শেষ আশ্রয়

রেজওয়ানা কবির ২০ আগস্ট ২০২১, শুক্রবার, ০৭:০৯:২০অপরাহ্ন গল্প ২১ মন্তব্য

 

ম্যাডাম,এটাই সেই ঠিকানা ।

হুম,,,,

নামবেন না ম্যাডাম?

এসে গেছি! একেবারে আনমনে ভাব কাঁটিয়ে চেতনে ফিরে এসে অহনা ড্রাইভার কে বলল, ঠিকআছে তবে এখানেই গাড়ি সাইড করাও।

ড্রাইভার অহনার কথা শুনে গাড়িটি পুরোনো তিনতলা বাড়ীটির পাশে সাইড করালো।

অহনা গাড়ি থেকে নামার পর লাগেজ হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানালো। যদিও গাড়িটি তার ছেলের তবুও অহনা এই ঠিকানা পর্যন্ত এই গাড়িতে এসেছে এটাতেই অহনার গঁলায় কাঁটা আঁটকানোর মতো অবস্থা। একান্ত বাধ্য হয়েই আজ এই পর্যন্ত অহনার এই গাড়িতে আসা।

ড্রাইভার ঠায় দাঁড়িয়েই রইল।

অহনা পিছন ফিরে ড্রাইভারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল এবার তুমি যাও আর কোন সহযোগীতার দরকার নেই।

বাড়ীটির সামনে বিড়াট বড় একটা সাইনবোর্ড লাগানো -“শেষ আশ্রয় “।

যে কেউ অনায়সেই এই বাড়ীটি খুব সহজেই খুঁজে পাবে। বাড়ীর সামনেটা অনেক গাছ আর ফুলের  সমাহার যেগুলো লাল সবুজে ঘিরে রেখেছে ,দেখে  মনে হয় এই বাড়ীতে আসা মানেই প্রকৃতির খুব কাছে আসা যায়, একধরনের শান্ত শ্রীর প্রতীক। তবে কি অহনাও তার এই  শেষ জীবনে একেবারে এই প্রকৃতির কাছে আসলো??? এসব ভাবতে ভাবতেই,,,,

আপা কাউকে খুঁজছেন???

অহনাঃ আবারও নানা প্রশ্নকে নিজের মনের মাঝে রেখে,চকিত অবস্থায় ফিরে এসে বলল, হুম এটা “শেষ আশ্রয় ” না???

দাঁড়োয়ানঃ হ, আপনি কি হেই আপা যে গাজীপুর থাইকা আসছেন?

অহনাঃ হুম।

দাঁড়োয়ানঃ  ভিতরে আসেন আপা। বড় সাহেব আপনার কথা কইছে, আপনার জন্য  রুম একেবারে ঝকঝকা, ফকফকা কইরা রাখছি । এইখানে যারা থাকে সবাই খুব ভালা মানুষ।

অহনা দাঁড়োয়ানের  পিছন পিছন  বাড়ীর ভিতরে ঢুকে গেলো। ভিতরে ঢুকেই দেখতে পেলো একজন দাঁড়িওয়ালা লোক হাতে রেজিস্ট্রার হাতে নিয়ে বসে আছেন।

অহনা খাতায় এন্ট্রি করেই সোজা তার নতুন রুমে চলে গেলেন। রুম নং ৯৬।

দাঁড়োয়ান অহনাকে বলল আপা আপনে তো নতুন, এইহানের নিয়মগুলা আস্তে আস্তে শিইখা যাবেন। আপা বিকালে একটা জোঁড়ে মিউজিক বাঁজবে, শোনার সাথে সাথে নীচের গোলচত্ত্বরে চলে আসবেন।  নতুন কেউ এইখানে আসলে বড় সাহেব সবার সাথে তারে পরিচয় করায় দেয়। এসব বলেই দাঁড়োয়ান চলে গেলেন।

অহনা ঘরটা পরিস্কার করল। নিজের লাগেজ থেকে অফ হোয়াইট কালারের চাঁদর বিছানায় বিছিয়ে দিলো,টুকিটাকি করে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়ে ক্লান্তিগুলোকে ছুটি দিয়ে একটুখানি বিশ্রামের আশায় বিছানায় গা এলিয়ে  দিতেই মনে পড়ে গেল আবার সেই পুরনো ফিল্মস্ট্রিপের রোলের ঘটনা।  ছেলের শত অবহেলার কথা,যে ছেলেকে সে নিজের সবকিছু দিয়ে এতো কষ্ট করে মানুষ করেছে অথচ সেই ছেলের কাছে আজ তার জায়গা হলো না। সেই ছেলের কাছে আজ সে বোঝাস্বরুপ। এও সম্ভব পৃথিবীতে??? এসব ভাবতে ভাবতেই মনের অজান্তেই  অহনার চোখের কোনে এক পশলা জল জমা হয়ে গেল।

মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে কি সবাই এরকম অসহায় হয়?? এইসময় কি সকলের কাছে বোঝা হয়?? নিজের ভালোলাগা, খারাপ লাগা কি এইসময় থাকতে পারে না? নিজের জগৎ বলে কি কিছুই হয় না মেয়েদের জীবনে???এরকম হাজার প্রশ্ন অহনার ভিতর দাঁনা বেঁধে আছে।  নাকি অহনার ই কোথাও বোঝার ভুল হচ্ছে ! নাকি অহনা একাই এরকম ভাবছে? তবে কি এটাই অহনার শেষ আশ্রয়??

দঁড়জায় কড়া নাঁড়ার শব্দে অহনার চিন্তার বিদায়ে আবার ভাঁটা পড়ল। দঁড়জা খুলে দিতেই কয়েকজন বৃদ্ধা মহিলা এসে ঢুকে পড়ল। হৈ হৈ করতে করতে সবাই রুমে ঢুকে পড়লো। এদের কাউকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এরা প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে বঞ্চিত হয়ে এখানে এসেছে। সবার মুখে কি সরলতার হাসি! যা দেখে সব কষ্টকে এক নিমিষেই ভুলে থাকা যায়। অথচ একেকটা হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে একেকটা দুঃখের গল্প।

আমি রিনা, আমি সাথী,আমি ফাতেমা,আমি সুফিয়া বলে হর হর করে সবাই তাদের পরিচয় দেয়া শুরু করল।

অহনা তাদের এতো এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তার কষ্টগুলোকে  সাময়িক ভুলে গেলো।

তাদের সাথে পরিচিত হয়ে অহনা যেন ফিরে গেল তার স্কুল-কলেজ জীবনে,যেখানে এরকম সবার সাথে সবসময় আনন্দে থাকত। মুহূর্তেই সবার সাথে ভাব হয়ে গেল অহনার। সবাই তাকে পুরো বৃদ্ধাশ্রম ঘুরে দেখাবে বলে রুম থেকে বের হতেই মিউজিকের শব্দ!!!

মিউজিকের শব্দে সবাই একযোগে গোলচত্ত্বরে  যাওয়ার জন্য নেমে পড়লো।

হাসান সাহেবের গায়ে অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি, চোখে বড় একটা ফ্রেমের চশমা আর কপালে একটা কাটা দাঁগ। ইনি হলেন এই বাড়ীর মালিক।

একে একে এখানকার ৩৪ জনই হাজির হলো।সবাইকে একযোগে দেখে মনে হচ্ছে এ যেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এক্কা দোক্কা খেলার ঢল !

হাসান সাহেব নতুন অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে ছিলেন।  হঠাৎ নুপুরের রিনিঝিনি শব্দে একটু অবাক হয়ে তাঁকিয়ে দেখলেন

মিষ্টিকালারের জামদানীতে একজনকে, যার বয়স আনুমানিক ৫৫-৬০ বছর। এই বয়সেও নুপুর পরা যায়? ব্যাপারটি ইন্টারই্স্টিং তো! পিছন ফিরলেই  বয়সের  মুখের ভাঁজগুলোতে অপরুপ সুন্দরী বৃদ্ধার দিকে তাঁকাতেই হাসান সাহেবের বুকে ধঁক করে উঠলো। কিছুক্ষনের জন্য ভিতরের স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল, হাসান সাহেবের হাত পা ও ঠান্ডা হলে লাগল। অহনা এখানে???? এখনো বয়সের ছাপে  রুপের একাংশও কমেনি অহনার? কি !  সুন্দর লাগছে! অহনা,,,,এখানে কেন?

যখন ফোনে অহনার ভর্তি ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম তখন তবে মিসেস চৌধুরী বললো কেন ? যিনি কথা বলছিলেন উনি কি তবে অহনার ছেলে? নাকি স্বামী?

এই মিসেস চৌধুরীই তবে আমার র র অহনা ! এতোবছর পর,,,,,,,,এখানেই বা কেন?????অনেক প্রশ্ন এক নিমিষেই মাথায় কিলবিল করতে শুরু করলো,মনে হল স্নায়ুকোষগুলোকে কে যেন টেনে আটকে রেখেছে।

খানিকটা অপ্রস্তুত আর চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লো হাসান সাহেব। তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ফরমালি সবার সাথে অহনার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

অপরদিকে অহনারও একই অবস্থা ! এভাবে বিব্রতকর অবস্থায়! কি বলবেন,কি করবেন ভেবে ওঠার আগে তিনি  অনেকটা চোখে বিস্ময় নিয়েই তাকিয়ে আছেন হাসান সাহেবের দিকে। অহনাতো কোনদিন ভাবে নি যে আবার,,,,,,,, এতদিনপর,,,,এই পরিস্থিতিতে,,,,এভাবে দেখা হবে???? নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। নিয়তি এমন কেন??? যখন দরকার ছিল তখনতো হয় নি?

একে একে সবাই বিদায় হওয়ার পর হাসান সাহেবই প্রথম কথা বললো,

অহনা তুমি এখানে কেন??? কিভাবে??? এতোদিন কোথায় ছিলে???  এরকম অনেক প্রশ্ন একের পর এক করেই গেলো।

অহনাঃ সেসব প্রশ্ন এঁড়িয়ে গিয়ে বললো, তুমি তাহলে এই প্রতিস্ঠানের মালিক???

হাসানঃ সেদিন আমি সারারাত তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম তুমি আসোনি???

অহনাঃ তাই  নিয়তিই হয়তো আজ আবার আমাকে তোমার  মুখোমুখি করলো । আমি সেদিন ব্যাগ  নিয়ে বের হওয়ার সময় বাবা আমাকে ধরে ফেলে রাতেই আমাকে আমার মামার বাড়ী কোনাবাড়ী নিয়ে যায়, তারপর এক টাকাওয়ালা বিদেশী লোকের সাথে জোড় করে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়। প্রথম প্রথম মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল। তার কিছুদিন পর যখন আমার  ঘর আলো করে ফুটফুটে ছেলে সন্তানকে পেলাম তখন তোমাকে অনেকটা  ভুলেই গিয়েছিলাম। সন্তানের মাঝে নিজের আশ্র‍য় খুঁজেই এতোদিন ভালোই ছিলাম।

তার কিছুদিনপর ,,,,,আমার  স্বামী বিদেশেই রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। এরপর একা হাতে সব সামলিয়ে ধীরে ধীরে ছেলেকে বড় করি। ছেলে এখন বিড়াট বড় কোম্পানীর মালিক,তার সংসার নিয়ে সুখেই আছে। যখন বুঝলাম ছেলেতে আশ্রয় নেয়ার সময় আমার ফুরিয়েছে ,,,,,,আর বাকিটাতো আমি এখন তোমার এই শেষ আশ্র‍য়ে। এবার বুঝে নাও।।।।।।

আজ আকাশ প্রচন্ড মেঘলা,অমাবশ্যা আর ঘন অন্ধকারে দুজন মুখোমুখি বহুবছর পর।।।।

নিরবতা কাটিয়ে অহনা বললো,তোমার খবর বলো??তোমার পরিবার কোথায়???

হাসানঃ আমার পরিবার??? এইতো তোমাকে অনেক খোঁজার পর  না পেয়ে জীবনটা একা কাটাবো ভেবেছিলাম কিন্তু একটা সময় মনে হলো মানুষতো একা থাকতে পারে না। তাই আমার মত একা মানুষদের কথা চিন্তা করে  আমার তৈরী এই “শেষ আশ্রয় “।

যেখানে একটা বয়সে পাশে যখন কেউ থাকে না, তখন যারা আমার মতো একা তারা এখানে চলে আসে। এখানে চাইলেও একা থাকা যায় না। সকালটা শুরু হয় সবার সাথে, সারাদিন সবাই যার যার মতো গল্প, আড্ডা খাইদাই করে খানিক হালকা মান অভিমান নিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের এই শেষ আশ্রয়ের মানুষগুলোর। ভালোই আছি এভাবে।।।।

অহনা আর কথা না বাঁড়িয়ে ক্লান্ত, কাল দেখা হবে বলে চলে গেলেন।

হাসান সাহেব অহনার যাওয়ার দিকে খাঁনিক স্থির তাঁকিয়ে থাকলেন। সারারাত আরও অনেক প্রশ্ন অহনাকে করবে ভেবে ছটফট করে কাঁটালো। ভোরের দিকে হাসান সাহেবের চোখে ঘুম এসে গেলো।

পরদিন সকালে,

হাসান সাহেব তড়িঘড়ি করে  ঘুম থেকে উঠেই অহনার সাথে দেখা করবে ভেবেই হঠাৎ চোখে পড়লো তার টেবিলের উপর একটা খাম। সে অনেকটা সময় নষ্ট হবে ভেবে খামটি  খুলে চিঠিটি পড়তেই হাসান সাহেবের চোখের কোনে  অনেকদিনপর এক সমুদ্র পানি এসে ভঁড় করলো। সে যে অহনাকে পায়ই নি এ জীবনে। সেই অহনাকে আবার এভাবে পেয়ে হারাবে কে জানতো???? অহনাকে এতো বছর পর পেয়ে একরাতেই সে আরও কত কি ভেবে রেখেছিল তাকে বলবে বলে! বাকি সময়টা তার সাথে কাঁটাবে এমনও ভেবে রেখেছিল। হাসান সাহেবের প্রত্যাশা কি বেশি ছিল???

চিঠিতে শুধু এটুকুই লেখা,,,,,,,

আমাকে খুঁজো না,

এ জীবনে প্রথম তোমার হাতে হাত রেখে তোমাতে শেষ আশ্রয় খুঁজেছিলাম। তারপর একে একে স্বামী,সন্তান সবার কাছে শেষ আশ্রয় তৈরী করতে না পেরে তোমার এই শেষ আশ্রয়ে এই বয়সে আমাকে আবার আসতে হবে তা কখনো ভাবিনি। আমি এই শেষ আশ্রয়ে ও আর থাকতে চাই না। আমি আমার কোন অতীত চাই না, যতদিন আর বাঁচবো বাকিটা পথ অন্য নতুন মানুষদের নিয়ে বাঁচবো,যেখানে থাকবে না আমার কোন অতীত। যেটার নাম হবে নতুন আশ্রয় । পুরনো সব ভুলে নতুনভাবে বাঁচার নামও জীবন।

অহনা আবারও ছুটছে অজানার উদ্দেশ্য,নতুন আশ্রয়ের আশায়, ,,,,,

ছবিঃ নেট থেকে।

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ