হিমুর সাথে আমার প্রথম পরিচয় আমার বড় ভাইয়ের মাধ্যমে । তখন কোন ক্লাশে পড়ি মনে নেই । আমার বড় ভাইয়ের খুব গল্প করার শখ । একদিন একটা বই দেখিয়ে জিগ্যাস করলাম ,এটা কি বই ?? দাদা বলল , হিমুর বই । আমি বললাম , হিমু কে ?? শুরু হয়ে গেল দাদার গল্প । কি কি বলেছিল মনে নেই। কিন্তু হিমু অস্বাভাবিক চরিত্র টি আমার মনে গেথে গিয়েছিল । হিমু স্বভাবের যে মানুষটিকে প্রথম দেখি সেও আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিল । নাম সোহেল । আমি সোহেল ভাই বলে ডাকতাম । তিনি আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন । এবং দাদার বন্ধুরা তাকে হিমু বলে ডাকত । জদিও উনি খালি পায়ে হাঁটতেন না বা মাথায় ঝাঁকড়া চুল ছিল না, কিন্তু ওনার মধ্যে একটা অস্বাভাবিকতা ছিল । যা আমার শিশু বয়সেই চোখে পড়েছিল । এই মানুষটিকে আমি খুব পছন্দ করতাম । দাদার বন্ধুরা যখন সবাই মিলে আমাদের বাসায় বসে খেলা দেখত বা সিনেমা দেখত তখন উনি আমার সাথে গল্প করতেন । আমাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতেন এবং খুবই হাস্য কর জবাব দিতেন । ওনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে ২০০৮ সালে । কিন্তু এখন তিনি কোথায় আছেন তা কেউ বলতে পারে না ।

ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে জীবনে প্রথম বই মেলায় যাই । এত এত মানুষএত এত বইয়ের মধ্যে কি কিনব বুঝতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত হিমু সমগ্র বইটাই কিনে ফেললাম। মোট তিনটা গল্প ছিল বইটাতে-- পারাপার,দরজার ওপাশে , হিমু ।দুই দিনে একটানা পড়ে শেষ করে ফেললাম আর সাথে সাথে মাথার তারও ছিঁড়ে গেল সবহিমু পুরোপুরি ভর করল আমার উপর । জদিও আধ্যাত্মিক কোন ক্ষমতার প্রতি লোভছিল না তারপরও হিমু হওয়ার চেষ্টা শুরু করে দিলাম । খালি পায় হাটা,বৃষ্টিতেভেজা,চাঁদ নিয়ে অতিরিক্ত আল্লাদিপনা করা,বিভ্রান্তিকর কথা বলা সব চেষ্টাইকরছিলাম। কিন্তু পুরোপুরি ছাড়া গরু হতে পারি নি বাসার ও যে মিশনে থাকতাম সেখানের কড়াকড়ির জন্য। এজন্য মনে হয় আমার হিমু হয়াও আটকে গেল। তবে বন্ধু মহলে আমি হিমু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলাম ।কিছু শিস্যও আমার জোগাড় হয়ে গিয়েছিল ।তাদের নিয়ে আমি হিমু চর্চা করতে লাগলাম সমানে।কখনও সবাই দল বেধে রমনায় ভিজতে জেতাম টানা বৃষ্টিতে,সবাই বড় বড় চোখ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত আর আমরা অনুভব করতাম “হিমু বোধ হয় হয়েই গেছি” । একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম শীতের নিরাশ্রয় মানুষের মত রাস্তায় শুয়ে থাকব ।আমার শিস্যগণও রাজি হল, বেছে নিলাম নটরডেম কলেজের সামনের ফুটপাথ।কিন্তু রাত দশটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখি তিল ধারনের ঠাই নেই । তারপর আবার পথের মানুষগুলোর গায়ের গন্ধ ও আশেপাশের আবর্জনার কারণে ফুটপাথে বস্তেও পারলাম না । এইদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার পক্ষে হিমু হওয়া সম্ভব না। এইদিন থেকেই সিদ্ধান্ত নিলাম আর শিস্যদের(শিস্য কথাটা আমার বন্ধুরা দিয়েছিল,এবং যাদের বলত তারা কখনও এটা নিয়ে রাগ হয়নি) এড়িয়ে চলব , ওদের মাথা নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না ।তারপরও আমার এই তার ছিঁড়া অবস্থাঅনার্স এ ভর্তি হওয়ার পরও ছিল ।

 ইন্টার শেষ করে বাড়ী ফিরে আসলাম। আমার হিমুগিরিও ধিরে ধিরে কমতে লাগল।কিন্তু ভুতকি সহজে নামে?? এখানেও একজন জুটে গেল একজন, তার সাথে মাঝেমাঝেই হিমু চর্চা করতাম, কিন্তু বড় ভাই আর বাবার শাসনে খুব একটা আগাতে পারলাম না।একবার সময়টা সম্ভবত ২০০৮ সাল । ঢাকায় গেছি ডাক্তারদেখানোর জন্য । উঠেছি আমার পিতৃ বন্ধুর বাসায় ।পিতৃ বন্ধুর কন্যা আমার থেকে মাত্র চার দিনের ছোট । আমাদের দুজনের খুব ভাব । এবং সে আমার হিমু আচরণের একনিষ্ঠ ভক্ত । দুজনে মিলে তাদের ব্যালকনিতে বসে মুখে মুখে হিমু চর্চা করছিলাম । রাতটা ছিল পূর্ণিমা রাত । বাসায় ভয় পাওয়ার মত অভিভাবক ছিল না । আমি বললাম, এখন যদি শাল বনে যাওয়া যেত খুব ভালো হত । সাথেসাথেই কন্যাটি বলল, যদি যেতে চাও তাহলে আমি নিয়ে যেতে পারি । আমি বললাম কিভাবে ??? সে বলল, আমি এখন খুব ভালো ড্রাইভিং করতে পারি । গাড়ি যখন আছে তখন চল ঘুরে আসি । রাত এগারোটার মধ্যে ফিরলে কেউ টেরও পাবে না । আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম , এবং  কন্যাটিও রাজি হল কারণ সে এখনও রাজপথে গাড়ি চালানোর অনুমতি পায় নি , আমার জন্য সাহস নিয়ে রাস্তায় নামছে । ব্যাস শুরু হল আমাদের শাল বন যাত্রা । গাজিপুরের ভিতর কোন একটা জায়গা বেছে নেয়া হল ঘোরার জন্য । আমি চিনি না কিন্তু কন্যাটি চেনে সেই ভরসায়ই যাত্রা । গাজিপুরের ভিতর ঢুকে যাওয়ার পরই ঘটল বিপত্তি । পথে আটকে দিল পুলিশ । গাড়ির কাগজ সাথে থাকলেও আমার ড্রাইভারের কাগজ নেই । এখন কি হবে ?? দুইজনই চিন্তিত । আমাদের বয়সী ছেলে মেয়ে দেখে পুলিশগুলোও মজা পেয়ে গেল ।তারা বিভিন্ন অহেতুক প্রশ্ন শুরু করে দিল । কই যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি?? সাথের মেয়েটি আমার কি হয় ?? বাসা থেকে জানে কিনা আমরা ঘুরতে বেরিয়েছি কিনা ?? ইত্যাদি । শেষ পর্যন্ত ১০০০ টাকা দাবি করল আমাদের কাছে কাগজ না থাকার জন্য । আমার কাছে সব মিলিয়ে ১০০ টাকার মত থাকলেও কন্যাটির কাছে এক টাকাও ছিল না । কারণ টাকা নিয়ে বাইরে আসার কথা আমাদের মনে ছিল না । কিন্তু একশ টাকা তো আর পুলিশ নেবে না । তার আরও প্যাচ খাটাতে লাগল । আমরা দুজন অসহায় সদ্য জুবক যুবতি শুধু তাদের কথা শুনছিলাম । বাসায় যে ফোন করে বলব ঝামেলার কথা তাও পারছি না, জানতে পারলে কারো পিঠের চামড়া থাকবে না । শেষ পর্যন্ত এক বয়স্ক পুলিস আমাদের রক্ষা করল। মানে গুলশান নামিয়ে দেয়ার শর্তে আমরা মুক্তি পেলাম । কিন্তু আমাদের জোছনা বিলাস মাঠে মারা গেল ।

এটাই ছিল আমার শেষ হিমু চর্চা । এখন এসব ভাবলে কেমন জানি লাগে । কি সব পাগলামিই না আমি করেছি একটা সময় । সব কিছু এখন নিরর্থক মনে হয় । তবে লেখক হিসাবে হুমায়ুন আহমেদ যেমনই হন না কেন যুবক বয়সের মানুষদের তার লেখনি তে বেধে রাখার ক্ষমতা তার ছিল ।

(মনের কোণে এখনও একটা হিমু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে , সুযোগ পেলেই বেরিয়ে আসে)  

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ