লাল-সবুজের পতাকা এবং পাসপোর্ট

রিমি রুম্মান ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ০৮:৫৫:৫৭অপরাহ্ন সমসাময়িক ১৬ মন্তব্য
১৯৯৫ সালের এপ্রিলের এক চমৎকার দিন। এক বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড ফেয়ার অনুষ্ঠানে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঘরে তৈরি নিজ নিজ দেশের খাবার স্টলে রাখবেন। অনুষ্ঠানে আগতদের সকলেই বিভিন্ন দেশ এবং কালচারের মানুষ। বাংলাদেশি হাতে গোণা কয়জন। দর্শনার্থীরা স্টলগুলোতে ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্ছেন, সেই দেশ সম্পর্কে জানছেন। দেশগুলোর খাবার সম্পর্কে পরিচিত হচ্ছেন। ‘বাংলাদেশ’ ব্যানার সম্বলিত স্টলে আসেন অতিথিরা। আমরা দুই বন্ধু স্টলে। অতিথিরা ফুলকপি দিয়ে বানানো বিশেষ খাবারটি খেতে খেতে জানতে চাইছেন, দেশটি কোথায় অবস্থিত। ভারতে নাকি পাকিস্তানে ? আমার বন্ধুটি বেশ দৃঢ়তার সাথে জানায়, ‘এটি একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তবে হ্যাঁ, ভৌগলিক দিক বিবেচনায় ভারত এবং পাকিস্তান আমাদের প্রতিবেশি দেশ।’ সুদীর্ঘ পঁচিশ বছর পর আজ ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের আর এমন করে ভিনদেশি মানুষদের কাছে বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। হাসপাতালের ওয়েটিং এরিয়ায় পাশের চেয়ারে বসা রোগী যখন আমার দেশ বাংলাদেশ জানার পর বলেন, তিনি ফ্লোরিডায় দীর্ঘদিন ‘রহমান’ নামের অসাধারণ দক্ষ এক বাংলাদেশি ডাক্তারের অধিনে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন গর্বে আমার বুক ভরে যায়। হাসপাতালের বাইরে অন্য অনেক দেশের পতাকার সাথে পতপত করে উড়তে থাকা শ্যামল প্রকৃতির সবুজ রং এর মাঝে একটি জাতির উদীয়মান সূর্যের ন্যায় নবজাগরণের কথা বলে যাওয়া লাল বৃত্তের দিকে তাকিয়ে মাথা নত করে থাকি ক্ষণিক। কেননা সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত আঁকা এই পতাকার নেপথ্য গল্প কতটা ত্যাগের তা আজ আর কারো অজানা নয়। সময়ের হাত ধরে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আমাদের সেইসব ত্যাগের ইতিহাস। আর তাই তো ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রকাশ করা ‘ বিশ্বের সবচেয়ে অর্থবহ পতাকা’ তালিকায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ সবার শীর্ষে।
প্রযুক্তির কল্যানে দ্রুতই দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশিদের সাফল্য গাঁথা খবর। আজ যখন দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্র আর্মির ক্যাপ্টেন থেকে মেজর হিসেবে পদোন্নতি পায় বাংলাদেশি-আমেরিকান ডঃ মনসুর আলী, আমেরিকায় নারী সাংবাদিকতায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্যে ‘গ্র্যাসিজ অ্যাওয়ার্ড’ পায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তাসনিম মাহফুজ, কিংবা আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’য় সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নিয়োগ পায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মাহজাবিন হক, তখন মনে হয় যে কোন অসম্ভবকে সম্ভব করার মেধা এবং প্রতিভায় বাংলাদেশিরা কোন অংশেই পিছিয়ে নেই। এই মার্কিন মুলুকেই নানাভাবে স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে সংহত করে মাতৃভূমির সম্মান বাড়িয়ে চলেছেন বাংলাদেশিরা। সারা বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞান জগতে একশজন সেরা ব্যক্তিত্বের অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বাংলাদেশি-আমেরিকান ডঃ রায়ান সাদীকে। নিউইয়র্ক পুলিশের ক্যাপ্টেন পদে এবং সার্জেন্ট পদে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয় দুই বাংলাদেশিকে। মূলধারার রাজনীতিতেও বাংলাদেশিদের সরব উপস্থিতি। দুই যুগ আগে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় ব্যবসা ক্ষেত্রে ভারতীয় এবং পাকিস্তানীদের আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু বর্তমানে এই এলাকায় বাংলাদেশি ব্যবসার প্রসার ঘটেছে ব্যপক হারে। শুধু তাই নয়, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলাদেশিদের জয়জয়কার। নিউইয়র্কের অন্যতম সেরা বিশেষায়িত স্কুল স্টাইভেসেন্ট হাইস্কুলে আমার সন্তানের ‘প্যারেন্টস টিচার কনফারেন্স’ এ যেতে হয় বছরে তিনবার। স্কুলে সন্তানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে আমরা যখন বিভিন্ন ফ্লোরে শিক্ষকদের সাথে সাক্ষাত করি, সেই সময়ে অসংখ্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক চোখে পড়ে। স্কুলটিতে অধ্যয়নরত এতো অধিক সংখ্যক বাংলাদেশি দেখে গর্বে ভরে উঠে মন। প্রতি বছর প্রায় ২৯ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও আটটি বিশেষায়িত স্কুলে সুযোগ পায় মাত্র পাঁচ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কর্মক্ষেত্রেও বাংলাদেশিরা সততা এবং আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আছে। শুধু আমেরিকাতেই নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা এভাবেই মেধায়, প্রতিভায় উন্নত দেশগুলোতে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করে চলছেন। দেশের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় সম্মানিত করেছেন নিজ মাতৃভূমিকে।
ফিরে যাই কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যের সেই কথায়। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে কানেক্টিকাট অঙ্গরাজ্যে বাংলাদেশি ছিল হাতে গোণা, ভিনদেশিরা জানতে চেয়েছিল বাংলাদেশ কোথায় অবস্থিত, ভারত নাকি পাকিস্তানে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পর প্রথমবারের মতো সেই অঙ্গরাজ্যের নিউ মিলফোর্ডে শহর ভবনের সামনে সিটি মেয়রের আন্তরিক সহযোগিতায় আনুষ্ঠানিকভাবে ওড়ানো হোল বাংলাদেশের পতাকা। আমাদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ আছে বলেই আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে লাল-সবুজের পতাকা আর পাসপোর্ট হাতে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো জাতি আমরা। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার চেয়ে বড় গৌরব আর কিসে হতে পারে ? সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ