বন্ধুত্ত্ব বিশ্লেষণহীন...

২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর যখন জাপান আসি, জাপানিজ জানা তো দূরে থাক, ইংরেজীতে কথা বলতে গেলেও দ্বিধাবোধ করতাম। ভুল হলে যদি হাসে! বাঙালী মন-মানসিকতার এটা একটা প্রধান হাস্যত্মক ব্যাপার। আমাদের সমাজে বেশী চলে কিনা! তাই শুনতাম, দেখতাম, বেশ বুঝতামও। কিন্তু স্পিকটি নট। একরকমের বোবা মুহূর্ত কাটানো জাপানীজ ক্লাশে। প্রথম দিকে ইউনিভার্সিটির ফ্রী ক্লাশে যাওয়া শুরু করলাম। তার পাশাপাশি নিহঙ্গ শেখার স্কুলেও ভর্তি হলাম। অবশ্যই ফ্রী নয়। প্রথম দিন ক্লাশে বড়ো বেশী নার্ভাস ছিলাম। দ্বিতীয় দিনেও। তৃতীয় দিনেও চুপই ছিলাম, শুধু হাসিটুকুই ছড়িয়ে থাকতো ঠোঁটে। একটা মেয়ে হঠাৎ এসে আমার পাশে বসলো। হাই বললো। আমিও। তারপর কেমন আছো এসব ছোট-খাটো প্রশ্ন। একটা দ্বিধা, ভুল হচ্ছে না তো ব্যাকরণে? তারপর আস্তে করে বললো "হোয়াই আর ইয়্যু সো স্কেয়ারড টু টক? ইয়্যু নো ইংলিশ ইজ দা ভেরী ইজি ল্যাঙ্গুয়েজ ইন দি ওয়ার্ল্ড?" আমি বললাম কোথায় ভয়? "নো ডিয়ার। ইউ লুক নার্ভাস। ডোন্ট ওরি, ইফ দেয়ার ইজ এনি মিস্টেক, আই উইল সো ইউ। বাট ইয়ু নিড টু টক। আই ওয়ান্ট টু বি ইওর ফ্রেন্ড। এন্ড ইয়্যু?" আমি চেয়ে রইলাম। এতো সুন্দরী দেখতে মেয়েটি, আর কি মোলায়েম সুরে কথা!

বন্ধুত্ত্ব হয়ে গেলো। ইউক্রেনের মেয়ে ও। ওখানে নার্স হিসেবে ছিলো। তারপর প্রেম করলো জাপানিজ একজনের সাথে, বিয়ে। অবশেষে ইয়োকোহামাতেই বসবাস। ওর সম্পূর্ণ নাম শুনিয়ে বললো ওকে লানা বলে ডাকতে। অনেক কঠিন আর লম্বা নাম। আমাকে ও চান্দা ডাকতো। স্কুলে বেশ গল্প হতো, ভুল করছি বলতে ও শুধরে দিতো। তবে তখনই না। পরে বলতো বুঝিয়ে। আমি বললাম জানো আমাদের দেশে ভুল করে কিছু বললে সেখানেই ধরিয়ে দেয়। তবে খোঁচা দিয়ে, বিদ্রূপ করে। লানা বললো এটা সব জায়গাতেই আছে। তবে ভাষা নিয়ে বিদ্রূপ করাটা ওদের ওখানে নেই। আসলে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, উন্নত বিশ্বে ভাষায় ভুল করলে কেউ বিদ্রূপ করেনা। আমাদের বাঙালীরা ছাড়া।

যাক লানা আর আমি স্কুলে একসাথে যেতাম, আবার ফিরতামও। স্কুলে মাঝে-মধ্যে অনুষ্ঠান হতো। যেমন কিমোনো উৎসব, ইকেবানা উৎসব। একবার আমি কিমোনো পড়লাম, লানা প্রচুর ছবি তুললো। আমার জীবনের প্রথম মডেলিং মানে ওভাবে ফটোসেশন এর আগে কখনোই করিনি। ফটোগ্রাফি ওর প্যাশন। আর তাও সাধারণ ক্যামেরায় এতো সুন্দর ছবি তুলেছিলো। তখন না ছিলো এডিট করার এতো সুবর্ণ সুযোগ। নরমাল ছবিগুলো দেখে আমি অবাক। তারপর বললো আমাকে ছবিগুলো দেবে না। বললাম আমি ওয়াশ করবো, দাও না। বললো, "ইফ আই গিভ ইয়্যু দা পিকচারস ইয়্যু আর গোয়িং টু ফরগেট এবাউট মি।"

একদিন তীর্থকে ডে-কেয়ারে রাখলো না। ৩৮ ডিগ্রী টেম্পারেচার হলেই ডে-কেয়ার বাচ্চাদের রাখেনা। তাই সেদিন আমার স্কুলে যাওয়া হলোনা। লানা চলে এলো। হাতে চকোলেট, আর আমার জন্য চিজ কেক। ও জানে আমি চকোলেট খাইনা। স্কুলে আমাকে না পেয়ে ক্লাশ না করেই চলে এসেছে। তারপর বললো রান্না আছে? বললাম না করবো, তীর্থ উঠতে দিচ্ছে না। লানার সেদিনই প্রথম আসা আমার বাসায়। বললো কি আছে ফ্রীজে? বললাম কেন? রান্না করবে। আমি বললাম তুমি এখানে বসো, তীর্থ বেশ পছন্দ করতো লানাকে। তাই খুব খুশী। অথচ লানাকে ও দেখেছে হাতেগোণা ২/৩ বার। মেয়েটির মধ্যে এক জাদু আছে। আমায় জোর করে বসিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ইউক্রেনিয় স্টাইলে নুডলস বানালো। এত্তো দারুণ টেষ্ট। আরেকদিন আমি স্কুলে যাইনি, চলে এলো। এসে দেখে আমার প্রচন্ড জ্বর আর শরীর খুবই খারাপ। কি বুঝেছিলো কি জানি! সেদিন অনেক খাবার নিয়ে এসেছিলো। তাও দুটো ডিশ নিজে বানিয়ে এনেছিলো।

লানা একদিন এসে বললো ও চাকরী পেয়েছে। ওর মধ্যে আমিও চাকরী পেয়ে গেলাম। প্রচন্ড ব্যস্ত জীবন, তাও মাঝে-মধ্যে কথা হতো। যখনই কথা হতো অনেক গল্প। জাপানের ব্যস্ত জীবনে দৌঁড়-ছুট, অফিস-সংসার, সামাজিকতা। একদিন ফোন দিয়ে বললো "চান্দা অলওয়েজ রিমেম্বার ইয়্যু ইন মাই লাইফ।" বললাম কি হলো কোথাও যাচ্ছো নাকি? বললো ওই রাতেই ওর ফ্লাইট। বললাম আমাকে আগে জানাওনি কেন? ঠিক না। হেসে বললো "বিকজ আই ওয়ান্ট ইয়্যু টু রিমেম্বার মি। আই উইল প্রে ফর ইয়্যু। গড উইল সেভ ইয়্যু ইন এনি সিচ্যুয়েশন।" লানার সাথে সেই শেষ কথা। আমি জানিনা আজ ও কোথায় আছে! ফেসবুকে খুঁজেছি কতো! পাইনি। ওর পুরো নাম জানিনা। কেন জানি মনে হয় আমাকেও ও খোঁজে। আমার পুরো নামও তো ও জানেনা। জাপানে থাকা অবস্থায় ওর সেই নাম্বারে কতোবার কল দিয়েছি, নাহ ফোন বন্ধ। আজ যখন ইংরেজিতে কথা বলি লানার কথা মনে পড়ে। এখনও কতো ভুল করি, কিন্তু আবারও সাহস নিয়ে সামনে এগোই। ভুল হবেই, তা বলে পিছিয়ে কেন পড়বো? লানা তুমি ভালো থেকো, যেখানেই থাকো। ঈশ্বর যেনো তোমারও মঙ্গল করেন।

**এলিভেটরে আসার সময় দেখি একটা ছেলে দরোজাটা ধরে রেখেছে, আমি ওয়াকার নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছি। থ্যাঙ্ক্যু ডিয়ার বলার পর বললো হুম। আবার তারপরেই দৌঁড়ে এসে বললো ওয়েলকাম।তীর্থ বললো ওদেরই ক্লাশের, ভালোভাবে নাকি ইংরেজী পারেনা বলতে। তবে ওরা সকলে মিলে ওকে শেখাচ্ছে। খুব ভালো লাগলো শুনে। তীর্থকে গল্প করলাম, বললাম লানার কথা। ও ভুলে গেছে লানাকে। দু' বছরের তীর্থ কতোটুকুইবা মনে রাখবে? ওর ছবি আছে দেশে এলবামে। চোখের সামনে ভাসছে ওর মুখ। শান্ত কিন্তু হাসিখুশী মেয়েটিকে আমি প্রায়ই মনে করি, সে যদি জানতো!

আমার বন্ধু লানা...

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৬ এপ্রিল, ২০১৬ ইং।

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ