সুখের নীড়ে…

ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন ২০ ডিসেম্বর ২০১৫, রবিবার, ১২:০৪:২৮পূর্বাহ্ন গল্প ৭ মন্তব্য

চোখ মেলে নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখলো রূপন্তী! পাশে ফিরে দেখে তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে একটা অতি পরিচিত হাত। একটু পরেই চোখে পড়লো অতি আপন ও পরিচিত চেহারাটা। আনন্দ আর উদ্বিগ্ন দুইটার অদ্ভুত মিশেল ছাপ প্রিয় চেহারাটায়। তবে রূপন্তীকে চোখ মেলতে দেখে আনন্দটা ক্রমেই বিকশিত হচ্ছে।

কি হয়েছিল নিজের মনে করতে একটু সময় লাগে রূপন্তীর। মনে পড়তেই অদ্ভুত আনন্দ আর উত্তেজনায় ছেঁয়ে যায় তার মন।

**************
রূপন্তীর সাথে সোহানের পরিচয়টা ভার্সিটিতে উঠার পরে। একই ভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টে একই ব্যাচে তারা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই তাদের পরিচয়ের শুরুটা বন্ধুত্ব দিয়ে। অবশ্য দিনে দিনে সোহান তার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে।

রূপন্তীও যে কিছুটা দূর্বল ছিল না তা নয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক অবস্থা মেয়েদের কে একটু দূরদর্শী হতে বাধ্য করে। আর সেইজন্যই সোহানকে সেটা কখনো বুঝতে দিত না সে। বরং সোহানের জন্য সে যে উপযুক্ত মেয়ে না সেটা প্রায়ই বুঝানোর চেষ্টা করত। তার মতে সেম এজ রিলেশনশিপ, প্রেমের পরিণয় কখনই ভালো হয় না। অবশ্য অবুঝ ছেলেটাকে বুঝানোর চেষ্টা করে তাকে বারবার হাল ছেড়ে দিতে হত।

একদিন সে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই ঠিক করে আজকে যেভাবে হোক সোহানকে বুঝিয়েই ছাড়বে। তার মাথা থেকে প্রেমের ভূত নামিয়েই ছাড়বে! সেইজন্যই ফোন দিয়ে তাকে ডেকে নেয় পার্কে।

“ আচ্ছা তুই আমার মধ্যে কি এমন দেখেছিস যে এমন প্রেমে পড়লি? আমি তেমন সুন্দরী না। আমি তো স্টাইলিশও না।  ”
- আমি সুন্দরী স্টাইলিশ দেখে প্রেমে পড়ি না। সুন্দরী মেয়েরা ধ্বংসের কারণ হয়!
- বলছে তোরে?
- ইতিহাস সাক্ষী। রূপকথা সাক্ষী। এক হেলেনের জন্য ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে গেছিল।
- উফ! তোর এইসব কথা বাদ দে। আমাদের কোন ভবিষ্যৎ নাই।
- ভবিষ্যৎ কারই থাকে না। তৈরি করে নিতে হয়।
- আমি মোটা, গাল দুইটা যেন আটার বস্তা! সর্বদা কনফিউজড থাকি। কি করব নিজেও ঠিকমত বুঝি না। আমার মত মেয়ের সাথে প্রেম করে কেন তুই নিজের লাইফ বর্বাদ করবি?

“ তোমার ওই গোলগাল ফরসা চেহারার লালচে আভার প্রেমে আমি আমৃত্যু পড়বি। তোমার ওই অভিমানী চোখের প্রেমে আমি একবার নয় শতবার পড়তে পারি। আমি কখনো অত্যধিক সুন্দরীর প্রেমে পড়তে চাইনি। পড়তে চেয়েছি খুব সাধারণ এক মেয়ের, যে কিনা তার স্বপ্নের পৃথিবী সাজাবে আমাকে ঘিরে। আমি প্রেমে পড়তে চেয়েছি এমন এক মেয়ের যাকে শো অফের জন্য সোনা-হীরের গহনা দিতে হবে না, ভালোবেসে ফুলের গহনা দিলেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমি এমন মেয়ের প্রেমে পড়তে চেয়েছি যে কিনা আজীবন আমাকে ভালবেসে যেতে পারবে, যে কিনা তার সকল অভিমান আমার উপরেই করবে যার অভিমানী লাল চেহারা দেখে আমি একবার নয় হাজারবার প্রেমে পড়তে পারব! যার অভিমান ভাঙ্গানোর পর চোখে খুশির ঝিলিক দিয়ে আমি স্বর্গীয় আনন্দ অনুভব করতে পারব! ”
- সত্যিই তুমি আমাকে এত ভালোবাস ?

“ সত্যি! ”
- তাহলে গোলাপ কই? গোলাপ ছাড়া প্রপোজ করবি?

“ কি? ”
- গরু কোথাকার! প্রপোজ করবি না, প্রপোজ?
- ইয়ে মানে!
- এই তোর ভালোবাসার নমুনা?
- বালিকা ... উমম ... কি বলা যায় ... প্রিয়তমা ... নাহ ... ধুর মাথায় কিছু আসতেছে না।
- হবে না তাইলে !
- মাফ কর আমারে এইবারের মত। কালকে তোর জন্য গোলাপের তোড়া নিয়ে আসব।
- গরু কোথাকার!

****************
ওই গরুটাই তার পাশে বসে আছে এখন। গত পাঁচ বছরে গরু থেকে সে মানুষ না, একেবারে সরকারের একজন প্রসাশনিক কর্মকর্তা হয়ে গেছে। আজকের বিশেষ দিনটার জন্য ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও সময় করে নিয়ে ছুটে এসেছে প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশে থাকতে।

এবার ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে রূপন্তী। তার মনের কথা বুঝতে পেরে হাসলো সোহান।
“ মা! ” - উচ্চস্বরে ডাক দিল সে। “ প্রিয়ন্তীকে নিয়ে এসো। ”

প্রিয়ন্তী!!!!!!!!
চট করে মনে পড়লো রূপন্তীর ...
................

একদিন রমনায় বসে ছিল তারা দুজনে।
“ এই শুনো, আমরা কিন্তু বিয়ের পরেও এভাবে বের হব। পার্কে পার্কে ঘুরবো। তুমি কিন্তু একদম না করতে পারবে না। ”
বলছিল রুপন্তী।

“ আচ্ছা বাবা, যো হুকুম জাঁহাপনা। তুমি যেই হিটলার টাইপ, তোমার হুকুম না মেনে উপায় আছে? ”
- মানে কি? কি বলতে চাও? আমি হিটলার? "
- আরে না না তুমি তো আমার স্বপ্নের রাজ্যের একমাত্র রাণী। "
- তোমার স্বপ্নের রাজ্যে প্রজা কারা? "

“ কোন প্রজা নেই। শুধু তুমি আর আমি। তুমি রাণী, আমি রাজা। কয়েকদিন পর একটা টুকটুকে রাজকন্যা আসবে, একদম তোমার মত! ”
- তাই বুঝি? তা রাজা সাহেব আমাদের মেয়ের নাম কি হবে ?
- রাণী যেই নাম দিবে সেটাই হবে।
- রাণী যে প্রিয়ন্তী রাখতে চায়।
- তাহলে তাই হবে। মহারাণী রূপন্তীর রাজকন্যা প্রিয়ন্তী! দারুণ ম্যাচিং।
- হাহাহা!
অদ্ভুত সুন্দর বিকেলটাও বোধহয় তাদের ভালোবাসা দেখে হিংসায় পুড়ছিল সেদিন ... !
...........

এতদিন পরেও সোহান কথাটা মনে রেখেছে তাহলে ! নাহ সত্যিই ছেলেটার ভালোবাসার প্রতিদান মনে হয় কখনো দেওয়া সম্ভব না তার পক্ষে!

ভাবতে ভাবতেই সোহানের মা একটা ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে প্রবেশ করলো। বাচ্চাটা বেশ কাদঁছে। অবশ্য সদ্য পৃথিবীতে আসা বাচ্চারা কাদঁবেই। মেয়েটাকে কোলে নেওয়ার সময় অদ্ভুত অনুভূতি হলো রূপন্তীর।

মা হওয়ার অনুভূতি! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি!
মায়ের কোলে এসেই পিচ্চিটা একেবারে চুপ করে গেছে। চোখ বড় বড় করে নিজের মাকে দেখছে সে। অবাক হয়ে রূপন্তী দেখছে মেয়েটা যেন অবিকল তার মত। তার চোখগুলো দিয়ে সে যেন বলতে চাইছে, “ তোমার জ্ঞান ফিরতে এত সময় লাগে? আমি কত ভয় পাচ্ছিলাম তোমাকে নিয়ে? আর এরকম করলে তোমার সাথে আমি আড়ি নিব কিন্তু বলে দিলাম। হুহ! ”

চোখে পানি চলে আসলো রূপন্তীর। মনে মনে বলছে,
“ নারে পাগলি! তোরে ছাড়া আমি কিভাবে থাকি বল তো ! তুই তো ‍আমার রাজকন্যা, আমার দুনিয়া। কথা দিচ্ছি তোকে আমি সারাজীবন আগলে রাখব। ”

মা-মেয়ের চোখের কথা!
রুপন্তী- প্রিয়ন্তীর চোখের কথা!

“ রাজকন্যার অভিমান ভেঙেছে? ” বলে উঠলো সোহান।
কথা শুনেই বাবার দিকে তাকালো প্রিয়ন্তী! বড় বড় চোখ করে বুঝার চেষ্টা করছে কে সে! মায়ের দিকে ফিরতেই মায়ের চোখ দেখেই যেন বুঝে গেল এটা কে!
- হ্যাঁ ভেঙে গেছে।
জবাবটা রূপন্তীই দিয়ে দিল।
এবার উঠে দাড়ালো সোহান। আলতো করে নিজের মেয়ের কপালে একটা চুমু দিল।

“ নাহ! মেয়েকে পেয়ে এখন বউকে ভুলে গেলে ? ” - হালকা অনুযোগ রূপন্তীর কণ্ঠে।
- নাহ। কখনোই না। কি বলস প্রিয়ন্তী! আমি কি তোর মাকে কখনো ভুলতে পারি?
হাত ছুঁড়ে না বলার চেষ্টা করলো মনে হয় সে।
“ বাহ! বাপ-মেয়ের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে ? ”
- নাহ রে প্রিয়ন্তী, তোর মাকে আর বঞ্চিত রাখা ঠিক হবে না।
বলেই রুপন্তীর কপালে আলতো করে একটা চুমু বসিয়ে দিল সোহান।

অদ্ভুত আনন্দ খেলা করছে প্রিয়ন্তীর চোখে।
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর দৃশ্যের একটার অবতারণা হয়েছে তখন হাসপাতালের ওই ছোট্ট কক্ষটাতে যে দৃশ্যের মহাত্ম আজ পর্যন্ত কারো পক্ষে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না।

ওই দৃশ্যটার সাক্ষী কেবল তারা তিনজন। আর এক ইশ্বর!

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ