মুরগির খামারে শেয়াল চৌকিদার!

তৌহিদুল ইসলাম ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সোমবার, ০৫:২৩:৩১অপরাহ্ন সমসাময়িক ৩৪ মন্তব্য

এক গ্রামে বাস করতেন এক বৃদ্ধ। সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে মুরগির খামার করবেন এই চিন্তা থেকে খামারের জন্য মজবুত করে ঘর বানালেন। হাট থেকে একশো মুরগির বাচ্চা কিনলেন, মুরগির খাবার কিনলেন। এসব নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দেখেন রাস্তার মাঝখানে একটি ছোট্ট শিয়ালের বাচ্চা আহত হয়ে ক্যাঁও ক্যাঁও করে চেঁচাচ্ছে। দয়ার সাগর সেই বৃদ্ধের খুব মায়া হল। তিনি বাচ্চাটিকে সাথে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন, যত্নআত্তি করে সুস্থ করে তুললেন। কিন্তু শেয়ালের বাচ্চাটি সেই ভালোবাসা পেয়ে বাড়ি থেকে আর যেতে চাইলোনা। অগত্যা বৃদ্ধ নিজের খাবার থেকে শেয়ালের বাচ্চাটিকেও কিছু খেতে দিতে লাগলেন প্রতিদিন।

এভাবেই দিন যেতে লাগলো। কয়েক মাস পরে মুরগির বাচ্চাগুলো বড় হয়েছে কিছুটা। শেয়ালের বাচ্চাটিও হয়েছে নাদুসনুদুস। বৃদ্ধ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন একটু একটু করে। দিনের বেলা মুরগির যত্নআত্তি করলেও রাতে আর বেরোতে পারেননা গেঁটে বাতের ব্যথায়। তিনি ভাবলেন, রাতে মুরগিকে পাহারা দেয়ার কি হবে? কেউ তো নেই, তিনি নিজেও অপারগ। এদিকে শেয়ালের স্বভাবমতো বাচ্চাটিও রাতে বের হয়ে উঠোনে বসে থাকে। বৃদ্ধ ভাবেন সেটি হয়তো আশেপাশেই আছে। যেহেতু নিজে যত্ন করছেন, খাবার দিচ্ছেন বাচ্চাটি হয়তো জানেনা কি করে শিকার ধরতে হয়। তাই শেয়ালটির রাতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যাওয়াটাকে তিনি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই ধরে নিলেন। ভাবলেন গৃহপালিত প্রভুভক্ত পশুর ন্যায় শেয়ালটিও হয়তো তার মুরগিগুলোকে রাতে পাহারা দিচ্ছে।

এভাবেই চলতে থাকলো বেশ ক'দিন। নিজের অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় বৃদ্ধ চিন্তা করলেন কিছু মুরগি বিক্রি করে দেবেন। বেশ কিছুদিন থেকে মুরগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন তাও বুঝতে পারছেননা। বাঁশের চাঁটাই দিয়ে ঘেরা শক্ত ঘরের তালা ভেঙ্গে কেউ মুরগি চুরি করবে এটা সম্ভব নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে তিনি খুব একটা মাথা ঘামাননি। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ঘরের তালা খুলে মুরগি গুনতে গিয়ে দেখেন একশোটির মধ্যে আছে ত্রিশটি, বাকিগুলি নেই। মাথায় হাত দিয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন বৃদ্ধ। বৃদ্ধের চোখের পানি দেখে শেয়ালটিও তার পাশে এসে কোলে মাথা রেখে সান্ত্বনার আদর দিতে লাগলো।

হঠাৎ চোখে পড়লো মুরগির ঘরের মাটির নিচে গর্ত করে সুরঙ্গ বানিয়েছে কেউ। সুড়ঙ্গের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃত মুরগির পাখা হাড়গোড়। বৃদ্ধ বুঝতে পারলেন শেয়ালটি ছাড়া এটি আর কেউ করেনি। মৃতপ্রায় শিয়ালের বাচ্চাটিকে বাঁচানোর উপহারস্বরূপ মুরগীর বাচ্চাগুলোকে খেয়ে তাকে নিজের চিরাচরিত স্বভাব জানিয়ে দিয়েছে শেয়ালটি। কয়লা ধুলেও যে ময়লা যায়না- বৃদ্ধ এই কথাটির মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। শেয়ালকে মনে করেছিলেন মুরগির-ঘর পাহারার বিশ্বস্ত প্রহরী। কিন্তু এই তার প্রতিফল!!

এবার আসি মূলকথায়। রুপপুর বালিশ দুর্নীতি, ফরিদপুর মেডিকেলের পর্দা কেলেঙ্কারীকে ছাপিয়ে সম্প্রতি দেশের যে খবরটি টক অফ দা টাউন সেটি হলো- মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তার দুর্নীতি। তাও অন্য কোনভাবে নয়, খোদ মাদক ব্যবসায় নিজেকে জড়িত করে। হেলালউদ্দিন নামের এই ব্যক্তি যশোর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক। নিজের ভাই আজাদের নামে রাজধানীর অভিজাত পাড়া নামে খ্যাত গুলশানে মদের বারের লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়ে নিজেই চালাচ্ছেন বহু বছর ধরে। তিনি গড়েছেন শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। তার কর্মস্থল যশোর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে হলেও তিনি বেশিরভাগ সময় থাকেন রাজধানীতে। বাড়ি গাড়ি স্ত্রীর নামে বেনামে এসব অবৈধ সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি। কাদের ছত্রছায়ায় তিনি এসব করেছেন সেটাও ভাববার বিষয়।

দেশে মাদক সমস্যা প্রকট আকার ধারন করছে দিনে দিনে। তরুণ-যুবা,বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এই মাদকের নির্মম ছোবলে আক্রান্ত। দেশ-জাতি দিনে দিনে অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে ভয়াবহ মাদকের ব্যপকতায়। মাদককে বাংলাদেশ সরকার অবৈধ ঘোষণা করেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারি দপ্তর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। আর এ সবকিছুর সমন্বয় করে দেশের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। চালকের আসনে বসে থেকে কি করে এই অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা এমন অবৈধ কাজ দিনের পর দিন পরিচালিত করছিলেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। মানুষের আস্থা অর্জন করা যাদের দায়িত্ব, দেশ জনগণের কল্যাণের জন্য যারা নিয়োজিত সেসব সংস্থার ব্যক্তিবর্গ যদি এহেন দুর্নীতি করেন তবে অবশ্যই তা গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের বিবেক, মনুষত্ববোধ লোপ পেয়ে তারা হয়ে উঠেছে শেয়ালের বংশধর। দেশপ্রেমতো নেইই, যা আছে সব অপকর্ম। নিজের স্বভাব চরিত্র কোনদিনও সংশোধন হবেনা এদের।

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন- দুদক এই ব্যক্তির বিশাল ধনসম্পদের পাহাড় দেখে তার সম্পদের বিবরণী জমা দিতে বলেছেন। যদি সেই ব্যক্তি হেলালউদ্দিন দোষী প্রমাণিত হয় তবে দুদককে অবশ্যই তার অবস্থানে অনড় থেকে এসব ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনে কঠোর সাজা দিতে হবে। যদি তা না পারেন তাহলে দেশের এসব দপ্তরের কার্যাবলী প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে দেশ ও জনগণের কল্যাণে অবশ্যই তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে আইন অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

মজার বিষয় হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ এই ব্যক্তি হেলালউদ্দিন তার নিজের আপন ভাই আজাদকেও এখন অস্বীকার করেছেন। তার ভাই আজাদ যার নামে মদের বারের লাইসেন্স কৌশলে করেছেন হেলালউদ্দিন, সেই আজাদ কিন্তু স্বীকার করেছেন হেলালউদ্দিন তার আপন ভাই। হেলালউদ্দিন এবং আজাদের বাবা-মা একই এবং তাদের গ্রামের স্থায়ী ঠিকানাও এক এটিরও প্রমাণ পেয়েছেন দুদক। দুদকের বর্তমান কর্মকাণ্ড প্রশংসার দাবীদার। সম্প্রতি বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে আইনের আওতায় এনেছেন তারা।

হেলালউদ্দিনের দুর্নীতির স্বপক্ষের প্রমাণাদি

ওই যে লেখার প্রথমেই আমার শোনানো গল্পের মতো শেয়াল অস্বীকার করলো বৃদ্ধের পরম যত্নআত্তিকে ঠিক সেরকম। হেলালউদ্দিন সরকারি চাকরি নিয়েছেন, বেতন নিচ্ছেন; এখন অবৈধ সম্পদের পাহাড়ও গড়েছেন। চাকরীর বিনিময়ে তিনি দেশকে, সরকারকে এবং জনগণকে সেবা দেবার নামে ক্ষমতার চেয়ারের আড়ালে নিজের পকেট ভারী করে হয়ে উঠলেন বিত্তশালী। তিনি একা একা নিশ্চই নন, যাদের ছত্রছায়ায় তারা এমন দুর্নীতি করার সাহস পান, পাচ্ছেন তাদেরও খুঁজে বের করতে হবে।

আমরা দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ চাই। মাদক মুক্ত সমাজ চাই। সকলে মিলে এসব অপকর্মকারী ব্যক্তিদের প্রতিহত করা না গেলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জ্ঞানের আলোয় নয়, এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে নিশ্চিত।

"দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়বো এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে চাই সকলের অংশীদার।"

 

তথ্যসূত্রঃ ভাইয়ের নামে মদের বার চালান মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা

 

0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ