ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যাবার পথে একদিনের যাত্রা বিরতিতে আমাদের মফঃস্বল শহরের বাড়িতে উঠতেন কাকা (বাবা'র বন্ধু)। তেমনি ব্যবসায়িক কাজে ঢাকায় গেলে বাবাও তাঁর বন্ধুর বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। সেই সময়টাতে দু'বন্ধু তে গল্প চলে রাতভর। জন্মাবধি এমনটি দেখে দেখে আমাদের বেড়ে উঠা।
আমি যখন মানচিত্রের উল্টো দিকের এই শহরে, তখন একদিন ফোনে কথা হচ্ছিলো। কাকা বললেন, " তুই সেদিন জান্মালি... হাসপাতালে দেখতে গেলাম... বিরামহীন কাঁদছিলি, সেই তুই বড় হলি... বিয়ে হলো... কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়ে বিদেশও চলে গেলি ! সময় কতো দ্রুত বয়ে যায়, দেখলি ?" প্রতিউত্তরে আমি মৃদু হাসি। "সময় দ্রুত বয়ে যায়"___ কথাটির সাথে ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে ছিল যদিও, কিন্তু সেই দীর্ঘশ্বাসের মানে উপলব্দি করিনি সেদিন। বড় হয়েছি, সেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত আমি মৃদু হাসি। বড় হলে অনেক আনন্দ। যেখানে খুশি যাওয়া যায়। যা খুশি করা যায়। শাসন, বারন বিহীন স্বাধীন এক জীবন !
এদিকে ফোনে বাবার কাছে পাড়া প্রতিবেশীদের নিত্য নতুন খবর পাই। কিছু খবর আনন্দের। কিছু দুঃখের। কিছু খবর হাসায়। কিছু কাঁদায়। এক এক করে বাবার সমবয়সী বন্ধুরা পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন। মৃত্যু ভয় আর তীব্র মন খারাপ নিয়ে বাবা বললেন, " চোখের সামনে একে একে সবাই চলে যাচ্ছে, কবে যে হুট করে আমার ডাক আসে !" এমন অলক্ষুণে কথা শুনে অভিমানে ফোন রেখে দেই।
অতঃপর একদিন কাকার মৃত্যু সংবাদ পাই। বিদেশের বাড়িতে একলা ঘরে ভয়ানক কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি আমি। রাতভর অবিশ্রান্ত বৃষ্টি শহর জুড়ে। বৃষ্টি হৃদয় জুড়ে। তীব্র এক অস্থিরতায় ভয়ে ভয়ে ফোন দেই বাবাকে। আমার বাবার মন ভেঙ্গে খান্খান্। সেই সাথে শরীরও। সমস্ত রাত্রি বারান্দায় পায়চারী করেছেন। নির্ঘুম রাত। অপেক্ষায় থেকেছেন। প্রিয় বন্ধুকে শেষবার দেখবার অপেক্ষায়। কিন্তু মৃত ব্যক্তিকে দ্রুত দাফন করতে হয়, বিধায় কাকা'র পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঢাকা থেকে সরাসরি গ্রামে নিয়ে যায় দাফনের উদ্দেশ্যে। দেখা হলো না আর দু'বন্ধুর। হলো না আমাদের মফঃস্বল শহরের বাড়িতে কাকা'র শেষ যাত্রা বিরতি...
শেষ নিঃশ্বাস অবধি বন্ধুত্ব,
কিংবা একজনের চির বিদায়ে অন্যজনের ডানাভাঙা আহত পাখির ন্যায় ছট্ফট করা __ এমন বন্ধু আমাদের ক'জনার আছে ?
সম্পর্কগুলো যত্নে থাকুক।
Thumbnails managed by ThumbPress
২০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
এখন এমন বন্ধুত্ব আশা করাই যায় না।
ব্যাতিক্রম ছাড়া।
রিমি রুম্মান
এমন বন্ধু এখনো আছে আমাদের সকলের। অন্তত একজন হলেও…
অলিভার
বন্ধুত্বের সংজ্ঞা এখন পাল্টে গেছে। এখন আর এমন বন্ধুত্বের দেখা মেলে না। উপরে উপরে সবাই একে অন্যের জন্যে ব্যাকুল, কিন্তু দূরত্বে কিংবা চোখের আড়ালে কেউ কারও বন্ধু না।
রিমি রুম্মান
অন্তত একজন বন্ধু হলেও আমাদের জীবনে আছে এমনটি। ভেবে দেখুন একাকী… নিভৃতে…
জিসান শা ইকরাম
কি বলবো ভেবে পাইনা।
আমি হলে এটি কিভাবে সামাল দেবো,অথবা আমার বন্ধু কিভাবে নিজকে সামলে নেবে,এটি ভাবতে পারিনা।
শেষ নিঃশ্বাস অবধি বন্ধুত্ব চাই আমি।
রিমি রুম্মান
শেষবারের মত বাবা তাঁর বন্ধুকে দেখতে পারেনি। ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বলা সেই আক্ষেপ, অভিমান আর হাহাকার ভরা বাবার কণ্ঠস্বর যেন আজো কানে বাজে। 🙁
ব্লগার সজীব
বন্ধু এমনই হতে হয়।কত কোমল ভাবে তুলে আনলেন ঘটনাটি।
রিমি রুম্মান
আমারও এমন একজন বন্ধু আছে। দশটি বছর বাদে গতকাল তাঁর সাথে দেখা আমার নিউইয়র্কের বাসায়। লিখবো এ নিয়ে পরবর্তীতে।
খেয়ালী মেয়ে
খুব প্রিয় কেউ যখন মরে যায় তখন শুধু সে একা মরে না, আরো কিছু মানুষকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে যায়……………………..প্রিয় বাঁধন/বন্ধুত্বের বাঁধনগুলো বোধ হয় এমনিই হয়…….
রিমি রুম্মান
মান্না দে’র “চলে গেছে বন্ধু আমার…” গানটি মনে পরে গেলো।
শুন্য শুন্যালয়
এমন বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই আছে, আমার নেই হয়তো অন্য কারো। সম্পর্ক যেটাই হোক তার যত্ন নেয়া উচিৎ। এমন বন্ধুত্বের বন্ধনগুলো দৃষ্টান্ত হোক আজীবন, আমরণ।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন আপু, যে কোন সম্পর্কেরই যত্ন নেয়া প্রয়োজন। ভাল থাকুন সবসময়।
মেহেরী তাজ
এমন বন্ধুত্ব এখন খুব কম দেখা যায়…..
ভালো থাকুক আপনার কাকা।
রিমি রুম্মান
বাবা- কাকা দু’জনই আজ অন্য জগতের বাসিন্দা। ভাল থাকুক সেখানে। 🙁
ইমন
সম্পর্কগুলো যত্নে থাকুক। 🙂
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, যত্নে থাকুন। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
বন্ধুত্ত্ব এখনও আছে। অনুভব করি। আমার নিঃশ্বাস কি বলে সে জানে ঊর্মী। বলতে হয়না। জানাতে হয়না।
রিমি আপু অনেক ভাগ্য করে এলে এমন বন্ধু পাওয়া যায়। সবাই যেনো তার নিজের জীবনে এমন বন্ধু পায়।
যত্ন নিতে পারিনা, অনেক অযত্নে রাখি। আজ আপনার ওই কথাটিকে মনে ধরলাম। -{@
রিমি রুম্মান
কেন জানি মনে হয় আমাদের সবার জীবনে এমন অন্তত একজন বন্ধু আছেই। যত্ন নেয়ার সময় হয়না। অযতনে, অবহেলে থাকে যদিও … তবুও থাকে তাঁরা অনুভবে।
নীতেশ বড়ুয়া
মারা গেলে তবেই জানা যাবে এমন বন্ধু কার আছে 🙁
রিমি রুম্মান
কার জন্যে কার বুকের গহীনে, চোখের ভেতরে কত জল… মৃত্যুর পর বুঝা যায় ভাল করে।