দেশে চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। উলটো রথের পিঠে চড়ে আমরাও দিব্বি মুখে পান পুরে দিয়ে আলোচনা – সমালোচনা করে চলেছি বেশ। আমরা পারিও বটে। জানি আর নাইবা জানি, জানার চেষ্টা করি আর নাইবা করি, আসর জমাতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার।
ঘটে নেই চাল,তবু আমরা ঘন্টা বাজাই তাল-বেতাল।
শুরুতে সবার বিশেষ করে তরুণদের মুখে মুখে বেশ জমে উঠেছিলো বিচারের পক্ষে কথোপকথন। ভাবতাম আহ! কে বলেছে এ দেশে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তারুণ্যের বড় অভাব আছে । নিজেও কথার ফুলঝুরি ছড়িয়েছি বেশ। এখন অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছি। পরিস্থিতি যে পালটে গেছে। দাঁড়িপাল্লার একপাশে একটা হাতি রেখে অন্য পাশে একটা পিঁপড়া রাখলে যে রকম অবস্থা হয় সে রকম অবস্থায় পড়লে মুখে কলুপ দেওয়া ছাড়া কি উপায় আছে বলুন?

বিশ্লেষণ করার মতো জ্ঞানী আমি নই। তাই ওই পথটা এড়িয়ে গেলাম। তাছাড়া আমার জন্ম তো যুদ্ধের বহু পরে, তাই মিথ্যা ইতিহাস চর্চার মাঝখান থেকে সত্য ইতিহাস চর্চা বেশ দূরুহ। তবু জানার চেষ্টা করতে তো আর দোষ নেই। নিজের চেষ্টায় যতটুকু জেনেছি বা বুঝেছি সেই সীমিত জ্ঞান নিয়েই এ লেখা। ভুল হলে দয়া করে ধরিয়ে দিবেন এবং মার্জনার চোখে দেখবেন।

প্রসঙ্গত বলতে হয় খুব খারাপ লাগে যখন শিক্ষিত যুবকদের মাঝে স্বাধীনতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তর্ক করতে দেখি। নিজেকে শিক্ষিত বলতে লজ্জ্বা হয়।

অবশ্য এটা আমাদের নতুন প্রজন্মের ভুল নয়,ভুল তাদের যারা সত্যিকারের ইতিহাস জানেন,যারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দিবেন তারাই তো এসকল তর্কের জনক। তারা নিজেদের মত করে ইতিহাস বয়ান করেন আর যুগে যুগে বদল করেও ফেলেন।আমরা নতুন প্রজন্ম হাবুডুবু খাবো এটাইতো স্বাভাবিক।

একথা অতি সত্য যে গত নির্বাচনে যুবকরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষেই ভোট দিয়েছিল অতি আগ্রহ নিয়ে,যদিও সেটাতে ভাটা পড়ে এখন শুকিয়ে গেছে প্রায়। যে যুবুকেরা বিচারের দাবিতে গর্জন তুলেছিলো সে যুবকেরা এখন বিভ্রান্ত আবার। এর জন্য দায়ী এক অশুভ শক্তি যারা অর্থের বিনিময়ে ভার্চুয়াল জগত থেকে শুরু করে পথে ঘাটে সর্বত্র বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে এই বিচারের বিপক্ষে তারা এবং সাথে সাথে দায়ী যারা বিচারের দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের অতিকথন ।

সাধারণ কিছু বিভ্রান্তি এক নজরে দেখিঃ
১/ এ বিচার করে দেশের কি লাভ? তাতে সাধারণ মানুষের কি উপকারে আসবে?
২/ কিছু মাওলানাকে বৃদ্ধ বয়সে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানোর রাজনৈতিক পায়তারা এবং প্রতিহিংসা করছে সরকার।
৩/ শেখ সাহেবতো ক্ষমা করে গেছেন , এখন তাহলে কিসের বিচার?
৪/ শেখ হাসিনার বেয়াই যে বড় রাজাকার তার বিচার কেন হচ্ছে না?
৫/ সরকারি দলেও রাজাকার আছে।তাদের বিচার হচ্ছে না কেন?
৬/ বিচার স্বচ্ছ , নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের নয়। বিরোধী দলগুলোকে নিশ্চিন্ন করার জন্যই এই বিচার...ইত্যাদি ইত্যাদি।

উত্তর এবং প্রশ্নঃ

১ / হ্যাঁ বলেছেন এ বিচার করে কি লাভ? সাধারণ মানুষের কি উপকার? বেশ বলেছেন,লাভের কথা চিন্তা করে কীট পুষে রাখতেও আমাদের আপত্তি নেই। বাহবা ! বাহবা !!ভাগ্যিস সময়টা ১৯৭১ ছিল,২০১৩ নয়!

আচ্ছা তার আগে আমাকে বলুনতো? একজন সন্তানের পিতা যদি খুন হন অথবা একজন স্ত্রীর যদি স্বামী খুন হন,তবে লাভের জন্যই কি সে বা তিনি পিতা কিংবা স্বামীর বিচার চাইবেন? লাভের হিসাবই যদি কষতে হয় তাহলেতো বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই। কারণ তার পিতা কিংবা স্বামীতো ফিরে আসবে না তাই না? তবু কিসের আসায় তারা বিচারের প্রার্থী হয় বলতে পারেন? আপনার বোনকে আজ যে ধর্ষণ করলো তাকে তো কালই আপনি বুকে জড়িয়ে ধরবেন তাই না?

বাংলাদেশের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারাও কারো না কারো স্নেহশীল পিতা অথবা অতি আদরের সন্তান ছিল। কারো পতি কিংবা প্রিয়মানুষ ছিলো। ধর্ষিতা নারীরা কারো না কারো মা কিংবা বোন অথবা প্রেয়সী ছিলো। তার চেয়েও বড় কথা ওরা এ দেশের স্বাধীনতার বীরসন্তান। ওদের হত্যাকারীদের বিচার চাওয়া কি খুব বড় কোন অন্যায়?

যে কীট দংশন করে সে কীট যে পুনরায় দংশন করবেনা তার নিশ্চয়তা আপনারা কেউ কি দিতে পারবেন?

২ /  কিছু সাধু (!) মাওলানাকেই কেন ফাঁসিতে ঝুলানো হবে? থামেন ভাই। মাওলানা বলার আগে আপনাকে জানতে হবে কাকে মাওলানা/ মৌলভী বলা হয়।

আরবি ‘মাওলানা’ শব্দ নয় বরং একটি পূর্ণ বাক্য; ‘মাওলা’ এবং ‘না’। ‘মাওলা’ অর্থ: প্রভু বা আল্লাহ; ‘না’ অর্থ: আমরা বা আমাদের। এই বাক্যটি কোরানে বহুবার একমাত্র ‘আল্লাহ’ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

প্রধানত ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত ছাড়া এ খেতাব কেউ ধারণ করে না; তবে বাংলাদেশের প্রায় ঘরে ঘরে মাওলানার আবির্ভাব অব্যাহত রয়েছে। আরব দেশগুলোতে বাক্যটির ব্যবহার শেরেকী মনে করে বিধায় আরবি খেতাবটি আরবদেশের মানুষের নামের আগে ব্যবহার দেখা যায় না বা করেই না। সমগ্র আরবদেশে একজন মাওলানাও নেই!

বিস্তারিত এখানে দেখুন। ভুল কিছুর দায় আমাকে দিবেন না।

এখন আমাকে বলুন একজন খুনি বা ধর্ষককে কিভাবে আপনি মাওলানা বলছেন???

৩ / বিভ্রান্তিকর আলোচনা করছেন বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা নিয়ে। সাধারণ অর্ধশিক্ষিত,অশিক্ষিত এমনকি শিক্ষিত গোষ্ঠীদেরো বেকুবের মত গিলিয়ে দিচ্ছেন সাধারন ক্ষমা নিয়ে মিথ্যাচারগুলো। দোষ আমাদের নতুন প্রজন্মের নয়। কারণ সত্য জানানোর লোকের যে বড় অভাব। যারা জানাবে তারাও তো দেখি নিজেদের বিভ্রান্তির জালে আটকা পড়ে গেছে। তারা তো নিজেদের নিয়েই ব্যাস্ত,আমাদেরকে কে উদ্ধার করবে তাহলে?

তাই প্রায় সবাই বলেন শেখ মুজিব রাজাকারদের সাধারন ক্ষমা করে মস্ত ভুল করেছিলেন আবার কেউ কেউ বলেন শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা যেহেতু করেই গেছেন তাহলে কেন এই বিচারের নামে প্রহসন?

জেনে বলুন আর না জেনেই বলুন এক্ষেত্রে দুটোই ভুল।যদি জেনে বলেন তবে জানার ভুল,আর যদি না জেনে বলেন তবে তো মস্তবড় ভুল।

এখন আমার প্রশ্ন শেখ মুজিব কাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন?  সবাইকে? মোটেও না। সাধারন ক্ষমা ছিলো যারা অবস্থার প্রেক্ষিতে রাজাকার বা আল – বদর বাহিনীতে গিয়েছিল । অসহায় এবং অভাবী মানুষ যারা নিজের দুর্দিন কাটাতে পাকিস্তানীদের চাকরী করতে বাধ্য হয়েছিল, তাদেরকেই ক্ষমা করেছিল শেখ মুজিব। চিহ্নিত কোন ঘাতককে নয়।

আসুন দেখি কাদের জন্য এই ক্ষমা প্রযোজ্য নয়ঃ
চার শ্রেণীর রাজাকারদের জন্যঃ
১। যারা হত্যা করেছে বা সহায়তা করেছে ।
২। যারা ধর্ষণ করেছে বা সহায়তা করেছে ।
৩। যারা সাধারণ মানুষের ঘরে লুট পাট করেছে বা সহায়তা করেছে ।
৪। যারা মানুষের ঘর বাড়িতে আগুন ধরিয়েছে বা সহায়তা করেছে ।

এই চার ধরনের অপরাধ ছাড়া যারা বাধ্য হয়ে বা পেটের দায়ে অথবা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য রাজাকার বা আল – বদর বাহিনীতে তাদের জন্য সাধারন ক্ষমা প্রযোজ্য ছিল ।

উপরোক্ত তথ্যগুলো আমার মনগড়া সাজানো কিছু নয়।আমি পূর্বেই বলেছি এ বিষয়ে আমার জানার চেষ্টা ছাড়া জ্ঞান ছিল সীমিত।যা পেয়েছি তা নিম্নোক্ত সুত্র ধরে।আপনারাও দেখে নিবেনঃ

বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমাঃ ডকুমেন্টস   সহ সকল মিথ্যাচারের প্রমাণ।

তারপরও বিশ্বাস না হলে বঙ্গবন্ধুর নিজের মুখেই  শুনুন।

৪ও৫/ শেখ হাসিনার বেয়াই রাজাকার এবং সরকারি দলেও রাজাকার আছে তাদের কেন বিচার হচ্ছে না?

এ প্রশ্ন আমারও। কেন তাদের বিচার হচ্ছে না? যেহেতু প্রশ্ন তুলেছেন সেহেতু আপনারা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আপনারা শুধু কথার ফুলঝুরি না ছড়িয়ে উপযুক্ত প্রমাণ নিয়ে ট্রাইবুনালে মামলা করছেন না কেন?

মামলা করুন। এরপর যদি বিচার না পান তাহলে আমিও বলবো বিচার নিরপেক্ষ নয়(যদি সঠিক প্রমানাদি সহ লড়তে পারেন)।

৬/ বিচার স্বচ্ছ,নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের নয়। বিচারের নামে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা হচ্ছে।

হ্যাঁ হচ্ছে বুঝলাম কিন্তু শুধুমাত্র এই দুইটি কথা বাদে যুক্তিসহ বিস্তারিত কেন বলছেন না? নাকি আপনারাও শুধুমাত্র প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য কথাগুলো বলছেন?

প্রসঙ্গত,
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদাহরণ টানছেন। বেশ ভালো। তবে একটু খেয়াল করে উদাহরণ দিন। অ্যামনেষ্টি ইন্টাঃ বাংলাদেশের বিচার নিষ্ঠুর বলছে বলে চিৎকার করছেন। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দেশের বিচার ধীরগতিতে চলছে বিধায় সমালোচনা করছে। এবার এদের ব্যাপারে নিজের হিউম্যান সেন্সকে প্রশ্ন করুন উত্তর পাবেন।

এতখানি আলোচনার পরও বলবো,এ বিচার যেন নিরপেক্ষ ও সমালোচনা মুক্ত হয়। দলীয় স্বার্থপরতার উর্দ্ধে থেকে তা যেন সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয়। সত্যিকার অর্থেই যেন আমরা বলতে পারি আমরা এখন আর অস্তিত্বহীন স্বাধীন জাতি নই। নইলে শিং মাছের কাঁটার মতো যে কাঁটাটা বিধে আছে তার বিষ যে কোনদিনও নামবে না।

শেষকথা, ইতালীতে যুদ্ধাপরাধীর লাশ দেশের মাটিতে স্থান না দিতে আন্দোলন চলছে আর আমরা যুদ্ধপরাধীদের বিচার নিয়েই প্রশ্ন তুলছি। লজ্জ্বা এখানেই আজ আমরা এক হীন জাতি। ছিঃ

এই ভিডিওটি  দেখেও যদি বিচার না চান তবে কে আপনি নিজেকে প্রশ্ন করুন।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ