জিনের পাহাড়ে একদিন
★★

গত রমজান মাসে আমি পবিত্র ওমরা করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করি। জেদ্দা বিমান বন্দর নেমে প্রথমেই মক্কা শরীফ গিয়ে ওমরা সম্পন্ন করি। সেখানে তিনদিন অবস্থান করে মদীনা শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিই।

মক্কা শরীফ থেকে মদীনা শরীফ পৌছলে আমার প্রিয় বন্ধু শফিক নিজের কার নিয়ে এসে আমায় নিজের বাসায় নিয়ে যান। শফিক আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। আমার ভাই, ভগ্নীপতি, ভাগিনা, ভাতিজা, মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাই অনেকেই মদীনা শরীফে আছেন। তারা প্রায় সবাই সেখানে স্বাধীন ব্যবসা করেন। ভাইবেরাদর থাকলেও আমি বন্ধু শফিকের কাছে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলাম। কারণ আমরা পরস্পরকে যেভাবে বুঝি সেভাবে অন্য কেউ আমাকে বুঝবে না। শফিকও ওখানে স্বাধীন ব্যবসা করেন।

প্রথম দিনেই শফিক আমাকে ওহুদ পাহাড় দেখিয়ে নিয়ে আসলেন। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আহত অবস্থায় সাহাবীরা (রাঃ) যেদিকে কিছুক্ষণের জন্য আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে গাড়ী থেকে ঐ পাহাড়ের ফাক দেখালে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। দু'চোখ ঝাঁপিয়ে পানি চলে আসে।

এর একদিন বা দু'দিন পর বন্ধুটি আমাদেরকে নিয়ে জিনের পাহাড় দেখাতে নিয়ে চললেন। এসময় বেলাল মসজিদ, খন্দকের যুদ্ধের এলাকা, দুই কেবলার মসজিদ ( মসজিদে কিবলাতাইন) দেখার সুযোগ হয়।

যাই হোক আমরা রাস্তার দুই পাশের দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে জিনের পাহাড়ের এলাকায় পৌছে গেলাম।

ওয়াদি আল মদিনার রহস্যময় পাহাড়। মানুষের কাছে এটা জিনের পাহাড় নামে খ্যাত। সৌদি আরবের মদিনা শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ওয়াদি আল বায়দা নামক স্থানে এই জিনের পাহাড়। আরবরা অবশ্য এই পাহাড়কে জিনের পাহাড় বলেন না। তাদের কাছে এই পাহাড়ের নাম ওয়াদি আল আবইয়াজ বা ওয়াদি আল বায়জা। আমরা কাছাকাছি গিয়ে দেখি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে রাস্তার দুই দিকেই অনেকদূর পর্যন্ত লম্বালম্বী পাহাড়।

স্থানীয়রা মনে করে ঐ স্থানে গাড়ি নিয়ে গেলে জীনেরা গাড়ি ঠেলে মদিনার দিকে পাঠিয়ে দেয়। লোকমুখে আরও প্রচলিত আছে যে, নবী করীম (সা.) এর সঙ্গে এই এলাকার জীনদের এমনই চুক্তি হয়েছিল যে তারা মানুষের কোন ক্ষতি করবেনা এবং মানুষ ও তাদের এই এলাকায় আসবেনা। তাই জীনেরা কোন ক্ষতি না করে গাড়ি ঠেলে মদিনার দিকে পাঠিয়ে দেয়। এমন আরও অনেক গুঞ্জন আছে এই নিয়ে।

জিনের পাহাড়কে ঘিরে নানা কৌতুহলের সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীব্যাপী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক এই জিনের পাহাড় দেখতে আসে। প্রতিবছর হজে আসা মানুষও এই রহস্যঘেরা জিনের পাহাড় দেখার জন্য ভিড় করে।

আমরা দেখলাম কয়েকটি গাড়ী রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে। একটি বাসও দেখলাম। রাস্তার ঐখানটায় সামনের দিকে ঢালু অর্থাৎ রাস্তা হালকা নিচের দিকে নেমে গেছে। যাত্রীরা গাড়ি থেকে নেমে অবজারভেশন করছে। ড্রাইভার একপাশে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের ব্রিফিং দিচ্ছেন। বুঝলাম ওরা চুক্তিভিত্তিক দর্শনীয় স্থান দেখতে আসছে। কেউ অর্ধেক পানিসহ বোতল রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দিচ্ছে আর বোতল রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে অর্থাৎ বিপরীতমুখী উঠে যাচ্ছে। আবার কেউ গাড়ি নিউট্রলে রেখে দেখছে কিভাবে বিপরীতমুখী উপরের দিকে গাড়ি চলতে শুরু করছে। এখান থেকে সামনে আরো এক কিলোমিটারের মত পাকা রাস্তা আছে। এরপর ভৌতিক কর্মকান্ডের কারণে আর রাস্তা করা সম্ভব হয়নি।

আমরা পাকা রাস্তার শেষ পর্যন্ত গেলাম। এমনকি পাকা রাস্তার পরেও গাড়ি নিয়ে যতটুকু যাওয়া যায় গেলাম। তারপর গাড়ি থেকে নেমে বাকী পথ হেটে গেলাম। এখানে প্রায় তিন দিকেই উঁচা উঁচা পাহাড়। শেষ প্রান্তে ছোট্ট একটি খাল আছে যাতে কোন পানি নেই। খালের পাড়ে মাঝে মাঝে কাটা যুক্ত গাছ আছে। ((লেখায় একটি বেশী ছবি সংযুক্ত করতে পারছি না!!))

মুখোমুখি সামনের পাহাড়ে বিশাল আকৃতির বেশ কয়েকটি পাথর নিচ থেকে একটির উপরে একটি উপরের দিকে উঠে গেছে।  আমরা আশপাশটা হাটাহাটি করে আশপাশ দেখে গাড়িতে ফিরে আসলাম।

এবার দেখার পালা চুম্বকিয় বিকর্ষণ না জিনের ঠেলা কিভাবে কাজ করে। আমরা গাড়ি নিয়ে বেশ সময় দিয়ে বিষয়টি কয়েকবার করে দেখলাম। আমাদের বিস্ময়ের মাত্রা সীমারেখা অতিক্রম করার উপক্রম.....

২০০৯/১০ সালের দিকে সৌদি আরব সরকার ২০০ কিলোমিটার নতুন রাস্তা করার কাজ শুরু করেছিলেন। ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত রাস্তা করার পর শ্রমিকরা দেখে রাস্তা তৈরির যন্ত্রপাতি সব আপনা আপনি পিছনের দিকে অর্থাৎ মদীনার দিকে চলতে শুরু করছে। ট্রাক, লরিতে করে লোহালক্কড় কিছুই সেদিকে নেয়া যাচ্ছে না। এই ভূতুড়ে কারবার দেখে শ্রমিকরা ভয় পায় এবং কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করে।

আমি এর আগে বহুবার জিনের পাহাড়ের ভুতুড়ে কারবার ইউটিউব ও ফেসবুকে দেখেছি। উল্টা চলার এই তেলেসমাতিতে আমি মনে করে এসেছি নিশ্চয় এতে কোন শুভংকরের ফাঁকি আছে। আমি সামনাসামনি গেলে আমার সামনে এমনটি ঘটবেনা বলেই আমার বিশ্বাস ছিলো। সেই বিশ্বাস প্রমাণিত করার মুখোমুখি হয়েছি আজকে।

পাকা রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আরো ৩/৪ শত ফুটের মত খালি জায়গা আছে। মোটামোটি গোলগাল বিশাল একটি উন্মুক্ত জায়গা। তারপর ছোট শুকনো খাল এবং এর পরেই বিশাল বিশাল পাথরের পাহাড়। আমরা গাড়ি নিয়ে শুকনো খালের পাশ বরাবর গিয়েছিলাম। ঐ দিকে চুম্বকীয় আকর্ষণ বিকর্ষণ বা জিনের ঠেলা কিছুই ছিলো না।

ওখানে আমরা গাড়িকে ডানে, বামে, সামনে, পিছনে নিয়ে দেখলাম। না, এখানে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যখন গাড়ি নিয়ে পাকা রাস্তার ১৫/২০ ফিট কাছাকাছি এসেছি তখন গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে নিউট্রল করে দেখি গাড়ি রাস্তার দিকে আস্তে আস্তে চলতে শুরু করছে। আবার গাড়িকে রাস্তার সাথে সোজাসুজি না রাখে আড়াআড়ি করে রাখলে তখন কিন্তু গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ি কেবল মদিনার দিকেই নিয়ে যায়। অন্যদিকে করলে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে।

আমরা কয়েকবার গাড়ি নিয়ে পিছনে গিয়ে আবার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে ট্রাই করলাম। কয়েকবার করলাম। কাচা মাটির অংশ থেকে পাকা রাস্তার দিকে উঁচা হওয়া সত্বেও গাড়ি স্টার্টবিহীন উপরের দিকেই উঠছে। এভাবে পাকা রাস্তা দিয়ে কিছুদূর যাবার পর আমার বন্ধুটি গাড়িকে আবার সেই মাঠে নিয়ে গেলেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখানো। বন্ধুটি জানে আমি একজন লেখক, ব্লগার এবং হাফ গবেষক! তাই বার বার দেখাচ্ছিলো। এটা সম্ভবত সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে পড়েনি তবে আশ্চর্য হবার মত যথেষ্ট অক্সিজেন এখানে আছে।

এবার আমরা দেখতে চাইলাম গাড়ির স্পীড কত পর্যন্ত উঠতে পারে। রাস্তায় উঠে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ অবস্থায় নিউট্রালে রেখে শফিক শুধু স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকলেন। আমি দেখলাম মিটারের কাটা ১০, ২০, ৩০, ৪০, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০, ৯০, ১০০...... এভাবে গাড়ির গতি বাড়তেই আছে। অবাক বিস্ময়ে আশ্চর্যের সাথে টানটান উত্তেজনায় আমরা একবার সামনে তাকাই একবার স্পীড মিটারের দিকে তাকাই।
মিটার আরো বাড়ছে, ১১০, ১২০, ১৩০, ১৪০, ১৫০.....

ও মাই গড! যেভাবে গাড়ির গতি বাড়ছে আমার মনে হচ্ছে বিমান রানওয়েতে নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করার পর আকাশে উড়াল দিবে। বুঝলাম শফিকও আমার নির্দেশনার অপেক্ষা করছে। গাড়ির স্পীড মিটারের কাটা যখন ১৫৬ তে তখন আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। শফিককে বললাম গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ করতে। কারণ আমার মনে হল এই গতি ঘন্টায় ২০০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে। অথচ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ! আল্লাহু আকবর!!

এ সংক্রান্ত অনেক লেখা আমি গুগল থেকে পড়েছি । সেখানে সর্বোচ্চ ১২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত স্টার্টবিহীন গাড়ির গতির কথা আমি পেয়েছি। কিন্তু আমাদের গাড়ি ১৫৬ কিলোমিটার থেকে আরো বাড়ন্ত অবস্থায় আমরা জোর করে গতি নিয়ন্ত্রণ করেছি!

শফিকের বিশ্বাস হচ্ছে এটা চুম্বকীয় শক্তি। আমি সেটা মানতে রাজি হইনি। আমার যুক্তি হচ্ছে পানির বোতল তো চুম্বকীয় শক্তির আওতাভুক্ত নয়। তাছাড়া বোতলের পানি রাস্তায় ঢেলে দিলে সেই পানিও উপরের দিকেই যাচ্ছে। আজিব!!! আমি তাঁকে বুঝালাম পানির বোতল তো চুম্বকীয় শক্তির আওতাভূক্ত নই। শফিক বলল চিরনীও তো লোহাজাতীয় কিছু নয়, তাহলে চিরণী কেন মাথার চুলকে আকর্ষণ করে.....!

আমার কথা হচ্ছে, চুম্বকীয় বিকর্ষণ যদি হয় তাহলে নিশ্চয় বিপরীত পাশে আকর্ষণীয় শক্তি আছে! যে শক্তিতে বিকর্ষণ হচ্ছে ঐ একই শক্তি যদি আকর্ষণ করে তাহলে আকাশ থেকে বিমান টেনে নিয়ে আসবে। প্রকৃত পক্ষে এমনটি হচ্ছে না। তাহলে এটা কিভাবে চুম্বকীয় বিকর্ষণ হয়! তাছাড়া পাহাড়ে চুম্বক থাকলে আমাদের সাথে থাকা চাবি বা লোহা জাতীয় জিনিস আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করত। এমনটিও হচ্ছে না, সুতরাং আমার হিসেবে এটা চুম্বকীয় শক্তি নয়। তাহলে কী?

এটাই অজানা রহস্য! জিনে সশরীরে প্রত্যেকটি জিনিসকে ঠেলে ঠেলে পিছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এটাও আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ তাহলে শত শত জিনকে সার্বক্ষণিক ডিউটি চালিয়ে যেতে হবে। জিনেরা যে ফাকিবাজ জাতি তা হযরত সোলেমান বাদশা জিনদের দিয়ে বায়তুল মাকদাস তৈরি করার সময় বুঝা গেছে। (বিষয়টি আমার ভিন্ন একটি লেখায় উল্লেখ আছে।)
জিনেরা হাজার হাজার বছর ধরে এটা করবে বলে আমার মনে হয় না।
তাহলে সমাধান কী?

আমি তাকালাম দুই পাশের পাহাড়ের দিকে। আমার মনে হল এগুলো কোনো সাধারণ পাহাড় নয়। পাহাড়ের গায়ে যেন লেপটে আছে বিলুপ্ত সভ্যতার করুণ কাহিনী। এখানে এমন কোন রহস্য লুকিয়ে আছে যা বর্তমান সভ্যতার নলেজে নেই। এক সময় হয়তো ছিলো। কিন্তু আমরা জানি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের কয়েকটি লাইব্রেরী ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিলো। এই লাইব্রেরিসমুহ ধ্বংসের সাথে সাথে পৃথিবী থেকে এমন অনেক ইতিহাস, সৃষ্টি রহস্য হারিয়ে গিয়েছিলো যা আর কোনোদিন ফিরে পাওয়া যাবে না। জানা যাবেনা সঠিক তথ্য। ঐসব ধ্বংস প্রাপ্ত লাইব্রেরিসমূহের কোন একটি কিতাবে যে জিনরহস্য লিখা ছিলো না তা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়। আমি মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে হতাশার গহবরে হাবুডুবু খাই উক্ত ধ্বংসপ্রাপ্ত লাইব্রেরিসমূহের জন্য।

(ছবিটা গুগল থেকে নেয়া)

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ