ইতিহাস ও প্রাচীন সব জিনিস আমার খুবই প্রিয়। এক কথায় এসব প্রাচীন সব কিছুতেই আমার দুর্বলতা । আর তার সাথে যদি জড়িয়ে থাকে অলৌকিক কিছু তবে তা খুবই ভাল লাগে। বর্তমানে বরের পোষ্টিং সূত্রে কুড়িগ্রামে আছি। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট থানার টগরাইহাঁট জয়দেব হায়াৎ নামক স্থানে এই গাছটি আছে। এই গাছটি কবে থেকে এখানে আছে তা কেউ বলতেই পারে না। বিগত বেশ কয়েক প্রজন্ম থেকেই এই গাছটি এখানে। এই গাছের নামও কেউ বলতে পারে না। এই গাছের বিভিন্ন ডালের পাতায় আছে ভিন্নতা। কথিত আছে, কোনো এক কালে, এখানকার এক লোক ভারতের কামরুকামাক্ষা অর্থাৎ যেখানে মন্ত্র টন্ত্র যপ করা হয় বেশি সেখানে যায় দেখতে। সেখানে সে দেখতে পায় যে,ওখানে পুরুষ লোকের সংখ্যা খুবই কম। তার কারণ হলো, পাশের জঙ্গল থেকে নির্দিষ্ট একটি তিথিতে সিংহের গর্জন ভেসে আসত এবং সেই গর্জন যখন পুরুষের কানে যেতো তখন সে পুরুষের লিঙ্গচ্ছেদ হয়ে যেতো। তাই সেই সব তিথিতে ঐ স্থানের নারীরা তাদের পুরুষদের একটি গর্ত করে তার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে জোরে ঢাক বাজাত, যার যা আছে তা দিয়ে জোরে শব্দ করতো, জোরে জোরে গীত গাইতো যাতে সেই সিংহের শব্দ তাদের কানে না পৌছায়। তবুও ওখানকার পুরুষের সংখ্যা একেবারে কমেই যেতে লাগলো। এই লোক যখন ওখানে গেলো সেখানকার নারীরা তাকে আর ফিরে আসতে দিতে চাইছিল না। কিন্তু তিনি সেখানে থাকতেও চাচ্ছিল না। যতবারই সে পালিয়ে আসতে চায় গোলকধাঁধার মায়ার জালে আটকা পড়ে। একদিন সে ঋষি মতো এক লোকের কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করে বলে তার দুঃখের কথা। সে দেশে ফিরে আসতে চায়। ঋষি তাকে পরামর্শ দেয়, পাশের জঙ্গলে গিয়ে এই বিশেষ গাছটিকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে বলতে হবে সে কোথায় যেতে চায়। লোকটি রাতের আঁধারে জঙ্গলে গিয়ে গাছটিকে জড়িয়ে ধরে মনে মনে তার ইচ্ছের কথা বলে, গাছটি তাকে চোখের পলকেই এনে এখানে ফেলে দেয়। গাছটিও থেকে যায় তখন থেকে এখানে।
আমি দুই বাচ্চাসহ গাছটি দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানকার মানুষের মুখে শুনলাম এসব কাহিনী। একটা ঢিবির মতো জায়গার উপরে গাছটি। শোনা যায় আগে আরো উঁচু ছিল এই ঢিবিটি। এই গাছটির চারদিকে বাঁধাই করা। যাকে বলে ইট সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে রাখা। তবে এই বেদির উপরে ওঠাও কিন্তু সম্পূর্ণ নিষেধ। আমি জানতাম না, তাই জুতা পরেই বেদির উপরে উঠে গাছের পাতা ধরে দেখতে চাইলাম। গাছের কিছু পাতা পাইকোড় গাছের মতো। এখানে ছবি তোলাও নিষেধ। গাছের পাতা ছেড়াও সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। কথিত আছে, কেউ একজন এই গাছের পাতা ছিঁড়েছিল পর মুহূর্তে সে প্রচন্ড জ্বরে ভুগে পরদিনই মারা যায়। এমনি আরো কিছু কথিত কাহিনী আছে। এই গাছের পাশেই আছে কয়েকটা মন্দির ও দানবাক্স। এখানে বিশ্বাস মতে মনে মনে কেউ কিছু মানত করে টাকা ফেললে তার মনের ইচ্ছে পূরণ হয়। তবে ইচ্ছে হতে হবে সৎ।
যাই হোক,আমরা মনে মনে বিস্ময় হয়ে এসব বিশ্বাসে বিপুল শক্তিতেও আলাদা স্বাদ গ্রহণ করি। এগুলো আমাদের অন্তর্দৃষ্টির এক বিশ্বাসও হয়ত। আমরা ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতো প্রকৃতিক স্থাপনা দেখেছি তার সবই এই বিশ্বাসমতে সৃষ্টি। আমরা আমাদের জানার ইচ্ছেতে জ্ঞান বলে এমন কিছু দীপ্তিময় কাহিনী রচনা করি, যা সহস্র সহস্র বছর ধরে নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখে। অতীতের এসব শত শত প্রাণময় ছবিতে আমাদের হৃদয় পূর্ণ হয়। তবে এসব কিছুকে অতীতের জীর্ণ কুসংস্কার বলে উপেক্ষা করাটাও আমাদের ভুল। এসবের উপরেই আমাদের সংস্কৃতি জড়িত।
২০টি মন্তব্য
নীহারিকা
গাছটি দেখেই তো কেমন ভয় লাগছে। এমন প্রাচীন গল্পগুলো বিশ্বাস করতে মন চায় না কিন্ত অবিশ্বাস করতেও ভয় হয়।
মৌনতা রিতু
আসলেই তাই। আমি পরে শুনে খুব ভয় পাইছিলাম। পরে যা করেছি তা বলা যাবে না। যাইহোক, বিশ্বাস না করলেও ভক্তি করতে তো দোষ নেই।
ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
গাছটির ছবি দেখলাম, ভাবছিলাম আমিও যদি এমন একটা গাছের দেখা পেতাম! বলতাম আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলো মামনি-বাপির কাছে।
বর্ণনা খুবই সুন্দরভাবে করেছো। এককথায় ভালো লাগছিলো লেখাটি পড়ে। -{@
মৌনতা রিতু
হা হা হা। চলে আসো। ধন্যবাদ আপু। ভাল থেকো সব সময়।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপু নতুন লেখা কোথায়?
মৌনতা রিতু
নতুন লেখা দিব। সময় করেই উঠতে পারছি না। কেমন আছো। তবে দিব।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এমন ইতিহাস ময় পোষ্ট আরো চাই।আপনার পক্ষে সম্ভব বাস্তবতার নিরিখে ইতিহাস ঐতিহ্যয়ের সাথে আমাদের পরিচয় করে দেয়া।ধন্যবাদ।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাই। চেষ্টা করব ভাই আরো লেখার। দোয়া করবেন। পাশে থাকবেন।
ইঞ্জা
আপু, গাছটি মনে হয় অশ্বত্থ গাছ, এই ধরণের গাছ নিয়ে প্রায় নানা ধরণের কথা প্রচলিত থাকে, কিন্তু আপনার লেখা আমাদের অনেক কিছুই শেখায়, আপু লিখে যান, অপেক্ষায় রইলাম নতুন কিছুর।
মৌনতা রিতু
ভাইজু সত্যিই এই গাছের একেক ডালের পাতা একেক রকম। এটাই আমার গাছে অদ্ভুদ লেগেছে। আসলেই অনেক পুরাতন এই গাছটি। কয়েক পুরুষ ধরেই নাকি গাছটি এখানে।
চেষ্টা করব ভাইজু লেখার। ধন্যবাদ ভাইজু।
ইঞ্জা
আপু, অশ্বত্থ গাছে বিভিন্ন পাখ পাখালি ফল খেতে আসে আর তাদের মাধ্যমেই বিভিন্ন গাছের ফলের বিজ এইসব গাছে থেকে যায় আর তা থেকেই বিভিন্ন জাতের গাছ হয়, এতেই মনে হয় এক গাছে হরেক রকমের পাতা আছে।
মৌনতা রিতু
হুম, তাই তো! এমন হতে পারে। কলম যেটাকে বলে?
শুন্য শুন্যালয়
পুরনো দিনের গাছ, পুকুর, বাড়ি নিয়ে কতো মজার মজার গল্প যে আছে। বিশ্বাস করার কারণ নেই তবে রূপকথার মতোই এগুলোর অবস্থান আমাদের সংস্কৃতিতে। খুবই ভালো পোস্ট ভাবী। আমাদের হাতের কাছেই কতোশত ভাবনা রয়েছে যা নিজেকে ভাবায়, অন্যদেরও। লিখো এমন আরো আরো।
মৌনতা রিতু
আসলেই ঠিক বলেছো। ভাবছি এসব নিয়েই কিছু পোষ্ট লিখব। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে। ছবিসহ আমার ব্লগে সংরক্ষিত থাকবে।
এসব ঐতিহ্য সবার একটু করে জানাও হবে। নাম, স্থান সম্পূর্ণ উল্লেখ করেই লিখব ভাবছি। এতে এইসব স্থান কেউ দেখতেও আসতে পারবে।
ধন্যবাদ সোনা। ভাল থেকো।
ছাইরাছ হেলাল
পুরনো বলেই সব কিছু কু এমন সিদ্ধান্ত আমরা হুট করে নিতে পারি না,
অনেক কিছুই আমাদের বিশ্বাস ও অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে।
আপনি দেখলেন বলেই আমরাও দেখার সুযোগ পেলাম।
মৌনতা রিতু
হুম, এসবের উপরেই অনেক কাহিনী জড়িত।
ভাল থাকবেন ভাই।
মিষ্টি জিন
কামরুপকামাক্ষার অনেক কঁথা যে শুনেছি আম্মার মুখে।
সংস্কার কু সংস্কার যাই হোক না কেন বিশ্বাসটাই হোল আসল।
ভাল লেগেছে গাছের ইতিহাস শুনে।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ আপু। ভাল থেকো। লেখা দেও।
জিসান শা ইকরাম
এই সমস্ত লোক কাহিনী আমাদের সংস্কৃতির একটি প্রধান অংশ,
বাঙ্গালী সংস্কৃতি এইসব লোক কাহিনী ব্যতীত অসম্পূর্ন।
তোমার লেখার বৈচিত্র দেখে মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যাই,
সোনেলার সবচেয়ে বেশী বৈচিত্রময় পোষ্ট তুমি দাও।
শুভকামনা, শুভ ব্লগিং।
মৌনতা রিতু
ধন্যবাদ ভাইয়া। দোয়া করবেন। ভাল থাকবেন।