‘ব্লাক বেঙ্গল’ নাটকের একটি দৃশ্যে, অভিনেত্রী টয়া ব্লাক বেঙ্গলের সাথে সেলফি তুলছে। সাথে ব্লাক বেঙ্গলের মালিক অভিনেতা জাহিদ হাসান ওরফে খলিল।

বহুদিন ধরে বিটিভির রঙিন পর্দায় বেশি একটা চোখ রাখা হয় না। বেশি মানে তা অনেক বছর হবে, যা ২০১১ সালের পর থেকে। সেই কবে যেন দেখেছিলাম, হুমায়ূন ফরিদী অভিনীত ‘সংশপ্তক’ নাটকটি। হ্যাঁ মনে পড়ে গেল নাটকটির শুরু হবার সময়টা। তখনকার সময় শুধু বিটিভিতেই নাটকটি সম্প্রচার করা হতো। সময়টা ছিল, ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি। নাটকটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী এবং ফেরদৌসি মজুমদার। নাটকটির পরিচালক ছিলেন, যৌথভাবে আবদুল্লাহ আল মামুন এবং আল মনসুর। ‘সংশপ্তক’ নাটকের আলোচিত চরিত্র ছিল কানকাটা রমজান। তখনকার সময় সবার মুখে মুখে কানকাটা রমজান কথাটি ভেসে বেড়াত।

আবার দেখেছি আসাদুজ্জান নূর অভিনীত ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকটি। এই নাটকটিও ছিল, বিটিভির সাপ্তাহিক ধারাবাহিক নাটক। শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের কোনও একসময়ে। নাটকটি রচনা করাছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ এবং পরিচালক ছিলেন, বরকত উল্লাহ। অভিনয়ে ছিলেন, সুবর্ণা মোস্তফা, আসাদুজ্জামান নূর, আবদুল কাদের, মাহফুজ আহমেদ, আফসানা মিমি, হুমায়ূন ফরিদী প্রমুখ।

নাটকটিতে বাকের ভাই-এর চরিত্রে ছিলেন, তুখোড় অভিনেতা আসাদুজ্জান নূর। মনে পড়ে নাটকটির শেষ পর্বের আগের পর্বের কথা। সেই পর্বে কাহিনীর ঘটনাক্রমে হাইকোর্ট থেকে ‘বাকের ভাই’-এর ফাঁসির হয়। আর ‘বাকের ভাই’-এর সেই ফাঁসির রায় নিয়ে, এই বঙ্গদেশে কতনা তুলকালাম ঘটেছিল। তখন রাজধানী-সহ দেশের বিভিন্ন জেলাশহরেও ‘বাকের ভাই’-এর মুক্তির দাবিতে মিছিল বের হয়েছিল। তবুও ‘বাকের ভাই’কে বাঁচাতে পারেনি বাংলার অগণিত মানুষ, আর স্বয়ং পরিচালক নিজেও। বাঁচাতে পারেনি এই কারণে যে, নাটকটির কাহিনী-ই ছিল ‘কোথাও কেউ নেই’।

সেসব ধারাবাহিক নাটক আমাদের বাংলাদেশ-সহ ভারতেও জনপ্রিয়তার শেষ ছিল না। নাটক চলাকালীন সময়ে না-কি শেষে, আমি গিয়েছিলাম ভারতে। তখন ভারতীয়দের মুখে শুনেছিলাম এসব নাটকের প্রশংসা। তখন অনুমান করতে পেরেছিলাম, আমাদের বাংলাদেশের টিভি নাটকগুলো এই দেশেও জনপ্রিয়তার শেষ নেই। যাক সেসব কথা, এবার আসল কথায় আসি। আসল কথা হলো একটা নাটক নিয়ে আজকের এই লেখা।

ভালোবাসা থেকে পাওয়া ল্যাপটপে লেখালেখি বেশি একটা করার সময় পাই না। তবে আমি নিয়মিত ইউটিউবে বাংলা পুরানো ছায়াছবির গানগুলো বেশি উপভোগ করি। আবার দেখা হয় পুরানো হিন্দি ছায়াছবির গানও। এসব দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো একটা নাটক। নাটকটি গত ঈদ-উল-আযহার দ্বিতীয় দিনে দীপ্ত টিভিতেও প্রচারিত হয়েছিল। ঈদের জন্য নির্মিত বিশেষ নাটকটির নাম: ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল : দ্য সেলফি হিরো’। নাটকটি রচনা করেছেন, মারুফ রেহমান। পরিচালক ছিলেন, মিলন ভট্টাচার্য। নাটকটিতে অভিনয় করেছেন, জাহিদ হাসান, প্রান রায়, শপথ, রাখী চৌধুরী, প্রান সরকার, ও সূচনা শিকদার, ড. এনামুল হক, মুমতা হিনা চৌধুরী টয়া, প্রমুখ।

নাটকটির কাহিনী ও সংলাপ বর্তমান যুগের ত্যাগের কোরবানি নিয়ে। এরই সাথে যোগ করে দিয়েছে বর্তমান যুগের ফেসবুকে সেলফি আপলোডের কাহিনী। নাটকটিতে জাহিদ হাসানের চরিত্রের নাম ‘খলিল’। তার সবসময়ের সঙ্গী হলো একটি ছাগল। খলিল ছাগলটাকে ভালোবেসে তার নাম রেখেছে ‘ব্লাক বেঙ্গল’। অভিনেত্রী ‘টয়া’ হলেন একজন মডেল বা নায়িকা। একজন চিত্রপরিচালকের সাথে ওই গ্রামে যায় শুটিং-এর কাজে। প্রান রায় অভিনয় করেছেন, একজন এ-+ মাস্টারে অভিনয়। নাম, মোঃ ফরিদ স্যার (A+মাস্টার) । তার কাছে পড়লে, যে কোনও খারাপ ছাত্র-ছাত্রীই A+পাবেই পাবে। A+ মাস্টারের নিজ বাড়িতেই বসিয়েছে কোচিং সেন্টার। আর প্রবীণ অভিনেতা ড. এনামুল হক অভিনয় করেছেন, গ্রামের চেয়ারম্যানের অভিনয়। গ্রামবাসীর কোনও সমস্যা হলে চেয়ারম্যান করে দিবে সমস্যার সমাধান।

ইউটিউবে ৪২.২৬ মিনিটের পুরো ভিডিওটা আমি উপভোগ করেছি। তুখোড় অভিনেতাদের মনমাতানো হাসির নাটকটি দেখে ভালোই লেগেছে। এর আগে গত পবিত্র ঈদ-উল-আযহায় দীপ্ত টিভিতে অল্প কিছুক্ষণ এই হাসির নাটকটি দেখেছিলাম। সেসময় পুরোপুরি না দেখার কারণে এত ভালো লাগেনি।সবকিছুই পুরোপুরিভাবে শেষ না করলে, কিছুই বোঝা যায় না। আমার বেলায়ও তা-ই হয়েছে।

কাহিনীতে খলিল দেখিয়েছে, একটা পশুকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। মানুষকে ভালোবাসলে মানুষ বেইমানি করে। বনের পশু বেইমানি শিখে নাই, করেও না। তাই তার ভালোবাসা আর ব্যস্ততা শুধু ছাগলটাকে নিয়েই। ছাগলটিকে খলিল কখনওই ছাগল বা বরকী বলে ডাকতো না। ওর নাম রাখা হয়েছে ‘ব্লাক বেঙ্গল’, সেই নামেই ডাকতো। ‘ব্লাক বেঙ্গল’ কথা বলতে না পারলেও সে মানুষের সব কথাই বুঝে। কারণ, ছাগলটি হলো উন্নতমানের ছাগল, তাই। খলিলের ইচ্ছা ওকে লেখাপড়া-সহ নানাবিধ কর্মও শিখানো। তাই একদিন মাঠে এনে ওকে গ্রামের সবার বাড়ি চিনিয়ে দিতে লাগলো। এটা এমুকের বাড়ি, ওটা তেমুকের বাড়ি। ব্লাক বেঙ্গলের সাথে কথা বলছে, আর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে বাড়িগুলো। আবার বলছে, ‘আমিও তোমার মতন এই গ্রামে নতুন বাসিন্দা। এখনো গ্রামের সব বাড়ি আর সব মানুষকে চেনা হয় নাই।’
এমন সময় গ্রামের এক মুরুব্বী ওই পথ ধরেই বাড়ি যাচ্ছিল। খলিলকে ব্লাক বেঙ্গলের সাথে কথা বলতে দেখে মুরুব্বী হতবাক।

খলিলের সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘খলিল তুমি কার সাথে একা-একা কথা বলছো?’
খলিল প্রত্যুত্তরে বললো, ‘চাচা ও ব্লাক বেঙ্গল’ উন্নতমানের ছাগল। এই গ্রামে নতুন তো, তাই ওকে গ্রামবাসীর বাড়িগুলো চিনিয়ে দিচ্ছি। কারোর গাছগাছালি যাতে না খায়, সেই জন্য।’
খলিলের কথা শুনে গ্রামের মুরুব্বীর চোখ কপালে উঠিয়ে খলিলকে বললো, ‘আমার বাড়িটা চিনিয়েছো?’
সাথে-সাথে খলিল জিহব্বায় কামড় দিয়ে বললো, ‘না চাচা, আমার একটুও মনে ছিল না আপনার বাড়ির কথা। একটু দাঁড়ান ওকে চিনিয়ে দিচ্ছি।’ এই বলেই ব্লাক বেঙ্গলকে উদ্দেশ্য করে খলিল বলছে, ‘এই শোন ব্লাক বেঙ্গল, দেখ চাচার দিকে।’
খলিলের কথা শেষ হতে-না-হতেই, মুরুব্বি বিরক্ত হয়ে খলিলকে বলছে, ‘থাক-থাক, আমার বাড়ি আর কষ্ট করে ওকে চেনাতে হবে না।’
ততক্ষণে খলিলের আর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, মুরুব্বি বিরক্ত হয়েছে। তাই মুরুব্বিকে খলিল বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে চাচা, ঠিক আছে।’
এই বলেই খলিল সেই জায়গা ত্যাগ করলো। মুরুব্বি খলিলকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, ‘ছাগলের সাথে একটা পাগল জুটছে। খাইয়া লইয়া-তো-আর কাম নাই, পাগল কোথাকার!’

খলিল ব্লাক বেঙ্গলকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা যাচ্ছে, A+মাস্টারের কোচিং-এ পড়তে। খলিল ওদের জিজ্ঞাস করলো, ‘তোমরা কোথায় যাও?’
ছেলে-মেয়েরা উত্তর দিলো, ‘A+মাস্টারের কোচিং-এ পড়তে যাচ্ছি।’
খলিল ভাবতে লাগলো, তা হলে আমার ব্লাক বেঙ্গলকেও নিয়ে যাই, A+মাস্টারের কাছে। দেখি ওকে একটা A+ সার্টিফিকেট নিয়ে দেওয়া যায় কি-না?
যেই ভাবা, সেই কাজ। A+মাস্টার তখন তার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তার গুণগান নিয়ে। এমন সময় খলিল তার ব্লাক বেঙ্গলকে নিয়ে কোচিং সেন্টারের ভেতরে হাজির। A+মাস্টার খলিলকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এখানে ছাগল নিয়ে কেন এসেছ?’
খলিল তখন মাস্টারকে বললো, ‘স্যার শুনেছি আপনি নাকি A+মাস্টার। গ্রামে আপনার খুবই সুনাম। স্কুল পড়ুয়া সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে আপনার প্রশংসা। তাই আমি এসেছি আমার ব্লাক বেঙ্গলকে নিয়ে আপনার কাছে। ওকে আপনি একটা A+ সার্টিফিকেট পাইয়ে দিন।’

খলিলের এই কথা শুনেই A+মাস্টার রেগেমেগে অস্থির। সাথে শরীরে কাঁপুনিও উঠেছে মাস্টারের। দাঁত কিড়িমিড়ি দিয়ে বলছে, ‘কী কী বললে তুমি? তোমার এত বড় সাহস, আমার সাথে ইয়ার্কি? ছাগলকে A+ সার্টিফিকেট পাইয়ে দিতে হবে? তোমার এই বেয়াদবির কৈফিয়ত দিতে হবে, খলিল।’
খলিল নরম সুরে A+মাস্টারকে বললো, ‘কেন স্যার, ও কথা বলতে না পারলেও, মানুষের কথা সবই বুঝে। ‘ব্লাক বেঙ্গল আদর বুঝে, কথা বললে মাথা নেড়ে জবাব দেয়। কাছে আসতে বললে, ও-কাছে আসে। আপনি তো অনেক দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদেরো A+ পাইয়ে দেন। আপনি একটু চেষ্টা করলে আমার আদরের ব্লাক বেঙ্গলও A+ পাবে। প্লিজ স্যার একটু দয়া করুন। ও উন্নতমানের ছাগল, সব পারবে স্যার।’
A+ মাস্টার বিরক্ত হয়ে শেষমেশ খলিলকে বকুনি দয়ে কোচিং সেন্টার থেকে বাইর হতে বলে। খলিল মাস্টারের সাথে আর বাড়াবাড়ি করলো না। ব্লাক বেঙ্গলকে সাথে নিয়ে কোচিং সেন্টার ত্যাগ করে। মাস্টার জিদ্দে কোচিং-এ পড়তে আসা সকল ছাত্র-ছাত্রীদের তাড়িয়ে দেয়। মাস্টার কোচিং সেন্টারে বসেই একা-একাই বলছে, ‘খলিল আমি A+ মাস্টার, তুমি আমাকে চেন না। তোমার এত বড় সাহস, এই গ্রামে অস্থায়ীভাবে থেকে আমার সাথে বেয়াদবি! আমি তোকে ছাড়ছি না খলিল। এক্ষুনি চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে বলছি, এর একটা বিহত করতেই হবে।’

নাটকটিতে চেয়ারম্যান চরিত্রে আছেন, ড. এনামুল হক। তিনি গ্রামবাসীর চেয়ারম্যান হলেও, কথা শোনে A+মাস্টারের কথা। মাস্টার যা বলে তা-ই তিনি শোনে। ভালমন্দের দিকে আর ফিরে তাকায় না। সময় অসময় চেয়ারম্যান এই A+মাস্টারের সাথে বসেই সঙ্গ দেয়। সেই খাতিরে মাস্টার মনে ক্ষোভ নিয়ে গেল, চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ দিতে। গতকাল খলিলের ব্লাক বেঙ্গল নিয়ে তার কাছে যাওয়াটা, মাস্টার কিছুতেই ভুলতে পারছে না। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে সব বৃত্তান্ত খুলে বললেন, চেয়ারম্যানও শুনলেল। A+মাস্টারের কথা শুনে চেয়ারম্যানও ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। আশ্বাস দিলেন, ‘এর সুষ্ঠু বিচার করা হবে।’
A+মাস্টার বুদ্ধি দিলেন, ‘বিচার যা-ই হোক চেয়ারম্যান সাহেব, ওর ছাগলটাকে আসন্ন কোরবানির ঈদে জবাই করা চাই।’

এমন কুবুদ্ধির শলাপরামর্শের মধ্যেই খবর এলো, গ্রমের একটি জাগায় শুটিং হচ্ছে। খবরটা দিলেন, A+মাস্টারের সাথে থাকা তার চামচায়। মাস্টার শুটিং-এর কথা শুনে তো খুশিতে টগবগ হয়ে বলছে, ‘এমন একটা খুশির খবর, অথচ গ্রামের চেয়ারম্যান জানে না! চলেন তো চেয়ারম্যান সাহেব, দেখি ওরা কোত্থেকে এসেছে?’ চেয়ারম্যান বলছে, ‘আমরা তো এখানে বসেছি খলিলের বিচারের নিয়ে। শুটিং পরে দেখা যাবে।’
কিন্তু A+মাস্টার চেয়ারম্যাবের কানে দিলো কুমন্ত্র, বললো, ‘দূর চেয়ারম্যান সাহেব, ‘খলিল আর ছাগলতো আর গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে না। ওর বিচার করা যাবে যেকোনো সময়। কিন্তু শুটিং তো আর সবসময় গ্রামে থাকবে না। চলেন, আগে শুটিং দেখতে যাই। সেখানে নায়িকার নাচগান, নায়কের মারামারি-সহ আরও অনেককিছু আছে। আমরাও একটু নাচগান করে আসি।’

যেই কথা, সেই কাজ। A+মাস্টার আর চেয়ারম্যান রওনা হলো শুটিং দেখতে। এর আগেই খলিল ব্লাক বেঙ্গলকে সাথে নিয়ে ওই শুটিং স্পটে গিয়ে শুটিং দেখছে। শুটিং চলছে পরিচালকের কথামত। নায়ক এক জাগায় দাঁড়িয়ে বলছে, ‘এই আকাশ, এই বাতাস তোমাদের সাক্ষী রেখে বলছি।’
এরপর একটু বিরতি। এই ফাঁকেই খলিল পরিচালকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা কী হচ্ছে? একটা লোক একা-একা দাঁড়িয়ে আকাশ বাতাসকে সাক্ষী রাখলো কেন?’
পরিচালক খলিলের কথায় জবাব দিলো, ‘এটা শুটিং।’
খলিলের প্রশ্ন, শুটিং আবার কী জিনিশ? একা-একা আবার চিল্লাচিল্লি-ই-বা কেন?’
আগে তো এমন ছিলো না। খলিল আগে যাত্রাপালা দেখেছে। সেখানে নায়ক-নায়িকা একসাথেই চিল্লাচিল্লি করেছে। কিন্তু এখানে নায়ক একা-একা দাঁড়িয়ে চিল্লানোর মানে কী?

খলিলের কথা শুনে পরিচালক ভেবে নিলো, লোকটার মনে হয় মাথা সাইট, তাই তার এরকম জিজ্ঞাসা। তাই পরিচালক আবারও খলিলকে বোঝাচ্ছে, ‘শুনুন এটা বর্তমান যুগের সিনেমার শুটিং। আপনি এখানে দেখছেন লোকটা একা চিল্লাচ্ছে। সিনেমায় দেখবেন সে নায়িকার সামনেই চিল্লাচ্ছে, বুঝলেন ভাই? এখন আপনি এখান থেকে যান, আমাদের সমস্যা হচ্ছে।’
খলিল একটু ভেবে পরিচালককে বললো, ‘ভাই যাবো, তবে আমার একটা কথা রাখতে হবে। কথাটা হলো, আমার এই ব্লাক বেঙ্গলকে দিয়ে একটা শুটি করাতে হবে।’
পরিচালক খলিলের কথা শুনে হতবাক! বলে কী লোকটা! ছাগলকে দিয়ে শুটিং? আর খলিলের কথা হলো, ব্লাক বেঙ্গল উন্নতমানের ছাগল। ও সব বুঝে, সব করতে পারবে। একপর্যায়ে পরিচালক বিরক্ত হয়ে খলিলকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিলো। খলিল সেই জায়গা থেকে চলে গেল। খলিল যাবার পরপরই A+মাস্টার-সহ চেয়ারম্যান শুটিং স্পটে হাজির।

এলাকার চেয়ারম্যান বলে কথা। পরিচালক-সহ সবাই চেয়ার টেবিল নিয়ে এসে চেয়ারম্যান আর মাস্টারকে বসতে দিলেন। পরিচালকের সাথে কথা হচ্ছে, ‘কোনও সমস্যা হলে আমাকে জানাবেন।’ পরিচালককে বললেন, চেয়ারম্যান। পরিচালক বললেন, ‘সমস্যা তেমন কিছু হচ্ছে না বা হবেও না। তবে একটা সমস্যা হয়ত হবে।
‘কী সমস্যা?’ জানতে চাইলেন, চেয়ারম্যান। পরিচালক বললেন, ‘ওই যে, আপনাদের গ্রামের ছাগলওয়ালা। নামটা যেন কী? তা মনে করতে পারছি না চেয়ারম্যান সাহেব।’
ততক্ষণে A+মাস্টার বুঝে ফেলেছে ছাগলওয়ালা কে? খলিল ছাড়া আর কেউ না। ‘ওর বেয়াদবি সীমা অতিক্রম করছে, চেয়ারম্যান সাহেব।’ বললেন, A+মাস্টার।
এদিকে খলিল ব্লাক বেঙ্গলকে সাথে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। যেতেই খলিল দেখতে পাচ্ছে যে, একটা মেয়ে মোবাইল ফোন সামনে রেখে কি যেন করছে। খলিল মেয়েটির সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কে?’
সাথে থাকা লোকজন উত্তর দিলো, ‘উনি হচ্ছেন শুটিং-এর নায়িকা।’
নায়িকার কথা শুনে খলিল চমকে উঠল। বললো, ‘আপনি এই শুটিং-এর নায়িকা?’
নায়িকা জবাব দিলো, ‘হ্যা, বলুন কোনও সমস্যা?’
খলিল বললো, ‘না কোনও সমস্যা না, তবে কিছু জানতে চাই।’
নায়িকা বললো, ‘হ্যা, বলুন কী জানতে চান?’
খলিল জানতে চাইল, ‘আপনি এতক্ষণ
একা-একা মোবাইল মুখের সামনে রেখে কী করেছেন?’
জবাবে নায়িকা বললো, ‘ওহ আমি মোবাইল দিয়ে, কী করেছি?’ আমি সেলফি তুলেছি, সেলফি!’
খলিল আবারও জানতে চাইলো, ‘সেলফি কাকে বলে? সেলফি দিয়ে কী হয়? কেন-ই-বা এই সেলফি তোলা?’
খলিলের কথা শুনে নায়িকা বিরক্ত হয়নি। হেসেই জবাব দিলো, ‘সেলফি তুলে ফেসবুকে আপলোড করবো। লাইক বাড়বে, কমেন্ট বাড়বে। বাড়বে আমার জনপ্রিয়তা আর ফলওয়ার।’
খলিল বলছে, ‘এটা আবার কী? ফেসবুক কাকে বলে? এটা কোথায়? কীভাবে করতে হয়?’
নায়িকা হেসে বললো, ‘ফেসবুকে আগে আইডি খুলতে হয়, পরে সেলফি তুলে ফেসবুকে দেওয়া যায়। আইডি না খোলা পর্যন্ত ফেসবুকে সেলফি দেওয়া যায় না।’

নায়িকার কথা শুনে খলিল ভাবছে তার ব্লাক বেঙ্গলের কথা। ব্লাক বেঙ্গলের নামে ফেসবুকে একটা আইডি খোলার চিন্তা খলিলের মাথায় এসে পড়লো। পরে নায়িকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় খলিল বললো, ‘আপা আপনি আমার ব্লাক বেঙ্গলকে একটু আদর করে দিন, যেন ও ভালো থাকে।’
নায়িকা জিজ্ঞেস করলো, ‘এটা আপনার ছাগল?’
খলিল বললো, ‘হ্যা আপা আমার ব্লাক বেঙ্গল। উন্নতমানের ছাগল। মানুষের সব কথাই বুঝে, কিন্তু নিজে কিছু বলতে পারে না।’
নায়িকা খুশি হয়ে ব্লাক বেঙ্গলকে আদর করলো। ভালো থাকার জন্য দোয়াও করলো।

খলিল নায়িকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেল। এদিকে A+মাস্টার আর চেয়ারম্যান তখনো শুটিং স্পটে বসে পরিচালকের সাথে আলাপ করছে। এমন সময় নায়িকা শুটিং স্পটে এসে হাজির হলো। নায়িকাকে দেখামাত্র A+মাস্তারের মাথা গরম হয়ে গেল। শুধু মুচকি-মুচকি হাসছে। তখন মাস্টার পরিচালককে বললো, ‘ডাইরেক্টর সাহেব, আমাদের একটা চরিত্র দেওয়া যায় না? আমাদের দুইজনকে একটা চরিত্র দিলে ভালো হয়।’
পরিচালক বললেন, ‘না না, তা সম্ভব না। কারণ, অভিনয় করার আগে অভিনয় শিখতে হয়। অভিনয় না শেখা পর্যন্ত অভিনয় করা যায় না।’
মাস্টার বললো, ‘আমাদের অভিনয় শিখতে হবে না। যে কোনও অভিনয় আমরা করতে পারবো। একটা চান্স দিলে আপনারই ভালো হবে পরিচালক সাহেব। এখানে আর কেউ ছাগল নিয়ে এসে আপনাকে ডিস্টার্ব করতে পারবে না। এটা একশতে একশো, কি বলেন চেয়ারম্যান সাহেব?’ পরিচালকের সাথে থাকা একজন বুদ্ধি দিলো, তাদের দুইজনকে একটা চরিত্র দিলে ভালোই হবে। কারণ, তারা এই গ্রামের বিজ্ঞ লোক, সবাই তাদের ভয় পায়। এখানে এসে আর কেউ মাস্তানি করতে পারবে না।
ওই লোকের কথা শুনে পরিচালক রাজি হয়ে যায়, সময়মত তাদের একটা চরিত্র দেওয়া হবে। পরিচালকের কথা শুনে চেয়ারম্যান আর মাস্টার মহা খুশি।

এদিকে খলিল বাড়ি এসে ব্লাক বেঙ্গলের নামে ফেসবুকে একটা আইডি খুললো। প্রোফাইল ছবিটা লাগিয়েছে ব্লাক বেঙ্গলের ছবি। কিন্তু কেউ আর লাইক কমেন্ট দেয় না। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টও কেউ করে না। লজ্জা আর বিরক্তিকর অবস্থায় দিন কাটছে খলিলের। খলিল ভেবেচিন্তে ব্লাক বেঙ্গলকে সাথে নিয়ে আবার নায়িকার কাছে এলো। নায়িকা খলিলকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ-রে খলিল ভাই কেমন আছেন? আপনার ব্লাক বেঙ্গল কেমন আছে?’
খলিল মুখ বেজার করে জবাব দিলো, ‘বেশি ভালো না আপা।’
নায়িকা জানতে চাইলো, ‘কেন কী হয়েছে খলিল ভাই? বলেন একটু শুনি! ‘
খলিল কাঁদা কাঁদা স্বরে জবান দিলো, ‘না আপা তেমন কিছু হয়নি। তবে আমার ব্লাক বেঙ্গলকে কেউ লাইক কমেন্ট দেয় না। এই নিয়েই একটু চিন্তায় আছি।’
খলিলের কথা শুনে নায়িকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বললেন? আপনার ব্লাক বেঙ্গলের ফেসবুক আইডি খুলেছেন?’
খলিল বললো, ‘হ্যা আপা আপনি না বলেছেন, ফেসবুক আইডি থাকলে সেলফি দেওয়া যায়। মানুষে লাইক কমেন্ট দেয়, ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়। কই, আমার ব্লাক বেঙ্গলকে কেউ লাইক দেয় না, আর কমেন্টও দেয় না। আপনি যদি আমার ব্লাক বেঙ্গলের সাথে একটা সেলফি তুলতেন, তা হলে মানুষ লাইক কমেন্ট দিবে। এ ছাড়া আর কেউ আমার ব্লাক বেঙ্গলকে লাইক কমেন্ট করবে না।’
নায়িকা খুব ভালো মানুষ, তার রাগ বলতে শরীরে নাই। বিরক্তি না হয়ে বলছে, ‘খলিল ভাই, আমি আপনার ছাগলের সাথে সেলফি তুললে মানুষ লাইক কমেন্ট দিবে? যদি তা-ই হয়, তা হলে আমি আপনার ছাগলের সাথে সেলফি তুলে দিচ্ছি।’
খলিল খুশি হয়ে বললো, ‘হ্যা আপা আমার ব্লাক বেঙ্গলের সাথে আপনার সেলফি থাকলে, মানুষ শুধু ছপছপ করে লাইক কমেন্ট দিবে। মানুষ তো আপা বুঝে না, আসলে এটা কী? কার আইডি ব্লাক বেঙ্গল কে? মানুষ আপনার ছবি দেখেই পাগল হয়ে যাবে। আর আমার ব্লাক বেঙ্গলকে লাইক কমেন্ট-সহ ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট করবে। দয়া করে একটা সেলফি তুলুন।’

খলিলের অনুরোধে নায়িকা ছাগলের সাথে দুই-তিনটা সেলফি তুলে দিলো। খলিল ব্লাক বেঙ্গলকে নিয়ে চলে এলো বাড়ি। ফেসবুকে ছাগলের সাথে নায়িকার তোলা সেলফি আপলোড করে দিলো। দশ মিনিটের মধ্যে ফেসবুকে লাইকের পাহাড় জমে গেল। কমেন্ট করতে শুরু করলে, হাই, ফাইন, কেমন আছেন, শুভেচ্ছা রইলো ইত্যাদি ইত্যাদি। খলিল খুশিতে প্রায় পাগল হয়ে যাবার পালা। দৌড়ে গিয়ে নায়িকাকে জানালো। খলিলের কথা শুনে নায়িকাও মহা খুশি। এদিকে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো খলিলের ছাগলের ফেসবুক আইডির কথা। গ্রামের যে-না-সেই খালি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আর লাইক কমেন্ট দিতে লাগলো।

এদিকে গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে খবর গেলো। চেয়ারম্যানও দেখলো, ফেসবুক আইডিতে ছাগলের সাথে নায়িকার ছবি। তা দেখে চেয়ারম্যান সাহেবও একটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। খবর গেলো A+মাস্টারের কাছে। মাস্টার তো রেগেমেগে অস্থির। মাস্টার ভাবছে ছাগলের সাথে যখন নায়িকা সেলফি তুলেছে, তা হলে আমিও পারবো।

এখন মাস্টার সাহেবেরও শখ হচ্ছে নায়িকার সাথে সেলফি তুলতে। তাই একটা ফুলের তোড়া নিয়ে নায়িকার কাছে যায়। গিয়ে দেখে, সেখানে খলিল দাঁড়িয়ে নায়িকার সাথে কথা বলছে। খলিলকে দেখে মাস্টার রেগেমেগে বকুনি দিয়ে খলিলকে সরিয়ে দিলো। মাস্টার ফুলের তোড়াটা পেছনে রেখে নায়িকাকে বলছে, ‘ম্যাডাম আপনি আমাদের গ্রামে এসেছেন, তা অনেক দিন হলো। অথচ আপনাকে আমার তরফ থেকে কিছুই দিতে পারিনি। তাই আজ আমি আপনাকে কিছু দিতে এসেছি, দয়া করে গ্রহণ করবেন।’
এদিকে মাস্টারের পেছন থেকে খলিলের ব্লাক বেঙ্গল ফুলের তোড়ার ফুলগুলো খেয়ে ফেলেছে। ব্লাক বেঙ্গল যে ফুলের তোড়ার ফুল খেলো, তা আর কেউ দেখেনি।

মাস্টারের কথা শুনে নায়িকা বলছে, ‘ঠিক আছে স্যার, দিন কী উপহার দিবেন।’
A+মাস্টার খুশিতে পাগল হয়ে পেছনের হাত সামনে এনে, দুইহাতে ফুলের তোড়াটা ধরে নায়িকাকে বলছে, ‘নিন আমার ছোটে একটা উপহার।’
ফুলের তোড়ায় ফুল নাই দেখে উপস্থিত সবাই হাসতে লাগলো। নায়িকাও হাসছে, সাথে খলিলও হাসছে। মাস্টারের চোখ দুটো রক্তবর্ণ হয়ে গেল। তোড়া আছে, ফুল নাই। ফুল কী হলো? ফুল খেয়েছে খলিলের উন্নতমানের ছগলে। মাস্টার লজ্জায় মাথানিচু করে শুটিং স্পট ত্যাগ করলো।

খলিল এখন এলাকার একজন পরিচিত মুখ, সাথে আদর আর সম্মানও আছে। প্রথম যেই চাচা খলিলকে পাগল বলেছে, সেই চাচাই একদিক খলিলকে বলছে, ‘খলিল তোমার ছাগলের না-কি ফেসবুক আইডি আছে?’
চাচার কথায় খলিল জবাব দিল, ‘হ্যা চাচা আছে।’
চাচা বললো, ‘তোমার চাচী একটা রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে, এক্সেপ্ট করে দিও।’
খলিল মুচকি হেসে চাচাকে বললো, ‘আচ্ছা চাচা করবো।’
চাচা খুশি হলেন, যাবার সময় খলিলকে বলছে, ‘দেখো খলিল, তোমার ছাগলটা যেন হারিয়ে না যায়! সামনে কোরবানির ঈদ বাবা, দেখেশুনে রেখো।’
খলিল চাচাকে কিছু বলার আগেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল ছাগল নেই। খলিলের মাথা নষ্ট হয়ে গেল। আমার ব্লাক বেঙ্গল কোথায়? কোথায় গেলো, ব্লাক বেঙ্গল, ব্লাক বেঙ্গল বলে ডাকতে ডাকতে খলিল শুধু দৌড়াচ্ছে। কোথাও আর ব্লাক বেঙ্গলকে পাওয়ে যাচ্ছে না, খলিল শুধু কাঁদছে। খলিলের আহার নিদ্রা হারাম হয়ে গেল, খলিলের কিছুই ভালো লাগছে না। খলিল রাস্তার ধারে একা-একা বসে ব্লাক বেঙ্গলের জন্য কাঁদছে।

এমন সময় নায়িকা দলবল নিয়ে শুটিং স্পটে যাচ্ছিল। নায়িকার চোখ গেল খলিলের দিকে। একি! ‘আ-রে খলিল ভাই, আপনি এখানে একা-একা? কী করছেন শুনি?’
খলিল নায়িকার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। নায়িকা বললো, ‘আপনি কাঁদছেন কেন, বলুন কী হয়েছে?’
খলিল কেঁদে-কেঁদে বললো, ‘আপা আমার ব্লাক বেঙ্গলকে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হয় ওকে কেউ চুরি করেছে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না, আপা।’
খলিলের এ অবস্থা দেখে নায়িকা তার সাথে থাকা সাঙ্গপাঙ্গদের ডেকে কী যেন বললো, তা আর বোঝা গেল না। নায়িকার কথামত সবাই চলে গেল, নায়িকার বুদ্ধিমত কাজ করতে। পরে নায়িকা খলিলকে বললো, ‘খলিল ভাই আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আপনার ব্লাক বেঙ্গল আজই পাওয়া যাবে।’
খলিল নায়িকাকে বললো, ‘তা-ই যেন হয় আপা, না হয় আমি বাঁচবো না।’
নায়িকা খলিলকে আবারও আশ্বাস দিয়ে খলিলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুটিং স্পটে চলে গেল।

এদিকে নায়িকার সাঙ্গপাঙ্গরা এলাকায় জানিয়ে দিল যে, ‘যেই ব্যক্তি খলিলের ছাগলের সন্ধান দিতে পারবে, তার সাথে নায়িকা নিজে সেলফি তুলবে।’
ঘোষণা করতে দেরি, ছাগলের সন্ধানে আর নামতে দেরি নেই। হায় সেলফি! হায় সেলফি! কোথায় ছাগল আর কোথায় খলিলের ব্লাক বেঙ্গল? গ্রামের ছেলে বুড়ো সবাই তখন খলিলের ছাগল খোঁজা শুরু করে দিলো। অনেকে নায়িকার সাথে সেলফি তোলার লোভে বাজার থেকে অন্য ছাগলও কিনে আনতে শুরু করলো। কেউ আবার নায়িকাকে খুশি করানোর জন্য বিশাল বিশাল গরুও কিনে আনছে। গ্রামের চেয়ারম্যানও একটা গরু কিনে নায়িকার কাছে নিয়ে আসে। নায়িকা বলছে, ‘আপনি এটা কী করেছেন চেয়ারম্যান সাহেব? এটা তো ছাগল না, গরু।’
চেয়ারম্যান বললো, ‘দূর রাখেন আপনার ছাগল, বড়সড় একটা গরুই দিয়ে দিলাম, আপনার সাথে সেলফি তোলার জন্য।’

এভাবে শুটিং স্পট এখন গরু ছাগলের হাটে পরিণত হয়ে গেল, কিন্তু খলিলের ছাগলের কোনও সন্ধান মিলছে না। এমন সময় A+মাস্টার খলিলের ছাগল নিয়ে নায়িকার কাছে হাজির। হাতে এনড্রয়েড মোবাইল রেডি আছে নায়িকার সাথে সেলফি তোলার জন্য। উপস্থিত সবাই তখন অবাক হয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। চেয়ারম্যান রেগে তেড়ে এসে মাস্টারকে বললো, ‘আপনি এই ছাগল কোথায় পেলেন? মাস্টার হয়ে ছাগল চুরি করেছে?’
মাস্টার তখন চেয়ারম্যানকে ধমক দিয়ে বললো, ‘দূর যান তো সামনে থেকে, আগে নায়িকার সাথে সেলফি তুলে নেই, তারপর কথা।’
মাস্টার নায়িকার সামনে গিয়ে বলছে, ‘নেন আপনার খলিলের ছাগল। রেডি হন্ সেলফি তুলবো।’
এমন সময় খলিল শুটিং স্পটে আসলো। নায়িকা খলিলকে দেখে চিৎকার করে ডেকে বললো, ‘খলিল ভাই আসেন আসেন, আপনার ব্লাক বেঙ্গলকে পাওয়া গেছে।’

খলিল দৌড়ে সামনে আসলো, নায়িকা ব্লাক বেঙ্গলের গলার দড়িটা খলিলের হাতে ধরিয়ে দিলো। খলিল ব্লাক বেঙ্গলকে কাছে পেয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলো। নায়িকা খলিলকে বললো, ‘হয়েছে খলিল ভাই হয়েছে, আপনার ব্লাক বেঙ্গলকে পেয়েছেন তো? এবার আর কাঁদবেন না। ওকে নিয়ে এখন বাড়ি চলে যান। আর দেখে রাখবেন, আবার যেন চুরি হয়ে না যায়।’
জবাবে খলিল বললো, ‘ওর আর কিছুই হবে না আপা, এই ঈদেই ওকে কোরবানি দিয়ে দিবো।’
নায়িকা-সহ উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল। খলিল বলে কী? ওর এতো আদরের আর ভালোবাসার ব্লাক বেঙ্গলকে কিনা কোরবানি দিবে! নায়িকা খলিলকে বললো, ‘খলিল ভাই আপনার এতো আদরের ভালোবাসার ব্লাক বেঙ্গলকে কোরবানি দিবেন কেন?’
খলিল তখন বললো হ্যা আপা, কোরবানি দিবো বলেই তো ওর প্রতি আমার এতো আদর আর ভালোবাসা। আজকাল মানুষ পশু কোরবানি দেয়, কিন্তু পশুটাকে ভালোবেসে কেউ কোরবানি দেয় না। কোরবানির জন্য গরু কিনতে গেলে, আগে দেখে গরুটি জবাই করলে কতোটুকু গোস্ত হবে। প্রতি কেজি গোস্তের মূল্য কত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে আমরা কী কোরবানি দেই, না-কি একটা পশুকে জবাই করে মানুষকে দেখাই? আসলে সত্যিকারার্থে কোরবানি দেওয়ার নিয়ম কী এবং কীভাবে দিতে হয়?’

খলিলের কথা শুনে উপস্থিত সবাই মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এতক্ষণে সবাই বুঝতে পেরেছে যে, খলিল কেন এই ছাগলটাকে এতো আদর আর ভালোবাসলো। তখন নায়িকা আর পরিচালক-সহ উপস্থিত সবাই মিলে একটা নাচগানের আয়োজন করলো। গানটি গেয়েছে ঈদ-উল-আযহা নিয়ে।

নাটকটি দেখে মনে-মনে ভাবছি যে, আমাদের দেশে এখনো ভালো-ভালো নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। অথচ ওই ভারতীয় চ্যানেল গুলোর জন্য আমাদের দেশের অগণিত মা-বোনেরা ওইগুলো ছাড়া কিছুই বুঝে না। আমাদের দেশের নাটকে, চলচ্চিত্রে অনেককিছু বোঝার আছে শিখার আছে। আমরা আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও গ্রামবাংলার দৈনন্দিন জীবন নিয়ে তৈরি করা নাটকগুলো দেখি না। দেখি স্টার জলসার সিরিজগুলো। যা আমার নিজের সংসারেও এক ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওইসব ভারতীয় সিরিজগুলোতে কী যে এমন মধু মাখিয়ে দিয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। আমরা এখন আমাদের দেশের ছায়াছবি দেখি না, দেখি না দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটকগুলো। এটা কিছুতেই মানে নিতে পারছি না, আবার কিছুই করতে পারছি না। দুঃখ শুধু থেকেই যায়, এ নিয়ে আমাদের অনেককিছুই করার বাকি থেকে গেল।

পরিশেষে:
‘ব্লাক বেঙ্গল’ নাটকটি নির্মাণ হয়েছে শুধু ঈদ-উল-আযহা নিয়ে। আর মাঝখনে বুঝিয়ে দিয়েছে বর্তমান যুগের ফেসবুক পাগলদের। সেলফি তুলতে গিয়ে কতনা বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, সেটাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আজকাল ফেসবুক ছাড়া যেন মানুষ কিছুই বুঝে না। তাই তাদের উদ্দেশ্য করে কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। নাটকটির পুরাপুরি কাহিনী আমি এখানে লিপিবদ্ধ করে দেখাতে পারি নাই। আগেপাছের আরও অনেককিছুই বাদ আছে। পুরাপুরিভাবে দেখতে চাইলে নিচে দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করবেন। যারা দীপ্ত টিভিতে এই ঈদ আয়োজনটি দেখতে পারেনি, তারা অবশ্যই দেখবেন। আশা করি সবাইর ভালো লাগবে।

আমার কিছু কথা:
নাটকটি পুরোপুরি দেখার পর ভাবলাম যে, এমন সুন্দর নাটকটি অনেকেই হয়ত দেখেনি। তাই আমার ইচ্ছা হলো নাটকটির সংলাপ পুরোপুরিভাবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে। নাটকের পুরোপুরি সংলাপ অবশ্য উপস্থাপন করতে পারিনি, তবু একেবারে কমও হয়নি। একটি কাহিনী যদি কেউ শুরু করে, তা মাঝপথে কিছু বাদ দেওয়া যায় না। যদি কোনও কারণবশত অনেক কিছু বাদ পরে যায়, তা হলে সেই লেখার মজাটাই নষ্ট হয়ে যায়। তাই আমি নাটকটির পুরো কাহিনীর সংলাপ এখানে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। কিন্ত্য_লেখা অনেক বড় হয়ে যায় বলে, মাঝে-মাঝে কিঞ্চিৎ বাদ দিয়ে নাটকটির একতৃতীয়াংশ সংলাপ এখানে তুলে ধরেছি মাত্র। আশা করি প্রিয় পাঠকবৃন্দ একটু সময় নষ্ট করে, ঈদ-উল-আযহার হাসির নাটকটি নিয়ে আমার লেখাটা পড়বেন।

ঈদ-উল-আযহার আনন্দের জন্য নির্মিত হয়েছিল, বিশেষ নাটক ‘ব্লাক বেঙ্গল : দ্য সেলফি হিরো’। নাটকটিতে অভিনয় করেছেন জাহিদ হাসান, প্রাণ রায়, এনামুল হক, টয়া প্রমুখ। নাটকটি দীপ্ত টিভির ঈদ আয়োজনে ঈদের দ্বিতীয় দিন রাত ৮টা ৩০ মিনিটে প্রচার হয়েছিল।

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ