এখনও পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন মানুষেরা বিবাহিত নারীর নামের লেজ কেটে জোড়া লাগাতে গর্ববোধ  করেন ভেবে আশ্চর্য হই!
এখনও? এই সময়ে এসেও?

একটা সময় ছিল, যখন এটা একটা ফ্যাশন ছিলো। সত্তরের দশক পর্যন্ত এটি ছিল তথাকথিত এলিট শ্রেনীর ফ্যাশন। বলা যায়, প্রচলিত সামাজিক ধারা। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে এর প্রভাব মধ্যবিত্তের মাঝেও পড়তে শুরু করে। উল্লেখ্য যে, হিন্দু সম্প্রদায়ে তা ধর্মীয় রীতি হলেও মুসলিম সম্প্রদায়ে ব্যাপারটা পুরুষতান্ত্রিকতারই ধারাবাহিতারুপে স্থানালাভ করে। সে সময়ে বিবাহিতা প্রায় সকল নারীর নামেই এ পরিবর্তনটা স্থায়ীভাবে স্থানালাভ করতে শুরু করে। এর কারণ, তখনকার সময়ে অফিসিয়াল কাগজপত্রে অবিবাহিতা নারীর নাম দস্তখতের কোন প্রয়োজনই তেমন দেখা দিতো না। আর বিয়ে পরবর্তী দিলে তা নতুনরুপেই স্থান পেতো এবং এভাবেই তা স্থায়ীরুপ লাভ করে।
দেখা যেতো, এই কর্তন পরবর্তী সংযোজন কাজে কেবল পুরুষই নয়, সময়ে নারীরাও মুখিয়ে থাকত। উভয়েই এই ব্যাপারটিতে বিশেষ গর্ববোধ করতেন। অনেক নারীকেই দেখতাম বিয়ে হতে না হতেই লেজ কেটে জোড়া দিয়ে ফেলেছেন। '৯০ পরবর্তী সময়ে নারী শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতির ফলে ব্যক্তি সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নারী ভাবাবেগেও স্বকীয়তাবোধ জাগ্রত হয়। ফলে ফ্যাশনের নামে অকারণ চেপে বসা ব্যাপারটি থেকে সচেতন নারীরা সরে আসতে শুরু করেন।
আর এখন তো নামের পরিচয়টি স্মার্টকার্ডের মাধ্যমে ভোটার হওয়ার সাথেসাথেই স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়নের সময়েই এই লেজ কর্তন বর্ধন কর্মের পরিসমাপ্তি ঘটে। সে হিসাবে তখন যারা যেমনভাবে তাদের নাম লিখেছেন সেভাবেই এখন তাদের পরিচিতি দাঁড়িয়েছে।

এ ব্যাপারটা প্রথম আমার দৃষ্টি কেড়েছে সম্ভবত '৯০ এর দশকের কোন এক সময়ে। অভিনেত্রী রোজী সিদ্দিকী তখন রোজী আরেফিন নামে নাটকে বেশ পরিচিত। তখনটায় সাপ্তাহিক বিনোদন বলতেই ছিলো বাংলা নাটক। সবাই মুখিয়ে থাকতো নাটক দেখার জন্য। একদিন দেখি রোজী আরেফিন হয়ে গেছেন রোজী সিদ্দিকী। প্রশ্ন থেকে উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো তাঁর জুড়ে দেয়া লেজটি কাটা পড়েছে। অর্থাৎ কথিত আরেফিন সাহেবের সাথে তাঁর ডিভোর্স হয়ে গেছে। তখনই আমার প্রশ্ন ছিলো, যে সম্পর্কটি কাগজের উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো, সেটাতে আমিত্বের পরিবর্তন করে কেন মানুষ? কাগজের সম্পর্ক কাগজ মেনটেইনের উপর নির্ভর করে। দুদোল্যমান একটি সম্পর্ক। কিন্তু জন্মগত নামটির সাথে মানুষের জন্মের সম্পর্ক। জন্মের মাধ্যমে একটি মানুষের জীবনের শুরু হয়ে মৃত্যু দিয়েই তা শেষ হয়। জন্মের মধ্য দিয়ে জীবনের শুরুতে পৃথিবীর বুকে মানুষ যে নামে পরিচিতি পায় মৃত্যু দিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও পৃথিবীতে তার আগমনের পরিচয় তার নামের মাঝেই রয়ে যায়। চিরসত্য এই ব্যাপারটিকে কি করে মানুষ জীবনের মাঝামাঝি সময়ে এসে নামের শেষে অন্য একজন মানুষের নাম জুড়ে দিয়ে আমিত্বের অস্তিত্ব অবলীলায় বিলীন করে দেয়?

একসময় সামাজিক ধারা (সনাতনীদের বেলায় ধর্মীয় ধারা) বা ফ্যাশনের আড়ালে এটি ছিলো পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজালে নারীর স্বকীয়তা বিসর্জনের একটি অপকৌশল। অজ্ঞাতে নারীও এটাকে আভিজাত্য বা ফ্যাশনের প্রতীক হিসাবে নিজের মধ্যে অলংকরণ ঘটিয়েছে। না বুঝে নারী যেমন এভাবে অলংকৃত হয়ে এক ধরনের পুলকিতবোধ করেছেন, অনেক পুরুষও বউয়ের নামের শেষে নিজের নাম জুড়ে দিয়ে বেশ পুলকিতবোধ করেন। দু'য়ের মধ্যেই ব্যাপারটা পুলকিত ভাবের সৃষ্টি করে।

ব্যাপারটা নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবতই লিখব ভাবছিলাম। হয়ে উঠছিল না। লিখার প্রয়োজনবোধের কারণ হচ্ছে, প্রায়ই কিছু মিসেসের ফেসবুক আইডি দেখছি, যাদের মিস্টারদেরও চিনি। বয়সে এরা প্রায় সকলেই তরুণী। হিসাব অনুযায়ী ২০০৮ পরবর্তী ভোটার এবং বিবাহিতা। সে হিসাবে নিশ্চিতভাবেই এদের ভোটার আইডি কার্ডে জন্মকালীন সময়ের নামটিই আছে। অথচ এই ফেসবুকে তাদেরকে মিসেসরুপে (নিজ নামের পরিবর্তে লেজ কাটা নামের আইডিতে) দেখে সত্যিই যারপরনাই অবাক হচ্ছি!

হায় নারী, এ সময়ে এসেও যদি তোমরা নিজের আমিত্বকে ধরে রাখতে না পার তবে আর কবে তোমরা নিজেকে চিনবে?

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ