ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলাদেশ দখল করে মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতায়, তখন বাংলার এত সম্পদ ছিল যে, একজন মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী গোটা বিলাত শহর কিনতে পারত। সেই বাংলাদেশের এই দুরাবস্থা চোখে দেখেছি যে, মা মরে পড়ে আছে, ছোট বাচ্চা সেই মরা মার দুধ চাটছে। কুকুর ও মানুষ একসাথে ডাস্টবিন থেকে কিছু খাবার কাড়াকাড়ি করছে। ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে মা কোথায় পালিয়ে গেছে। পেটের দায়ে নিজের ছেলেমেয়ে কে বিক্রি করতে চেষ্টা করছে। কেউ কিনতেও রাজী হয় নাই। বাড়ির দুয়ারে এসে চিৎকার করছে, ‘মা বাঁচাও, কিছু খেতে দাও, মরে তো গেলাম, আর পারি না, একটু ফেন দাও।’ এই কথা বলতে বলতে ঐ বাড়ির দুয়ারের কাছেই পড়ে মরে গেছে। আমরা কি করব? হোস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেই, কিন্তু কি হবে এতে?
এই সময় শহীদ সাহেব লঙ্গরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। মুসলিম লীগ অফিসে, কলকাতা মাদ্রাসায় এবং আরও অনেক জায়গায় লঙ্গরখানা খুললাম। দিনভর কাজ করতাম, আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম। আমার আরও কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন। যেমন পিরোজপুরের নূরুদ্দিন আহমেদ-যিনি পরে পূর্ব বাংলার এমএলএ হন। নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন-যদিও তিনি আনোয়ার সাহেবের দলে ছিলেন, আমার সাথে এদের গোলমাল ছিল, তবুও আমার ওকে ভাল লাগত। বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন প্রফেসর সাইদুর রহমান সাহেব (বহু পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজের প্রিন্সিপাল হন) আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। হোস্টেলে রাজনীতি বা ইলেকশনে আমার যোগদান করার সময় ছিল না। তবে তিনি আমার সাথে পরামর্শ করতেন। প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. আই. এইচ. জুবেরী। তিনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। কোন ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে সোজাসুজি আলাপ করতাম এবং সত্য কথা বলতাম। শিক্ষকরা আমাকে সকলেই স্নেহ করতেন।আমি দরকার হলে কলেজের এ্যাসেম্বলি হলের দরজা খুলে সভা শুরু করতাম। প্রিন্সিপাল সাহেব দেখেও দেখতেন না। মুসলমান প্রফেসররা পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। হিন্দু ও ইউরোপিয়ান টিচাররা চুপ করে থাকতেন, কারণ সমস্ত ছাত্রই মুসলমান। সামান্য কিছু সংখ্যক ছাত্র পাকিস্তানবিরোধী ছিল, কিন্তু সাহস করে কথা বলত না।
এই সময় রিলিফের কাজ করার জন্য গোপালগঞ্জ ফিরে আসি। গোপালগঞ্জ মহকুমার একদিকে যশোর জেলা, একদিকে খুলনা জেলা, আর একদিকে বরিশাল জেলা। বাড়িতে এসে দেখি ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সবই প্রায় না খেতে পেয়ে কঙ্কাল হতে চলেছে। গোপালগন্জের মুসলমানরা ব্যবসায়ী এবং যথেষ্ট ধান হয় এখানে। খেয়ে পরে মানুষ কোনোমতে চলতে পারত। অনেকেই আমাকে পরামর্শ দিল, যদি একটা কনফারেন্স করা যায় আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব আর মুসলিম লীগ নেতাদের আনা যায় তবে চোখে দেখলে এই তিন জেলার লোকে কিছু বেশি সাহায্য পেতে পারে এবং লোকদের বাঁচাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। আমাদের সহকর্মীদের নিয়ে বসলাম। আলোচনা হল, সকলে বলল, এই অঞ্চলে কোনোদিন পাকিস্তানের দাবীর জন্য কোনো বড় কনফারেন্স হয় নাই। তাই কনফারেন্স হলে তিন জেলার মানুষের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হবে। এতে দুইটা কাজ হবে, মুসলিম লীগের শক্তিও বাড়বে, আর জনগণও সাহায্য পাবে। সকল এলাকা থেকে কিছু সংখ্যক কর্মীকে আমন্ত্রণ করা হল। আলোচনা করে ঠিক হল, সম্মেলনের ’দক্ষিন বাংলা পাকিস্তান কনফারেন্স’ নাম দেয়া হবে এবং তিন জেলার লোকদের দাওয়াত করা হবে। সভা আহ্বান করা হল অভ্যর্থনা কমিটি করার জন্য। বয়স্ক নেতাদের থেকে একজনকে চেয়ারম্যান ও একজনকে সেক্রেটারি করা হবে। প্রধান যারা ছিলেন তাদের মধ্যে থেকে কেউ রাজি হন না কারণ খরচ অনেক হবে। দেশে দুর্ভিক্ষ, টাকা পয়সা তুলতে পারা যাবে না। শেষ পর্যন্ত সকলে মিলে আমাকেই অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান এবং যশোর জেলার মৌলভী আফসার উদ্দিন মোল্লা নামে একজন বড় ব্যবসায়ী, তাঁকে সম্পাদক করা হল।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান। (পৃষ্ঠা নং-১৮ ও ১৯)
১৫টি মন্তব্য
খসড়া
ধন্যবাদ। পরের পর্ব দ্রুত আসুক।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ। আসছে ভাইয়াপু।
লীলাবতী
গোপালগঞ্জ জেলায় মুসলিম লীগের জন্ম থেকে ধীরে ধীরে শক্তিবৃদ্ধি সবটাই আস্তে আস্তে উঠে আসছে লেখায়। মন্তব্য না করা হলেও নিয়মিত পড়ছি এই সিরিজটা। আমিও একমত, পরের পর্ব দ্রুত চাই।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
জেনে ভালো লাগলো লীলাবতী। অনেক ধন্যবাদ।
নীলাঞ্জনা নীলা
একেকটি পর্ব পড়া শেষ করেই অপেক্ষায় থাকি পরের পর্বের।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অপেক্ষা থাকাটাই স্বাভাবিক। অনেক অজানাকে জানা যাচ্ছে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর নিজের মুখের কথা, এ এক অন্যরকম ফিলিংস।
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিকই আপু।
জিসান শা ইকরাম
জনগণের প্রতি মমতা এখান হতেই শুরু হয়েছে মন হয় বঙ্গবন্ধুর
ওনার সাংগঠনিক দক্ষতারও প্রমান পাওয়া যাচ্ছে………
পর্ব চলুক নিয়ম মত।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ ভাইয়া।
রিমি রুম্মান
পর্বটি পড়েছি আগেই ফোন থেকে। কমেন্ট করা হয়নি। প্রতিটি পর্বই পড়া হয়। বলা যায় … নীরবে পড়ছি, জানছি… পরের পর্বের জন্যে অপেক্ষায়…
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
জয় বাংলা চলুক -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
জয় বাংলা…
ব্লগার সজীব
জাতির পিতার জীবনের সূচনা পড়ছি আপনার মাধ্যমে। ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমি প্রীত যে আমার মাধ্যমে পড়ছেন। তবে একটা ব্যাপার সত্য, এভাবে পড়ায় প্রতিটি ঘটনা মনে থাকবে।