বর্তমান সাহিত্য যে জিনিসটা খুব স্পষ্ট করে লক্ষণীয় হচ্ছে তা হলো তরুণ এবং অগ্রজ লেখকের দুরত্ব। ঠিক দুরত্ব নয় এটা কে বলা যায় পৃথিবী এবং অন্ধকার কোন গ্রহের দুরত্ব। যার ফলে অগ্রজদের আলো তরুণ লেখকদের উপর পড়ছে না।

বর্তমান সাহিত্যের অবনতির অন্যতম কারণ হলো তরুণ লেখকদের প্রমোট না করা। এর ফলে তরুণরা ইতিমধ্যেই পথহারা দিশেহারা সাহিত্য উপহার দিচ্ছেন আমাদের। তরুণদের সঠিক দিক নির্দেশনা না দেওয়া হলে আমরা নতুন ধরণের সাহিত্যের রস আস্বাদন হতে বঞ্চিত হবো।

সময়ের পরিবর্তনে তরুণরাও ঘুরে দাড়িয়েছে। তাদের রচনা ও কার্যক্রম বর্তমানে অগ্রজদের অস্বীকার করছে। এইযে অস্বীকার করা পাত্মা না দেওয়া এই রেওয়াজটা আগে ছিলো না এখন আছে। তাই কেউ কাউকে গুরত্ব দিচ্ছে না। এর ও কিছু যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে। সাহিত্যের বয়স হিসেবে এটা বিবেচনা করা যায় যে, বর্তমান সাহিত্য ক্রমশই নতুন দিকে যাত্রা করছে এই নতুন দিকটা কোনদিকে?  তার ফুল এখনও প্রস্ফুটিত হয়নি। কিন্তু প্রস্ফুটিত হয়েছে কিছু অন্ধকার ঘরানার ছায়াচিত্র। 

কবিতা পরিবর্তন হবে বাঁক নিবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু তা কোনদিকে নিবে তা বুঝতে আমাদের আরও পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে একদল হতাশ তরুণদের লেখায় উঠে আসছে শব্দ সর্বস্ব কবিতা। শব্দের কারুকার্য অবশ্যই কবিতাকে মুগ্ধ করে কিন্তু শুধু ইট দিয়ে বাড়ি নির্মাণ হয় না একথা আমরা সবাই জানি তাই শুধু শব্দ দিয়ে কবিতাও হয় না। প্রয়োগ কৌশল চিত্রপট বা কল্পচিত্রের যথার্থতা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। 

নতুন প্রজন্মের লেখকদের খুব ভয় পাই। এই ভয়ের কারণ চার। এক। এদের কেউ কেউ হয় তো নতুন জয়ের সম্ভাবনায় দিগন্ত বিস্তারী। দুই। আবার কেউ কেউ রঙচটা, বাহারি 

অথবা তাণ্ডবী ঝড় মনে করা শুধুই বাতাস।তিন। এদের মধ্যে কেউ কেউ (অনেকেই) খুব ভালো লিখছে। চার। আর একটি দল। ফকির এরা ভিক্ষে করে। আপনার শব্দ নেয় আমার লাইন নেয়। অতঃপর গর্ভপাত করে অপরিপক্ক কনিতার ভ্রুণ। 

স্বঘোষিত অতি উৎসাহী কিছু তরুণ নিজেদের প্রসংশা নিজেরাই করছে এর কারণ ভিতরে কাঁচা থাকা পিঠার মতো। এদের অনেকের লেখাই প্রভাবিত এবং অনুবাদ পড়ে লেখা তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তাছাড়া কিছু বিপথগামী তরুণ কবি ও আছে যারা কবিতায় সরাসরি অগ্রজদের গুরুত্বপূর্ণ লাইন থিম ব্যবহার করছেন।

এর কারণ এদের পড়াশোনা কম এবং মৌলিক সাহিত্যে সম্পর্কে ধারণার অভাব। যে কারণে তাদের কবিতা মানুষের মনে জায়গা নিচ্ছে না এবং দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে না। অনেক তরুণ অশ্লীল শব্দ রমণ করে শারীরিক উলঙ্গ কবিতা চর্চায় মগ্ন। কবিতার এই প্রতিবন্ধকতা তাদের মধ্যে সৃষ্টি করছে ভয়াবহ হতাশা। কিছু কিছু তরুণের অভিমত শোনে মনে হয়, কবিতা যেন বসুন্ধরা সিটি, টাকা হলেই মার্কেট হয়ে যায়। বস্তুত তাদের পড়াশোনা জ্ঞান নেই বললেই চলে যতটুকু আছে অনুবাদ ততটুকুবাদে।কিন্তু এটা তারা মানতেই চায় না। অথচ সূদুর প্রসারী চেতনার ফসল ফলানোর জন্য গভীর সাধনার দরকার। শব্দের যুক্তিসঙ্গত বিজ্ঞানসম্মত যথাযথ  প্রয়োগ দরকার।

এখনকার বেশিরভাগ তরুণ কবি জোড়াতালির কবিতা লিখছে। ধার দেনা ভিক্ষে করা কবিতা লিখছি। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে একজন আরেকজনের ব্যবহৃত লাইন শব্দ নিয়ে নিজ নামে চালিয়ে দিচ্ছে। এলোমেলো শব্দকে ঘিরে লুডু খেলছে এলোমেলো কল্পচিত্র যার কোন সম্পর্ক নেই এক শব্দের সাথে অন্য শব্দের।

কিন্তু সম্পর্ক ছাড়া কিছু কী হয় পৃথিবীতে ? সম্পর্ক ছাড়া কারও কাছ থেকে এককাপ চা ও খায় না কেউ। তাহলে শব্দ কেন সম্পর্ক ছাড়া বসবে? শব্দ তো জীবনবোধ দুঃখ বেদনা প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং বিপ্লবের মতো মহান শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে, অতীত বর্তমান ভবিষ্যত ও আবহমান কালের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু কবিতার কৌশল ও প্রায়োগিক জ্ঞান না থাকায় তাদের কবিতায় নেই কোন ম্যাসেজ জীবনবোধ এবং  প্রকৃত আমেজ।

এর মূল কারণ হলো ফেসবুক যোগাযোগ মাধ্যম। এই মাধ্যম ব্যবহারে সবাই সবার কাছাকাছি এবং কবিতাও চুরি হয় বেশি কপি পেস্ট হয় বেশি। দ্বিতীয় দশকের পূর্ববর্তী সময়গুলোতে এমন কখনও দেখা যায় নি যে কবিরা এতোটা নির্লজ্জ হতে পারে। অগ্রজদের অসম্মান করতে পারে নিজেকে সরাসরি বড়ো কবি, গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। সাতপাঁচ ভাবনা অস্থির কল্পচিত্র মূলত কোন আবেদন তৈরি করছে না। তাই কিছু তরুণদের কবিতা পাঠকের হৃদয়ে স্থান পাচ্ছে না দাবি রাখছে না। 

বলতে গেলে আধুনিকতার পরে আমরা আরও প্রকর আধুনিকতাই চাই। যেমন ঘোলা জল ফেলে চাই বার বার জলের বিশুদ্ধ করুন। দাদা দাদির হারানো শব্দ ব্যবহার করতে চাই না যদি তা হয় উত্তরাধুনিক ও। পৃথিবী পরিবর্তনের পরিবর্তিত রূপ বৈচিত্র্য সমাজ বিজ্ঞান সবকিছুতেই। তাই পরিবর্তনের প্রকৃত হাওয়ায় পঙক্তি ভাসাতে আমাদের কোন আপত্তি থাকার কথা নয়, এবং অবশ্যই আমরা একসময় বাঁক বদল কবিতার বদল নিয়ে সামনে দাঁড়াব। 

জীবনানন্দ দাশ পরাবাস্তব চেতনার কবিতা  নিয়ে আসেন তিরিশের দশকে আমরা এখনও জীবনানন্দে বুঁদ এর কারণ আমরা জীবনানন্দকে অতিক্রম করতে পারিনি। আল মাহমুদ শামসুর রাহমান অথবা সৈয়দ শামসুল হকের মতো ষাটের দশকের কবিরা ও জীবনানন্দকে অতিক্রম করতে পারেনি।

তাই এখনও জীবনানন্দ জীবনের আনন্দ হয়ে নাচে আমাদের বুকে। যতোই সময় যাচ্ছে জীবনানন্দ ততোই আলোকিত হচ্ছে অথচ আমাদের ষাটের দশকের কবিরা ততোই ম্রিয়মান হচ্ছে।

তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবেরা রবীন্দ্র বলয় থেকে বাংলা সাহিত্যকে বের করে আনার জন্য অনেক চেষ্টা ও সমালোচনা করেন। কিন্তু প্রকৃত ফলাফল হলো একমাত্র জীবনানন্দ ছাড়া আর কেউ রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। তাই জীবনানন্দই কবিতার বাঁক বদলে সফল হয়েছেন। 

বর্তমান সাহিত্যে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। কোনটা সাহিত্য কোনটা সাহিত্য না তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। সাহিত্যের ভেতরে ঢুকে গেছে ধান্দাবাজ তৈলবাজ মানুষ। কিন্তু বস্তুত সাহিত্যে হলো কঠোর পরিশ্রমের দীর্ঘমেয়াদি ফসল তার জন্য দরকার সততার শক্তি ও সাহস। 

এ কথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতা উত্তর বাংলা সাহিত্যে যে শক্তিশালী সাহিত্যের জোয়ার উঠেছিলো তা এখন ক্রমশই ম্রিয়মাণ। অথচ সাহিত্যে আরও প্রাণান্ত বেগে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিলো। কারণ সাহিত্যে সমাজ জীবনের আয়না স্বরুপ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক স্বরুপ যার প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয় দেশ ও মানুষের হৃদয়ে। 

সাহিত্যের প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিলো সাধারণ মানুষের তা ও অনেকাংশে কমে গেছে অথচ একটি জাতির সাহিত্যে ও সংস্কৃতি যতো উন্নত সে জাতি ততো উন্নত।  তাছাড়া সাহিত্যে ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনে রাষ্ট্রীয় জীবনে সাম্য-সম্প্রতি রাজনীতি-অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। 

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ