আমাদের ইস্কুল

রোকসানা খন্দকার রুকু ১৩ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ০৩:৫৬:১৭পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১ মন্তব্য
  1. আমার কাছে বেহায়া চৈত্র রোদের বিকেলটা জামদানীর মতো ভারী। সুন্দর, কারুকাজময়। গায়ে মাখতে মন চায় কিন্তু অস্থির লাগে। শেষ হবে কখন, যেন অন্ধকারের অপেক্ষা। আজকাল অন্ধকার বেশি মধুর লাগে, বেশ টানে। হয়তো বয়সের সমস্যায় সেটা বাড়ছে, সবারই হয়তো তাই। একাকিত্বতা অন্ধকারে আঁচ করা যায় না বলেই হয়তো ভালোলাগে। যৌবনের ধুলোমাখা বিকেল বারান্দা কিসে যেন খেয়ে ফেলছে। তাতে সন্ধ্যাই মধুর ভায়োলিন।

 

আজকের জামদানী বিকেল কাটাতে প্রাইমারী স্কুলের দিকটায় হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। স্মৃতি সকালের মতো শুভ্র, যেন কারুকাজহীন চিকন মসলিন। লুকিয়ে থেকে হঠাৎই ধরা দেয়। আমাদের স্কুলটা এখনবিরাট বড় ভবন হয়েছে। মাঠের চারপাশটাও গুছানো। কিছুখনের জন্য মনে হল যেন, শহরে ঢুকে পড়েছি। স্কুলে শিক্ষার্থী আর পড়াশোনার মান যেমনই হোক; জৌলুশের কমতি নেই।

 

আমাদের সময় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের একেবারেই চল ছিল না। আমরা দলবেঁধে এইস্কুলেই পড়তাম। বিকেলে ফেরার সময় একদল অন্যদলকে কুকুর লেলিয়ে বাড়ি ফেরাই ছিল একমাত্র কাজ। কোন কোনদিন কুকুরের দৌড়ে বইখাতা জমির কাদায় মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফিরতে হত। আমাদের বই- খাতারও জৌলুশ ছিল না। পলিথিন ব্যাগে মুরানো ছেঁড়া ফাঁড়া অবস্থা। সে যতো বড় ঘরের সন্তান হোক না কেন? ওটাই ভালো লাগত। ব্যাগ হয়তো ছিল আমরা চিনতামই না।

 

স্কুলে যাবার জন্য সাতসকালে উঠে তৈরি হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সকালে কাউকে জাগাতে হতো না, এমনিই দুচোখের ঘুম উধাও। অবশ্য সাতসকালে যাবার অন্য উদ্দেশ্য ছিল- ' পড়া কম খেলা বেশি'!

 

আমাদের স্কুলে কোন দরজা- জানালা ছিল না।  হলুদ ইট বের হয়ে যাওয়া একটা ধংসাবশেষের মতো, অতি পুরাতন। আমরা যেদিক সেদিক দিয়ে যাওয়া আসা করতে পারতাম। তবে সেটা অবশ্যই শিক্ষক অমান্য করে নয়! বেদম পিটুনিতে এমন নয় যে, ক্লাস রুম ছেড়ে বেরিয়েছি কেউ।

 

আমার সুবিধা ছিল সবচেয়ে বেশি। মোটামুটি ক্লাসরুমে ঘুমিয়ে পড়ার রেকর্ড আছে। দেখা গেল, ক্লাস শেষে ঘুমিয়ে গেছি। বন্ধুরা জাগাতে না পেরে বাড়িতে খবর দিয়েছে কিংবা আম্মি সময়মতো আসিনি দেখে ইয়া বড় লাঠি নিয়ে গিয়ে আন্ধাধুন মাইর থেরাপী দিয়ে জাগিয়ে তুলেছে।

 

প্রায়ই মাইর খাওয়ার পর জেগে বলতাম- কোন শালারে আমারে মারে? চোখ খুলে তো চরকগাছ! স্বয়ং মা কালী যে দন্ডায়মান! বাড়ি ফিরে দুধ ভাত খেয়ে আবার খেলতে যাওয়া কিংবা ঘুম। এখনকার বাচ্চারা দুধভাত খায় না। বার্গার, পিজা খায় তাই মাথা গরম!

 

প্রায় সকালে আমরা স্কুলে গিয়ে দেখেছি কে বা কারা ক্লাসরুমের মেঝেতে হাগু করে রেখে গেছে। সাথে প্রসাবও করত। দেয়ালে হলুদ ইট দিয়ে বড় করে ওমুক + তমুক এই টাইপ ভালোবাসা বাসী নামও লিখে যেত। বসার মতো অবস্থা ছিল না।

 

স্যাররা সবাই মুরুব্বি, মানে বয়সী ছিলেন। ওনারা আসা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতাম না। যে স্কুলে জানালা নেই সেখানে সুইপারও নেই। তো পাশের বাড়ি থেকে কোদাল এনে আমাদেরই পরিস্কার করতে হত। প্রসাব পায়খানার উপর ধুলা ফেলে কোদাল দিয়ে ফেলতে হতো। আমাদের এলাকায় সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবার আমাদের। আমি সবচেয়ে মনোযোগ দিয়ে এ কাজ করতাম।

 

মাঝে মাঝে অসহনীয় পর্যায়ে আমরা মাঠে ক্লাস করেছি।  আমাদের কোন বন্ধু হয়তো এ কাজে বেশি পারদর্শী ছিল আবার কেউ বমি করত। যে বমি করতো তাকে দুরে সরিয়ে রেখে পারদর্শীরা কাজ সেরে তারপর ক্লাস করতাম।

 

সপ্তাহে বাড়ি থেকে একটা করে ঝাড়ু নিয়ে যাবার নিয়ম ছিল। সুপারীর পাতা দিয়ে সে ঝাড়ু তৈরি করা হতো। মায়েরা দিতে না চাইলে আমরা চুরি করে নিয়ে যেতাম।

 

আমাকে একবার ঝাড়ু সমেত আম্মি ধরে ফেলল। আগের দিনও একটা নিয়ে গেছি আবার আজ কেন? আমি মহানুভব মানুষ আমার আধাশহুরে বন্ধুর বাড়িতে ঝাড়ু তৈরি হয় না। তার প্রতি প্রেম নিবেদন স্বরূপ আম্মির হাতে সেই ঝাড়ু দিয়ে রীতিমতো ধোলাই দেয়ার পরও ঝাড়ু ছাড়িনি। বন্ধুকে কথা দিয়েছি যে!

 

আমরা পালা করে ক্লাসরুম পরিস্কার করতাম। আমি বেশি করতাম কারন শরিয়তউল্লাহ স্যার বলতেন, আমার ঝাড়ুর হাত বেশি পরিস্কার। স্যারদের নামাজের ঘর পরিস্কার করা, তাদের ওযুর পানি, খাবার পানি এনে দেয়া এসব আমাদেরই কাজ ছিল।  আমরা ভাবতাম স্যার দোয়া দিলে অনেক বড় হওয়া যায়। আর ক্লাসরুম পরিস্কার করা আমাদেরই কাজ।

 

আমার একবার প্রচন্ড জ্বর হলো। অনেকদিন স্কুলে যেতে পারিনি। আমার প্রিয় স্যার অপেক্ষা করে করে শেষে বাড়িতে চলে এলেন। আম্মি সেদিন আমাকে গোসল করিয়ে খালি গায়ে রোদে দাঁড়িয়ে দিয়েছে।

স্যারকে দেখে আমি চমকিত। কারণ পরনে প্যান্ট নেই। সালাম দিতে গিয়ে খেয়াল হলো ইজ্জত ঢাকা জরুরি। অগত্যা সালামের হাতই সম্বল।

স্যার বোধহয় কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলেন। কাঁধে রাখা মুসল্লী গামছা দিয়ে বললেন- যাও মা, প্যান্ট পরে, বাবার জন্য চেয়ার নিয়ে এসো। তুমি স্কুলে যাওনা আমার খুব কষ্ট হয়েছে। ওযুর পানি দেবার কেউ নেই।

 

সময় বদলেছে, এইসব স্কুলেই এখন পিয়ন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা ঘুস নিয়ে। স্কুলের জৌলুশ বেড়েছে, ঠাট বেড়েছে। শিক্ষার্থী কমেছে, ভালো রেজাল্টও নেই।  শিক্ষকরা অবশ্য ভার্সিটি পড়ুয়া। তবুও কারও মাথা ব্যাথা নেই। সবাই পেট পুজায় ব্যস্ত। না হয়ে উপায় কি? সন্তানসম ভেবে শাসন করলে আপনাকেও তার দ্বিগুণ মাশুল গুণতে হবে। বদলী হবে, হেনস্তা হবে এসব।

 

আমরা কি একবারও খেয়াল করি আজ আমাদের সন্তানদের যা শেখাচ্ছি। নিজেরা পরিবর্তনের নামে দূর্নীতিতে ডুবে যাচ্ছি তার পরিনতি কতোটা ভয়াবহ! কীট তাকে বিসর্জন দিয়ে অনেকগুলো লার্ভার জন্ম দেয়। প্রাণ দেয়।  আমরাও দিনে দিনে নিজেদের আধুনিকতা আর আধিপত্য,  জৌলুশ বাড়াতে গিয়ে নিজেদের খোকলা করে জন্ম দিচ্ছি হাজারো কীটের,  অমঙ্গলের, দূর্নীতিবাজ প্রাণের। যাদের কাছ থেকে আশা করার কিছু নেই!!!

0 Shares

একটি মন্তব্য

  • হালিমা আক্তার

    চমৎকার স্মৃতি চারণ। আমার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানি না। কারণ কখনো স্কুল পরিস্কার করতে হয় নাই। তবে ছোট্ট বেলায় মসজিদ ঝাড়ু দিয়েছি। এটা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলতো। সময় নাই মন্তব্যে আরো কিছু লেখার ইচ্ছে ছিল। শিক্ষার এ অবস্থার জন্য আসলে কারা দায়ী। ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ