গিয়েছিলাম নিউইয়র্কের ইথাকায় অবস্থিত কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এটি বেসরকারিভাবে অনুমোদিত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ভর্তির সুযোগ পাওয়া খুবই প্রতিযোগিতামূলক। হাইস্কুল শেষে যেসব শিক্ষার্থী সেখানে ভর্তি হবার স্বপ্ন কিংবা ইচ্ছা পোষণ করে, হাইস্কুলের শেষ বর্ষে পড়ার সময়টাতে সেইসব শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা নির্ধারিত দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিদর্শনে যায়। এ বছর করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এই সুযোগ থাকছে না। আমাদের টুয়েলভ গ্রেড পড়ুয়া সন্তান আগামী বছর সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখবে। তার জন্যে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পছন্দের তালিকায় রেখেছি। কিন্তু আমরা সেগুলো পরিদর্শনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবার। এ বছর আমাদের এক বন্ধুপুত্র কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গর্বিত শিক্ষার্থী হবার সুযোগ পেয়েছে। আর তাই তাকে পৌঁছে দিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, পরিবেশ দেখতে আমাদের সেখানে যাওয়া। বাড়ি থেকে ২৪০ মাইল দুরের পথ।
যে ছেলেটি জন্ম থেকে আজ অব্দি একদিনের জন্যেও কোথাও যায়নি পরিবার ছেড়ে, তাকেই কিনা থাকতে হবে পরিবারের বাইরে, দূরের কোনো এক হোস্টেলে! কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছে ছেলে, খবরটি যতটা উচ্ছ্বসিত হয়ে আনন্দের সাথে জানিয়েছেন বন্ধুপত্নী, তারও অধিক মন খারাপের সময় কাটিয়েছেন পরবর্তী দিনগুলো। ছেলে চলে যাবে সেই শোকে মায়ের খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম, ঘুমের অনিয়ম, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, সবমিলে দিশেহারা দশা। এটি একজন বাঙালি মায়ের জন্যে কতটা কষ্টের তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি এবার। আগামী বছর নিজের ছেলেটিও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে চলে যাবে কোথাও, সেইসব ভেবে কষ্টটা আমার ভেতরেও দ্রুত সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাষাণ কষ্ট বুকে রেখে সকলের সামনে কান্না চেপে ভদ্রতা করি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কত সন্তানই তো বাবা-মার গণ্ডি ছেড়ে প্রথমবারের মতো এখানে আসবে উচ্চশিক্ষার্থে, সেইসব ভেবে নিজেকে সান্তনা দেই। খুব সকালে তল্পিতল্পা সহ আমরা রওয়ানা দেই। শহরের কোলাহল ছেড়ে একসময় নির্জন রাস্তা ধরে উঁচু উঁচু পাহাড়, হ্রদ পেছনে ফেলে ছুটে চলছিল আমাদের গাড়ি। কোথাও দুইপাশে ঘন সবুজ গাছের সারি। মাঝে ছায়াচ্ছন্ন পিচঢালা পরিচ্ছন্ন সড়ক। মাইলের পর মাইল ঝড়ের বেগে ছুটে চলছি আমরা। কখনো কখনো দীর্ঘ পথ সড়কেরর দুইপাশে ভুট্টা ঝাড়। সয়াবিন ক্ষেত। সেইসবের আড়ালে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু বাড়িঘর। দীর্ঘ চলতি পথে বাড়িঘরগুলোর সামনে কিংবা পথের ধারে কোনো জনমানুষের চিহ্নটি পর্যন্ত দেখা যায়নি। আমার তখন শুধুই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ছিল। আমার একমাত্র বোন সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন। একবার আমায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন সপ্তাহ খানেকের জন্যে। শহরের বাইরে কী ভীষণ নির্জন এক স্থান! ট্রেনের জানালার পাশে বসে এমন ঘন সবুজে ঘেরা প্রকৃতি, পাহাড়, ক্ষেত পেরিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছেছিলাম সেদিন।
আমরা যখন ইথিকায় পৌঁছাই, তখন মাথার উপর ভর দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ। ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটি শপিং মলের পার্কিং লটে ফ্রেসম্যান শিক্ষার্থীদের গাড়িগুলোকে লাইনে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল পূর্বেই ইমেইলের মাধ্যমে। সেখানে নতুন আসা শিক্ষার্থীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্যে নমুনা সংগ্রহ করছিল কর্তৃপক্ষ। অবশেষে বিদায়ের জন্যে হোস্টেলের কাছাকাছি, সড়কের একপাশে নির্দিষ্ট স্থানে থামতে বলা হয় আমাদের। সেখান থেকেই খুব দ্রুত সন্তানকে বিদায় দিতে হবে অভিভাবকদের। শিক্ষার্থীদের জীবনের নতুন এই অধ্যায়ে নতুন সংসার গুছিয়ে দেয়া হয়নি অন্যবারের মতো এবারের অভিভাবকদের। বন্ধুপুত্রের জন্যে পছন্দের শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিষপত্র কেনাকাটা করেছিল তার পরিবার। প্রস্তুতি নিয়েছিল বিগত সপ্তাহব্যাপী। সেইসব সহ ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তা থেকেই বিদায় দিতে হয়। বাবা-মা আর একমাত্র ছোটভাইয়ের কাছ থেকে ছেলেটির বিদায় নেয়ার দৃশটি এতটাই বেদনাবিধুর ছিল যে, আমার বার বার মনে হচ্ছিল, আমার সন্তান যত নামী বিশ্ববিদ্যালয়েই সুযোগ পাক না কেনো, আমি তাকে সেখানে কিছুতেই যেতে দিব না। বাড়ির ধারে কাছে অখ্যাত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ুক না হয় সে। থাকুক আমার চোখের সামনে। কী হবে এত নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে ? কিন্তু আবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। জীবন এবং বাস্তবতা তো এতোই সহজ নয়। চাইলেই আমি আমার সন্তানদের আজীবন বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারবো ? শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী কেউ পেরেছে কোনোদিন ? এই যে আমি আমার বাবা-মা ছেড়ে মফঃস্বল শহর ছেড়ে ঢাকায় ভর্তি হয়েছিলাম, আমাকেও তো অশ্রুজলে ভেসে যেতে যেতে বিদায় দিয়েছিলেন আমার বাবা-মা। সেদিন আমার বাবার চোখের গভীরে ছিল এক আকাশ বিষাদ। মায়ের চোখে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। জলরাশি। এইসব আমি সেদিন দেখিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। কেননা, আমি একটি স্বাধীন জীবনের স্বপ্নে বিভোর থেকেছি কেবল, যেখানে থাকবে না বাবামায়ের শাসন। ‘এটা করো না, ওটা করো না’ শুনতে হবে না। থাকবে একান্ত নিজের মতো করে ‘ যা খুশি তা’ করার অবাধ স্বাধীনতা। মুক্তির আনন্দ। এখন বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য যে, দু’চোখ বন্ধ করলেই আমি যেন ফিরে যাই বহু বছর আগের সেই সময়ে। দিনের আলোর মতো পরিষ্কার দেখতে পাই সব। আমার মা আমার ব্যাগ গোছাতেন সপ্তাহব্যাপী। পছন্দের শুকনো খাবার, পোশাক, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগ অব্দি ব্যাগে এটা সেটা দিতেই থাকতেন। লোহার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে বিদায় দিতেন। আঁচলে চোখ মুছতেন। তারপর দৌড়ে দোতালার বেলকণিতে গিয়ে দাঁড়াতেন। রিক্সা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে তিনি তিনতলার ছাদে গিয়ে দাঁড়াতেন। আরো একটু দেখবেন বলে। হোক না দূরের, হোক না অস্পষ্ট, তবুও।
তবুও এইসব মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে বাস্তবের দিকে পা বাড়াতে হয়। জীবন তো সেখানেই থেমে থাকার নয়। প্রতিটি সন্তানের নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখতে হয়। নিজের কাজ নিজেকে করতে শিখতে হয়। স্বতন্ত্র একটি জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা জীবন শেষে চাকুরি খুঁজে নিতে হয়। পৌঁছাতে হয় নিজস্ব গন্তব্যে, লক্ষ্যে। শিক্ষা জীবন শেষে সংসার, সন্তান, পারিবারিক জীবন, এমন করেই জীবনচক্র এগিয়ে চলে। কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে বেড়ে উঠা আমাদের সন্তানরা লেখাপড়ায় কিংবা সামাজিক ভদ্রতায় অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও নিজেদের ভালোমন্দের বিষয়ে তুমুল বেখেয়ালি। বেঁচে থাকা মানেই যে নিরন্তর সংগ্রাম, বেঁচে থাকা মানেই যে নানাবিধ বিপদ-আপদ থেকে নিজেকে রক্ষার লড়াই, এমন ভাবনা তাদের মধ্যে সেই অর্থে দৃঢ় নয়।
বন্ধুপুত্রকে একলা চলা জীবনের পথে নামিয়ে দিয়ে আমরা যখন শহরের দিকে ফিরছিলাম, তখন সন্ধ্যার আঁধার ঘন হতে শুরু করেছে। আবারো সেই মাইলের পর মাইল ভুট্টা ঝাড়, সরিষা ক্ষেত। এবার অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। সবকিছু পেছনে ফেলে অন্ধকারের বুক চিরে গাড়ি ছুটে চলছিল ৬০ মাইল বেগে। মাঝে হঠাৎ হঠাৎ বিজলীর মতো এক ঝলক আলো চোখে পড়ছিল। এইসব ক্ষীণ আলোকরশ্মি জানান দিচ্ছিল, ঝোপের আড়ালে অবস্থিত বাড়িঘরগুলোতে জনমানুষের উপস্থিতি। দীর্ঘ ৪৫ মিনিট পর আমরা নিয়ন বাতির আলো দেখতে পাই। নিয়ন সাইনের আলো জানান দেয় আমরা শহরের প্রান্তে ছুটে চলছি। ছুটে চলেছি শক্ত মুঠিতে এতকাল ধরে রাখা সন্তানের হাতখানি ছেড়ে। বার বার মনে পড়ছিল মারটিন লুথার কিং জুনিয়রের উক্তি, ‘ তোমার স্বপ্ন পূরণে বাঁধা দেয়ার অধিকার কোনো মানুষের নেই।’
১১টি মন্তব্য
আরজু মুক্তা
স্বপ্ন পূরণ করে তারা সামনে এগিয়ে গেলেই বাবা মায়ের স্বার্থকতা। আমি মনে করি, তাদের জীবন এখন থেকেই শুরু। পথচলা শুভ হোক। মায়া বাড়িয়ে কি লাভ?
সুরাইয়া পারভীন
চমৎকার লিখেছেন আপু। সত্যিই তো একদিন সমস্ত আবেগ দমিয়ে সন্তানের উজ্জ্বল ঝলমলে আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য বাবা মায়ের কোল থেকে তাদের চোখের মনিকে চোখের আড়াল করতেই হয়।
খুব ভালো লাগলো লেখাটি
আলমগীর সরকার লিটন
জীবন কখনো আবেগ জোয়ারে ডুবতে হয় আবার সচেতনও হতে হয় পরিশেষে বলতে পারি জীবন মানেই যুদ্ধক্ষণ সেখানে আবেগ চলে না ত্যাগই
আনন্দ সুখ দুঃখ———অনেক শুভেচ্ছা আপু
সুপায়ন বড়ুয়া
স্বপ্ন পুরনে আপনাদের জয় যাত্রা অব্যাহত থাকুক।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
নাসির সারওয়ার
মা হয়তো এমনই হয়। চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টা থাকে কিন্তু পারে কজন মা।
বাবার দৃষ্টি হয়তোবা সামান্য ভিন্ন। শক্ত পোক্ত পাথরটা বুকের মাঝে আমরন আটকে রাখার চেষ্টা তাদের।
সন্তান দুই ব্লক দুরের কিন্ডারগার্ডেনে যাচ্ছে। স্কুলের গেটে মা কাপড় দিয়ে মুখ দেখে রেখেছে। বাবা শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। সেই সন্তান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে ভিন দেশে যাচ্ছে, মা তখন বিমান বন্দরে বসে থাকলো। আগে পৌছে নিক সন্তানের গন্তব্যে। আর বাবা – ময়লা মোছার ভানে তার ঝাপসা চশমা মুছে যাচ্ছে।
আপনার লেখায় আমার চশমা ঝাপসা করে মা বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি আবার। ওপাড়ে ভালো থাকুক তারা।
ভালো থাকুন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
লেখাটা পড়ে মনটা খুব অশান্ত হয়ে গেল। বাবা মায়ের আঁচল থেকে বেরিয়ে বাইরে পথ চলতে হয় , কতরকম ঝড়ঝাপটা , বিপদ থেকে একাই নিজেকে বাঁচাতে, লড়াই করতে শিখতে হয়। এ এক অমোঘ নিয়মের বাস্তবতা। ভালো থাকুক সব বাবা-মায়েরা, তাদের সন্তানরা সুশিক্ষিত হোক , ভালো থাকুক । শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য
ফয়জুল মহী
অনুপম প্রকাশ ।
শামীম চৌধুরী
আমাদের সন্তানেরা থাকুক দুধে ভাতে। চরিত্রবান হয়ে।
ইঞ্জা
ঐ দেশের এমন নিয়মটা আমাদের দেশেও আছে আপু, সন্তান যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই পরিবারকে ছেড়ে দূরে যেতেই হয়।
তৌহিদ
মা বাবা সন্তানের ভালোর জন্যই কিছুটা আবেগ বিষর্জন দেন যা নির্দয় মনে হলেও এটাই করা উচিত।
শুভকামনা রইলো আপু।
খাদিজাতুল কুবরা
স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম আপু। আমি নিজেও পড়াশোনার জন্য বাবা মা থেকে দূরে থেকেছি। আমার সন্তানও একসময় আমার বলয়ের বাইরে পড়তে যাবে।
সত্যিই নিয়মের বেড়াজালে বন্দী আমরা।
শুভকামনা রইল আপনার এবং আপনার সন্তানের জন্য।