আমরা মানব সমাজ প্রায়ই হতাশায় আক্রান্ত হই না পাওয়ার বেদনায়, কিন্তু শুকরিয়া আদায় করি না নিজের পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপনের সুযোগ লাভের জন্য। উলটো অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে নিজের উদরপূর্তি করতে ততপর থাকি।
ইঞ্জা
মন খারাপ হলো আপু সেইসব মানুষের কথা ভেবে যারা দুমুঠো খেতে পারেনা, বসতহীন, জানিনা কিভাবে ওদেরকে স্বাবলম্বী করা যায়। 🙁
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বসতহীনদের দেখে আমরা নিজেদের সুস্থ মস্তিষ্কের জন্য পরম করুনাময়ের কাছে শুকরিয়া।
ইঞ্জা
-{@
নিহারীকা জান্নাত
এদের দেখে কষ্ট হয়। কত বিচিত্র মানুষের জীবন। একসময় হয়তো সবই ছিলো তার।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
সেটাই, না জানি কোন বিরুপ আচরণের শিকার হয়ে আজ তার এ করুন অবস্থা!
শাহানা আক্তার
জীবন কতো বিচিত্র! ! ভালো লাগলো আপনার ভালো মানসিকতা…আশেপাশে তাকালে নিজের অবস্থানের জন্য শুকরিয়া জানাতে বাধ্য হই…
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমার ছাত্রাবস্থায় পদস্থ কর্মকর্তা ভাইয়ের বউ কথাপ্রসঙ্গে কেউ একজনকে উপদেশ দিতে গিয়ে একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিলো, “কখনো উপরের দিকে তাকিও না, সবসময় নিচের দিকে তাকাবে, তাহলে নিজেকে পরম সুখি একজন মানুষ হিসেবে খুঁজে পাবে। দুঃখবোধ বলে কিছুই থাকবে না।” কথাটা তখন এমনভাবে মাথায় গেঁথে গিয়েছিলো যে, উচ্চাভিলাষীতা আমাকে কখনোই ছুঁতে পারেনি। আমি কোনকালেও নিজের মাঝে অসুখিবোধ কাজ করেনি।
নীলাঞ্জনা নীলা
রুবা’পু তুমি মহান একটি কাজ করেছো। তোমাকে স্যাল্যুট আপু।
অসহায় মানুষদের পাশে এভাবে দাঁড়ালে সকলে পৃথিবীটা কতো সুন্দর হয়ে যেতো।
ভালো থেকো। সুস্থ থেকো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
না রে দিদি, তেমন কিছুই করিনি। তবে অদের করুন দশা আমাকে খুব টানে, ভাবায়। এদের সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা করে খুব।
তোমাকে বলি, কিছুদিন আগে এক পোয়াতি কুকুর, আমি যেখানটাতে দাঁড়াই সেখানে একটা টং দোকানও আছে। দিনমজুরেরা চা খায়। দেখি কি, এক লোক চা খাচ্ছে আর কুকুরটা অনেকক্ষণ তার কাছে বসে লেজ নাড়াচ্ছে আর একটু উসখুস করছে। কুকুরটার বাচ্চা হবে হবে সময়। প্রায় ৫/৬ মিনিট দেখতে দেখতে কৌতুহলবোধ থেকে লোকটাকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম যে, ও এমন করছে কেনো? লোকটা আমাকে বললো, খেতে চায়। আমি অবাক, বিস্কুটও খায়? পরে বললাম, দেন তো দুটো, বলে দশটাকা দিলাম। ব্যাটা তিনটা বিস্কুট আর একটাকা ফেরত দিয়ে বললো, আপনি খেতে দিন। আমি আবার কুকুর ভয় পাই। ওরা তো একবার আদর করলে পিছু ছাড়ে না। তাই তাকেই দিতে বললাম। দেওয়ামাত্রই সে ফটাফট খেলো। একটাকার সাথে আরো দুটাকা মিলে দিলাম আরেকটা দিতে। খেয়েই সে টুপটুপ করে হেলেদুলে চলে গেলো।
আহা! আমার সেদিন যে কি ভালো লেগেছিলো, অভুক্ত পোয়াতি কুকুরটার পেটে খাবার দিতে পেরে। 🙂
আবু খায়ের আনিছ
রাস্তায় দেখা বায়োজৈষ্ঠ্য মানুষগুলো মাঝে মাঝেই থমকে দাড়াঁতে বাধ্য করে, কিছুই কি করার নেই এদের জন্য?
দারিদ্র্যতা আর কতকাল বয়ে বেড়াবে আমার দেশের মানুষ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এমনটা হয়তো থাকবেই। মাঝেমধ্যে আমাদের তাদেরকে একটু সাহায্য করা উচিৎ যে যার অবস্থান থেকে।
মৌনতা রিতু
যাস্ট সালাম তোমাকে আপু। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে জানি, তুমি অনেক কাজ করো। এগিয়ে যাট। এগুলোই সম্পদ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
না রে, সে সাধ্য কই?
শুন্য শুন্যালয়
খুব ভালো কাজ করেছেন আপু। এই লেখাগুলো বেশি বেশি শেয়ার হলে অনেকেই এই ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ হবে আমার মনে হয়। সত্যিই মানুষ রহস্যময়, কিভাবে মানুষ বেঁচে থাকে!! আপনার জন্য শ্রদ্ধা আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক এটাই আমার প্রশ্ন, কিভাবে বেঁচে থাকে? আরো একজনের বিবরণ শুনলে রীতিমতো অবাক হবেন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
শুকরিয়া, পরিপূর্ণ জীবন নিয়ে এখনো সুন্দরভাবে বেঁচে আছি।
এটাই আপু আমরা ওদের চেয়ে অনেক ভাল আছি। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এজন্য ঈশ্বর বরাবর সর্বসময় শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ।