বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে অভূতপূর্ব গতিময় ছন্দময় আনন্দময় আর নান্দনিক করে তুলেছে। অনেকে বলে থাকেন – বিজ্ঞান জীবনকে দিয়েছে গতি আর জীবন থেকে নিয়ে গেছে আবেগ আর অনুভূতি। সত্যি বলতে কি বিজ্ঞান আমাদের জন্য অনন্য গতিশীল আশীর্বাদ পাশাপাশি দুর্ভোগ ভোগান্তি আর অভিশাপও বটে।  আমরা যদি শুধু মোবাইল ফোনের কথা চিন্তা করি তবে বিজ্ঞান সারা পৃথিবীকে, পুরো বিশ্বকে যেন হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। মোবাইলে ইন্টারনেট যুক্ত হওয়ার কারণে এবং বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে মানুষে মানুষে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে অভিনব এবং সহজলভ্য জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে বসে কথা এবং সহজে যোগাযোগ করা যাচ্ছে। মানুষের আনন্দ বেদনা, সুখ দুঃখ সহজে একে অপরের সঙ্গে বিনিময় করা যায়। বৈশ্বিক প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের আগ্রাসী সংক্রমণ এবং মৃত্যুর মিছিলে মানুষকে যোগাযোগ, শিক্ষা, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবাসহ নানান জরুরি প্রয়োজনে মোবাইল মানুষের বিপদের বন্ধুর মতো কাজ দিয়েছে। হয়ে উঠেছে জীবনের অপরিহার্য একটি নিত্য অনুষঙ্গ। মানুষের জীবন জীবিকা, দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, বৈশ্বিক যোগাযোগ, স্বাস্থ্যসেবাসহ অনেক বিষয়ে মোবাইল আমাদের কাছে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব আশীর্বাদ হিসেবে কাজ দিয়েছে।

অন্যদিকে এই মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ এবং অপব্যবহার মানুষের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনকে বিপদ সঙ্কুল করে তুলেছে। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ অবাধ তথ্য প্রবাহ এবং অল্পমূল্যের সহজলভ্য ইন্টারনেটের সুযোগে আগ্রাসী অশ্লীল আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে নোংরা অশ্লীল নীল ছবিসহ বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রতি প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন অসামাজিক এবং অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। চাঁদাবাজি, নারীঘটিত কেলংকারী, ব্ল্যাকমেইলিং, মাদকাসক্তি, অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে যা ব্যক্তি পরিবার সমাজ রাষ্ট্রীয় জীবনের পাশাপাশি ধর্মীয় রীতিনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। দেশের বেশীরভাগ মানুষ সারাদিন ফেইবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে সময় ব্যয় করছে, ইন্টারনেটের প্রতি আসক্তি বেড়েই চলেছে। নিজেদের মূল্যবান সময় অযথা অহেতুক অপব্যয় বা অপচয় করছে। পাশাপাশি সবার হাতেই এখন মোবাইল তা দামী বা কম দামী যাই হোক না কেন এবং এই মোবাইল ব্যবহারের কারণে মিথ্যা কথা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। ঘর থেকে বের না হয়েই বলে দিচ্ছে আমি এখন রাস্তায়। আন্দরকিল্লায় অবস্থান করে বলছে আমি এখন চকবাজারে আছি। ফ্রি রাস্তায় অবস্থান করে বলে দিচ্ছে ভীষণ যানজটে আটকা পড়েছি।

সকল শ্রেণী আর সকল পেশার মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোন থাকায় সবাই মোবাইল ফোন নিয়ে কথা বলায় অতি ব্যস্ত।  ফলশ্রুতিতে মোবাইল ফোন ব্যবহারে সচেতনভাবে বা অসচেতনভাবেই হোক কেউই যেন স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় নিচ্ছে না। ক্লাস এইট পাশ করা গাড়ি চালকরা যেমন শিক্ষাঙ্গন, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ স্পর্শকাতর স্থানে যেভাবে অকারণে উচ্চস্বরে অহেতুক গাড়ির হর্ন বাজায় তেমনি মোবাইলের রিংটোন বা উচ্চস্বরে কথা বলার ধারও কেউ ধারে না। আপনি প্রার্থনা বা উপাসনালয়ে বিশেষ করে মসজিদে ঢুকলে বুঝতে পারবেন কত বিচিত্র বিকট উৎকট শব্দের রিংটোন আছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের জীবনাচার, জীবন ও জীবিকা এখন মোবাইল ছাড়া যেন পুরোই অচল। জীবন যেন ঘোর অন্ধকার । তাই বলে কি মসজিদেও এর অপব্যবহার করতে হবে ? মহান আল্লাহ্‌র ঘরে স্রষ্টাকে হাজির নাজির জেনে ইবাদত বন্দেগী করতে গেছেন দুনিয়াবি সবকিছুই ভুলে। আল্লাহ্‌র কাছে নিজেকে আত্ম-সমর্পণ করতে মসজিদে প্রবেশ করেছেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় একশ্রেণীর মানুষকে দেখা যায় মসজিদেও মোবাইলে কথা বলতে। এমনকি ফরজ নামাজের জন্য ইকামত দেয়ার সময়ও অনেক অবিবেচক মানুষকে মোবাইলে নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায় কথা বলতে দেখা যায়। ইমাম সাহেব সালাম ফিরানো শেষ হয়নি অমনিই অনেকে কথা বলা শুরু করে দেন। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক এবং  দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে আপনি একাগ্র চিত্তে নামাজে দাঁড়িয়েছেন, ইমাম সাহেব ক্বেরাত পড়া শুরু করেছেন তখনি বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেজে উঠছে বিভিন্ন শব্দের গানের মিউজিকের আজানের ধ্বনির বা সূরা পাঠের মোবাইল ফোনের উচ্চস্বরের রিংটোন।  নিঃসন্দেহে অনেকেরই ইবাদত বন্দেগীতে মনঃসংযোগের চরম ব্যাঘাত ঘটে থাকে। মনে মনে ক্ষোভ আর অসন্তোষ দানা বাঁধা স্বাভাবিক। তবে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনেকেই অসচেতনভাবে মোবাইল রিংটোন সাইলেন্ট করতে ভুলে যান। তারপরেও বলা যায় ইমাম সাহেব কিন্তু ফরজ নামাজ শুরু করার আগে কাতার সোজা করা এবং মোবাইল ফোন বন্ধ করার তাগিদ দিয়ে থাকেন প্রতিনিয়ত। আমাদের জীবন জীবিকা এবং নানাবিধ প্রয়োজন এখন প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে এটা অস্বীকার না করেও বলা যায় অন্তত মসজিদ বা অন্যান্য ধর্মালম্বীদের উপাসনালয়ে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনের সুইচ অফ অথবা মোবাইল ফোনকে সাইলেন্ট মুডে নিয়ে যাওয়া উচিৎ যাতে নিজের এবং অন্যের ইবাদত বা প্রার্থনায় মনঃসংযোগের ব্যাঘাত না ঘটে। আরেকটি যন্ত্রণাদায়ক বিষয় হচ্ছে, মোবাইলে ফোনে কথা বলতে বলতে অনেকে ট্রেনে কাটা পড়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় পড়েছেন যাতে প্রানহানী সহ অনেকেই জীবনের তরে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। পাশাপাশি চালকদের যানবাহন চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে। তাছাড়া মোবাইল ফোনে সেলফি তুলতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে, সাগর বা নদীতে ডুবে, কুমীরের পেটে যে কত মানুষ ঢুকেছে সে পরিসংখ্যান কে বা রাখে। বহুমাত্রিক দুর্ঘটনা এড়ানো, ধর্মীয় স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে মোবাইল ফোন ব্যবহারে সংযমী, মিতব্যয়ী এবং স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় নেয়া অতীব জরুরি হয়ে উঠেছে। একথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা উচিৎ, আপনার কোনো অধিকার নেই  মোবাইল ফোনে উচ্চ শব্দের রিংটোন ব্যবহার বা উচ্চস্বরে কথা বলে মানুষের শান্তি, সুস্থতা, ইবাদত বন্দেগীর ব্যাঘাত সৃষ্টি করা।  মানুষকে অবশ্যই তাঁর নিজের বিবেক বুদ্ধি বিচার বিবেচনা নিয়ে সমাজে বসবাস করতে হবে।  একজন ভদ্র সভ্য মানুষ কখনোই অবিবেচক হয়ে অন্যের মানসিক যন্ত্রণা বা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারেন না এটা সবার মনে রাখা উচিৎ।
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ