আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ মানে অগ্রজদের কাছ থেকে শুনে শুনে সেইসব ভয়াবহ দিনে ফিরে যাওয়া, অনুমান করে নেয়া যে, একটি দেশকে শত্রুমুক্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনার গল্পটি যতটা সহজে শুনছি, প্রেক্ষাপট ততটা সহজ ছিল না। বাবা বলতেন, সেইসময়ে শহর ছেড়ে গ্রামে কিংবা গ্রাম ছেড়ে শহরে পলায়নপর এক বিভীষিকাময় জীবন ছিল তাঁদের। এ পলায়ন স্ত্রী, সন্তানদের জীবন বাঁচাবার জন্যে, পিছনে থেকে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে।বাবা সপরিবারে রওয়ানা দিতেন পায়ে হেঁটে দশ মাইল দূরের গ্রামের দিকে। পথিমধ্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঁধার মুখে পড়তেন দফায় দফায়। কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা সদয় হতেন বাবাকে স্পষ্ট উচ্চারণে উর্দু ভাষায় কথা বলতে পারার কারনে। আমার এক মামা, যে কিনা মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন না। সবসময় ভীত সন্ত্রস্ত জীবন কাটাতেন। আতংকিত থাকতেন, বাইরে বের হতেন না ভয়ে। সেই সহজ, সরল মানুষটিকেও একদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দুইদিন পর তাঁর গুলিবিদ্ধ লাশ নদীতে ভেসে উঠে। আট সন্তান নিয়ে মামীর একার যুদ্ধ শুরু হয় সেইদিন থেকে। ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস যদিও, কিন্তু আমার সেই মামী বিজয়ী হয়েছেন তারও অনেক পরে, বহু বছর পর। প্রতিটি সন্তান ভাল মানুষ হয়ে দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েও গ্রামে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছে যেদিন থেকে, সেইদিন আমরা স্বজনরা আবেগাপ্লুত হয়ে মনে মনে বিজয়ানন্দ অনুভব করেছি।
যুদ্ধকালীন সময়ের আরেকজন কিশোরের গল্প শুনেছি। দুরন্ত কৈশোরে মানুষের সবচেয়ে নির্ভরতার স্থান, আব্দার, আহ্ললাদ, কিংবা অধিকারের স্থান তাঁর পরিবার। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার এই স্থানটি যদি আচ্মকা একদিন চোখের সামনে নাই হয়ে যায়, তবে সেই কিশোরের মানসিক অবস্থা হয়ে উঠে অনেকটা গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যাবার মতই। মমতাময়ী মা, বটবৃক্ষের মত ছায়া দিয়ে যাওয়া বাবা, খুনসুটিতে কাটানো স্নেহের ভাইবোন, সবাইকে চোখের সামনে পুড়িয়ে মারা হলে সেই কিশোরের বেঁচে থাকার আর কোন অবলম্বন থাকে না। তাঁর চোয়াল, হাতের মুঠি শক্ত হয়ে উঠে তীব্র এক ঘৃণায়, প্রতিশোধস্পৃহায়। নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সে হয়ে উঠে প্রতিশোধ পরায়ণ। যুদ্ধে তাঁর চোখের সামনেই পাকিস্তানী সৈন্যরা পুড়িয়ে মেরেছে তাঁর প্রানপ্রিয় বাবা-মা, ভাইবোন সবাইকে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সেই কিশোর। কিন্তু কতটা যন্ত্রণাময় সময়ের মধ্য দিয়ে গেলে একজন মানুষ তাঁর বেঁচে থাকার সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ? তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা বুকে পুষে সে হয়ে উঠে একজন সুইসাইডাল মুক্তিযোদ্ধা।
মাঝে মাঝে বৈকালিক চায়ের সময়টাতে গরম চা'য়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শাশুড়ি আম্মা যুদ্ধের সময়কার( আম্মার ভাষায় গণ্ডগোলের সময়) গল্প করেন। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, আম্মার বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই, অনেককিছুই মনে রাখতে পারেন না। কিন্তু সাতচল্লিশ বছর আগের যুদ্ধের সময়কার দুর্বিষহ ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেন। বললেন, গোলাগুলির সময়ে ভয়ে আতংকে কেঁপে উঠা এক বৃদ্ধ আত্মীয়কে মসজিদের ভেতরে নামাজরত অবস্থায় গুলি করে মারা হয়েছিল। তাঁর অপরাধ ছিল তাঁর তরুণ পুত্রদ্বয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। আম্মা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবারো বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বেশিরভাগ বাঙালি মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেও গুটি কতেক বাঙালি পাকিস্তানীদের পক্ষাবলম্বন করে। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানীদের সাথে একজোট হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ' শান্তি কমিটি ' নামে সংস্থা গড়ে তোলে। এই কমিটির কাজই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের নিশ্চিহ্ন করা। এরা নিরীহ মানুষকে টাকা এবং চাকুরির লোভ দেখিয়ে রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখাত। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় হোক আর দেশপ্রেমের তাগিদে হোক এমন অনেক যুবক রাজাকার বাহিনীতে নাম লেখালেও সকলের অজানার মাঝে তাঁরা ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানিদের নিশ্চিহ্ন করার কৌশল অবলম্বন করেছিল সফলতার সাথে। এর বিপরীত চিত্রও ছিল। কিন্তু ইতিহাস হত্যাকারী, নির্যাতনকারী, অপরাধীকে কখনো ক্ষমা করে না। এরা চিরকাল ঘৃণাভরে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত। যুগ যুগ ধরে এদের কৃতকর্মের জন্যে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা সমাজে হেয় হয়ে থাকে।
বিদেশ বিভূঁইয়ে বেড়ে উঠা আমাদের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতা এবং বিজয়ের ইতিহাস জানানো জরুরী। মাঝে মাঝেই আমরা এ বিষয়ে তাঁদের সাথে আলোচনা করি। তাঁরা রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে শুনে। আমি প্রায়ই স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশী কমিউনিটি আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতাগুলোয় অংশগ্রহন করতে বলি। কেননা তারই প্রস্তুতি সরূপ তাঁরা নেট ঘেঁটে এ সম্পর্কে আরও ব্যপকভাবে বিস্তারিত জেনে নেয়। এবং নিজের মত করে লিখে ফেলে দীর্ঘ এক রচনা, কেমন করে বাংলাদেশ নামের মানচিত্রটি আমাদের হোল, কেমন করে লাল-সবুজের বিজয় নিশান আমাদের হোল।
১৪টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মনের মত একটি লেখা পড়লাম।আসলে আপা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো বেশী বেশী করে লিখতে হবে জানাতে হবে এ নতুন প্রজন্মদের যাতে তারা মুক্তিযুদ্ধ বিমুখ না হয়।আপনার মামীর প্রতি রইল সমবেদনা এবং শ্রদ্ধা।ভাল থাকবেন।
রিমি রুম্মান
আরও অনেক কিছু লেখা যেতো। সময় স্বল্পতায় ছোট করতে হোল। আগামীতে লিখবো ইনশাল্লাহ।
জিসান শা ইকরাম
১৯৭১ সনে যদিও ক্লাস ফোর এ পড়তাম, তারপরেও স্পস্ট মনে আছে সে সময়ের পলায়নপর, আতংকিত জীবনকে। মাইলের পর মেইল হেঁটেছি মাঝে মাঝে। আমার বড় চার ভাই মুক্তিযোদ্ধা, এদের খূজে পাবার জন্য আমাদের আব্বাকে ধরার জন্য প্রায়ই আমাদের পলাতক বাড়িতে আসতো রাজাকাররা। এই ৯ মাসে একমাসের বেশি কোনো বাড়িতে থাকিনি।
হ্যা দিদিভাই, সন্তানদের অবশ্যই ১৯৭১ এর যুদ্ধের কথা জানাবে, শত্রু মিত্র চেনাবে।
অনেক ভাল একটি লেখা।
রিমি রুম্মান
আমরা অগ্রজদের কাছ থেকে আরো বেশি বেশি শুনতে চাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে। সেইসব মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুতই।
স্বপ্ন নীলা
সময় উপযোগী একটি পোস্ট ! মুক্তিযুদ্ধে কত নারীযে পিছন থেকে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে, কত নারী যে শক্র সেনাদের দ্বারা লঞ্চিত হয়েছে, ধর্ষিত হয়েছে—- সকল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রইল শ্রদ্ধা
রিমি রুম্মান
বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা বিজয়ের মাসে। ভালো থাকুন সবসময়য়।
মাহমুদ আল মেহেদী
সেই সময়ের মানুষগুলির বির্সজন কে শ্রদ্ধাভরের স্মরণ করি।
তাদের এই ত্যাগের বিনিময়েই আমাদের এই সুন্দর সময় । খুবই ভাল হইছে লেখাটা ।ভাল থাকুন সবসময়।
রিমি রুম্মান
উৎসাহিত হলাম আবারো। ভালো থাকুন সবসময়।
ছাইরাছ হেলাল
যুদ্ধকালীন সেই ভয়াবহতা অনুপুঙ্খ ভাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা
আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
আপনি আমাদের বোধোদয়ের তাগিদের কথা সুন্দর করেই তুলে এনেছেন।
রিমি রুম্মান
ওঁদের না জানালে আমরাই হেরে যাবো যে!
মায়াবতী
খুব সুন্দর পরিচ্ছন্ন একটি লেখা লিখেছেন আপু , আপনাদের মত আমরা সবাই যেন ভবিস্যত প্রজন্ম কে আমাদের অস্বিত্বের সব টুকু জানাতে পারি যথা সম্ভব। এমন লেখা আরো লিখুন আপু । খুবই সময়োপযোগী লেখা আপনার। ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন দোয়া রইলো অনেক অনেক।
রিমি রুম্মান
আপনার জন্যেও শুভকামনা রইল।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু তোমার প্রতিটি লেখাই আমার খুব প্রিয়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে যদি তুলে না ধরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, তাহলে তারা জানার আগ্রহই তো পাবেনা! আগ্রহ গড়ে তোলাটাই আসল। তারপরে ওরা নিজেরাই আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাবে।
বিজয়ের শুভেচ্ছা।
ভালো থেকো। 🌹
রিমি রুম্মান
বিজয়ের শুভেচ্ছা, নীলা’দি। -{@