সুজনের প্রেমের চিঠি

♥♥♥

images

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সুজন। নম্র, ভদ্র, লাজুক টাইপ ছেলে। পরিবার আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে খুবিই প্রিয়। গম্ভীর চালচলন আর লজ্জ্বাশীলতার কারণে রাস্তায় চলাচলের সময় ডানে বামে না তাকিয়ে নিম্নমুখি হয়ে স্কুলে ও কলেজে আসা যাওয়া করেছে সুজন। মাঝারী গঠনের গোলগাল চেহারায় মায়াময় চাহনী। জীবনের চব্বিশটি বছর পার হয়ে গেলেও সুজনের জীবনে প্রেম নামের গোলক ধাঁধাঁ কখনও ধরা দেয়নি। কখনও কোন মেয়ে এসে বলেনি- সুজন, আমি তোমাকে ভালভাসি। আই লাভ ইউ। সুজন মনে মনে এমন নিবেদন আশা করেনি তা নয়। তবে নিজে গায়ে পড়ে কখনও কোন মেয়েকে প্রেম নিবেদন করেনি। এটা তার পক্ষে কখনও সম্ভব ছিলো না। তাকে কোন মেয়ের নিবেদন করতে না দেখে সে মনে মনে ভাবে আমার মত ছেলে হয়তো মেয়েদের পছন্দ নয়। সুজনের বন্ধুদেরকে তো কত মেয়েরা চিঠি দেয়। প্রেম করে, আনন্দ ফূর্তি করে, একসাথে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। তাকেও যদি কোন ভদ্র লাজুকী, সুন্দরী, টানাচোখী এসে প্রেম নিবেদন করতো তাহলে আমতা আমতা করে প্রথমে না সূচক সৌজন্যতাবোধ দেখালেও পরে ঠিকই রাজি হয়ে যেতো। তাকে সুজন নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতো এবং তাকে ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে জীবন সঙ্গিনী করতো না। গায়ে পড়ে প্রেমে না পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে সুজন বরাবরই বাস্তববাদী ছেলে। সে যার সাথে প্রেম করবে তাকে বিয়ে করতে পারবে না বলে গায়ে পড়ে কারো সাথে প্রেমে পড়েনি। শুধু শুধু মজা করার জন্য প্রেমট্রেম করে নিজের চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করতে সুজন রাজি নয়। সে এমন মেয়ের সাথে প্রেম করতে রাজি আছে যাকে সে বিয়ে করতে পারবে। হোক সেটা দশ বছর পর। প্রেমহীন জীবনে সুজনের আরো দু’টি বছর কেটে যায়। সে শহরে ডিগ্রী পরীক্ষা দিয়ে গ্রামে গিয়ে যখন দীর্ঘদিন কাটিয়ে দিলো তখনই ঘটে গেলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় দূর্ঘটনা।

একদিন অতর্কিত ভাবে সুজন এমন একটি মেয়ের চিঠি পায় যা সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি। এমন একজন ধনীর দুলারী তাকে প্রস্তাব পাঠালো যার চাল-চলন, আদব-কায়দা, পর্দা-পুশি সবই সুজনের পছন্দ। কিন্তু তারা এত বড়, ধনী ও খান্দানী ফ্যামেলীর যে সুজনদের পরিবারের সাথে কোন অবস্থাতেই খাপ খাবে না। সুতরাং সুজন রাজি না হয়ে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটি ছাড়ার পাত্রী নয়। সে জানায় সুজনের মাঝে সে এমন প্রিয় জনকে দেখেছে যাকে সে কল্পনার রাজ্যে হৃদয়ের মণিকোঠায় সাজিয়ে রেখেছে। আগেও বলেছি সুজন খুবই বাস্তাববাদী। সে মেয়েটির সাথে দেখা করে অসম্ভবের কথা খুলে বলে। কিন্তু মেয়েটি তা শুনতে রাজি নয়। তার এক কথা, সুজনকেই সে চায়। সুজন প্রথম চিঠির জবাবে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। রূপবতী কন্যা পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে আরো জুড়ালো যুক্তি দিয়ে আবার চিঠি দেয়। সুজন এবারও ঠান্ডা মাথায় চিঠির মাধ্যমে প্রস্তাবের প্রতি অনাগ্রহ দেখায়। সুজনের কথা হচ্ছে- আমার মনের দরজা খুলে যদি মন উজাড় করে সঞ্চিত ভালবাসা দিয়ে দিই তাহলে সে ভালবাসা যদি প্রত্যাখ্যাত হয়, অপমানিত হয়, সফলতা না পায় তাহলে তো তার মন তছনছ হয়ে যাবে। সে তখন সহ্য করতে পারবে না। তাই সে বার বার প্রেমে না জড়াবার চেষ্টা করে।

ওদিকে প্রিয়াসখী সুজনের জন্যে পাগল। সুজনকে সে আস্বস্ত করে, সে বলে- আমি খুব জেদী মেয়ে। আমি আমাদের  বাড়িতে যেটি বলবো সেটি সবাইকে মানতেই হবে। তা না হলে আমি তুলকালাম কান্ড করে ছাড়বো। সুতরাং আমার প্রস্তাব সবাই মেনে নিবে। অত:পর সুজন আরো বিস্তারিত লিখে প্রিয়াসখীকে আবারো দীর্ঘ চিঠি দেয়। এটি ছিল সখীর প্রতি সুজনের তৃতীয় চিঠি। দেশে তখনও ডিজিটালের ছোঁয়া লাগেনি বলেই এই চিঠির আদান-প্রদান। সে চিঠির শিরোনাম দেয় ‘প্রেমের হাতছানি’। সুজনের চিঠির হুবহু প্রতিলিপি নিম্নরূপঃ


. . . . . . প্রেমের হাতছানি 

প্রেম করোনা, প্রেম করা ভাল না, ভাল ছেলে মেয়েরা প্রেম করেনা। নিখাদ প্রেম পাওয়া দুস্কর। প্রেম মানুষকে জ্ঞানহীন পশুর পর্যায়ে পৌছাতে পারে।

প্রেম অন্ধ, ইহা সামনে পাহাড়, পর্বত, গর্ত, আগুন, পানি, কিছুই দেখেনা। শুধু ঝাপিয়ে পড়তে জানে। শরৎ চন্দ্র বলেছেন ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, ইহা দূরেও সরিয়ে দেয়।’ প্রেম একজন আদর্শবান উজ্জল ভবিষ্যৎ সম্পন্ন ছেলেকে লিভার পঁচা মৃত্যু পথযাত্রী বানাতে পারে। কারণ প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ধুমপান, হিরোইন, লালপানি, সিডাকসিন ফাইভ এর খপ্পরে পড়েই এমনটি হয়। উসকো-খুসকো চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, অসংলগ্ন কথাবার্তা, পোষাকের ভারসাম্যহীনতা- এগুলো প্রেমিক ব্যক্তির লক্ষণ।

প্রেম সকালের শিশির বিন্দুর মত নির্মল নিষ্পাপ চরিত্রের যুবতীকে করে ঘর ছাড়া। সফল হলেতো রাজ জোটক ( চমৎকার মিলন ), ব্যর্থ হলে গলায় কলসি বেধে পানিতে ডুব অথবা সাড়ে চার গজ রশি দিয়ে পুরোনো বটবৃক্ষের শাখা কিংবা ঘরের ছাদের হুক। রশি যোগাড়ে ব্যর্থ হলে হয় শাড়ির আচল না হয় পাঁচ টাকার পয়জন। প্রেমের স্বীকার হয়েই যুবতীরা ধর্ষন, অপহরন, হত্যা, গুম ও এসিডে আক্রান্ত হচ্ছে। এত কিছুর পরও ছেলেমেয়েরা প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। কারণ প্রত্যেকের জীবনে নাকি একবার হলেও প্রেম আসে।

বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন- ‘যে ফুল ভালবাসেনা সে মানুষ হত্যা করতে পারে।’ ফুল তারাই ভালবাসে যাদের হৃদয়ে প্রেম আছে, হৃদয়ে যাদের প্রেম নেই তারা হয় দেবতা, না হয় পশু।

আসলে প্রেম তো ভাল । ইহা স্বর্গের পবিত্র উপহার। কিন্তু আধুনিক ছেলেমেয়েরা এই পবিত্র প্রেমকে বিকৃত অর্থবোধক করে দাঁড় করিয়েছে। তারা প্রেমকে নিজেদের জৈবিক চাহিদা মেঠাবার জন্যই ব্যবহার করে থাকে। এরশাদ সরকার যেমন সকাল সন্ধ্যা মন্ত্রী বদল করতেন ঠিক তেমনি আজকের যুবক যুবতীরা প্রেমিক-প্রেমিকা বদল করে থাকে। এজন্য সমাজে প্রেমে আসক্ত যুবক-যুবতীদের বাঁকা দৃষ্টিতে দেখা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- ‘কামনা আর প্রেম এ দু’টো সম্পূর্ন আলাদা জিনিস। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা আর প্রেম হচ্ছে ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।’

আসলে প্রেম করা দরকার মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে। সৃষ্টিকর্তার প্রেমে যিনি দেওয়ানা তিনিই তো প্রকৃত প্রেমিক। এজন্য তাকে বলা হয় পাগল বা মজনু। তাঁরা আল্লাহর স্বত্তার সহিত একাকার হয়ে যান।

কোন একজন খোদা প্রেমিক বলিয়াছেন- যে পদার্থকে খোদা ভালবাসেন আমিও উহাকে ভালবাসি। আমি দোযখে নিক্ষিপ্ত হওয়াই যদি তাহার ইচ্ছা হয়, তবে আমি দোজকে যাওয়াকেই ভাল মনে করিব এবং তাহাতে সন্তুষ্ট থাকিব।
হযরত বেশার হাকী [রহ:] একটি ঘঠনা বর্ননা করিয়াছেন। ঘঠনাটি এ রকম - ‘আমি মুরীদ হওয়ার অনতিকাল পরেই একদিন আবাদান শহর অভিমুখে গমন করিতেছিলাম। পথিমধ্যে কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ এক পাগল ব্যক্তিকে ধুলায় লুণ্ঠিত অবস্থায় জমিনের উপর পতিত দেখিতে পাইলাম। অসংখ পিপীলিকা তাঁহার গায়ে জড়াইয়া ধরিয়া তাঁহার মাংস খুলিয়া খাইতেছিল। তাঁহার অবস্থা দেখিয়া আমার মনে বড় দয়া হইল। আমি তাঁহার মস্তকটি ক্রোড়ে স্থাপনপূর্বক তাঁহার শিয়রে বসিয়া পড়িলাম। কিছুক্ষন পরে তিনি চেতনা প্রাপ্ত হইয়া আমাকে বলিতে লাগিলেন : এ কেমন অনধিকার চর্চা। আমার ও আমার প্রভুর মধ্যস্থলে অন্য ব্যাক্তির প্রবেশ, এ কেমন অবাঞ্জিত কার্য।
উপরোক্ত দৃশ্য দুটো মহাত্মা ইমাম গাজ্জালী [রহ:] এর কিমিয়ায়ে সা’দত গ্রন্থের পরিত্রান খন্ডে চিত্রিত হয়েছে।

লবণ যেমন পানিতে মিশে যায় তেমনি খোদা প্রেমিক ব্যক্তিও স্বতন্ত্র অস্থিত্ব হারিয়ে ফেলেন। এ পর্যায়ে আশেক ও মাশুকের মধ্যখানে কোন পার্থক্যই থাকে না। দুনিয়াবী কোন আচরণের সহিত তাঁর কোন সম্পর্কই নেই। এজন্যই আল্লাহপাক তাঁর প্রেমে মজনুদের নামায রোজা মাফ করে দিয়েছেন। পুকুরের পাড়ে যে গাছ তার গোড়ায় পানি দিতে হয়না।

অবশ্য আল্লাহর প্রতি প্রেমের এই নমুনা কিছু কিছু সৃষ্টির প্রতি সৃষ্টির মাঝেও পরিলক্ষিত হয়। ইউসুফ জুলেখা, শিরি-ফরহাদ, লাইলি মজনুর প্রেম এর উজ্জল স্বাক্ষর। এছাড়া দৈনন্দিন পরিবেশে এরকম শত শত ঘঠনা অহরহ ঘঠেই যাচ্ছে আমরা যার খবর রাখিনা।

প্রেম জিনিসটাই এরকম যে, কোন বাচ-বিচার করতে সে রাজি নয়। প্রেম জাত মানে না, গোষ্ঠী মানে না, বর্ণ মানেনা, ধর্ম মানেনা- ইহা উত্তপ্ত এক বিপ্লব। পৃথিবীতে যদি কোন স্বার্থক বিপ্লব থাকেতো সে এই ‘প্রেম’।
এই বিপ্লবের কর্কশ থাবা থেকে রেহাই পাবার উপায় হচ্ছে প্রেমের ফাঁদে পা না দেয়া।

আমি মনে করি বিয়ের আগে প্রেম করাই উচিত নয়। বিয়ের পর যে ঘরে আসবে বা যার ঘরে যাবে তার সাথে তখন থেকেই প্রেম শুরু করা যায়। অবশ্য সুযোগ থাকলে বিয়ের কয়েক মাস আগে থেকে পছন্দ-অপছন্দের স্বার্থে যোগাযোগ রাখাটা আমি অসমর্থন করিনা।

তবে কোন অবস্থাতেই সম বয়সী বা সহ পাঠিদের মাঝে প্রেম হওয়া উচিত নয়। কারণ জরিপ করলে দেখা যাবে সিংহ ভাগ ব্যর্থ প্রেম সহপাঠি বা সমবয়সীদের মাঝেই ঘঠে থাকে। আর সেখান থেকে যেগুলো জোড়া-তালি দিয়ে মিলন সম্ভব হয় তার থেকেও পরবর্তীতে অনেকের বিচ্ছেদ ঘটে যায়।

এর কারন এরা অপরিনত বয়সে হাওয়া হাওয়া গাছ তলায় কল্পনার ফাঁনুস উড়িয়ে অবিভাবকের পরামর্শকে বিষাক্ত মনে করে যে কাঁচা সিদ্ধান্ত নেয় তাই ওদের ভরাডুবির অতল গহবরে নিক্ষেপ করে।

পরিচিত কাউকে যদি প্রেমের সাম্পানে সওয়ারী হতে দেখা যায় এবং সে সওয়ারী যদি হয় একান্তই আপনজন- তাহলে মনে শঙ্খা জাগে, সে ভুল করল নাতো ! আর এই সাম্পানে যদি আহবান করে আমাকেও তখন দ্বিধা, দ্বন্ধ, আনন্দ, শঙ্খা, জল্পনা, কল্পনার এক মিশ্র অনুভুতি অন্তরে পয়দা হয় এবং চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটা অনেকটা নির্ভর করে যে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তার উপর। তার সততা, একনিষ্টতা, সাহসিকতা, ইষ্পাত-কঠিন দৃঢ়তা এবং আন্তরিকতার উপর।

তাই তোমাকে আবারো সতর্ক করতে চাই যে আমার সহজ সরল মনটাকে তছনছ করে দিও না। আমি তোমাকে পেলে মাথায় তুলে রাখবো। আমার হৃদয়ের গভীরতম স্থানে হবে তোমার ঠিকানা। তোমার সবকিছুই আমার পছন্দ। আমার ভয় হচ্ছে আমাদের ফ্যামেলীর প্রস্তাব যদি তোমার পরিবার গ্রহণ না করে তাহলে আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। আর তোমাকে নিয়ে আমি লুকোচুরি করে সংসার পাতবো সেটাও আমি ভাবতে পারি না। তুমি যদি চুড়ান্তভাবে আমার হবার ইস্পাত কঠিণ সফত নিতে পারো তাহলে এসো। যদি তা না পারো তাহলে আমাকে ক্ষমা করো।

ইতি, সুজন

.....

চিঠির পিছনের পৃষ্ঠায় ঈদের শুভেচ্ছা লেখা ছিলো:

দেখ ঐ সোনালী আকাশের পানে
রূপালী পর্দার আড়ালে উকি মারে
বাঁকা এক চাঁদ খানি
যেন প্রত্যাশিত নব দম্পতির
ক্রোড়ে এল নবজাতক
যেন- টেবিলের তাজা ফুলদানি ॥

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ