মা

গোধূলি ২২ ডিসেম্বর ২০১৪, সোমবার, ০২:২৮:৫৫অপরাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

হাঁটতে শেখার পর সন্তান যখন মায়ের হাত ধরে হাঁটে, তখন তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মায়ের গতি মন্থর হয়ে আসে। ধীরে ধীরে শিশু বড় হয়, হাঁটার গতি বাড়ে,কিন্তু মায়ের গতি যে ধীর হয়ে গেছিল মাঝে, তা আর দ্রুত হয় না। মায়ের সাথে হাঁটতে গিয়ে বিরক্ত হই। মা বলে,"অপু, একটু ধীরে হাঁট না, বাবা।"

মার সাথে দোকানে গিয়েও কম বিরক্ত হই না, কিন্তু আমাকে নিয়ে বের হতে মার আগ্রহের সীমা নেই। আরো বিরক্তিকর তার করা দামদর। দেখবেন, কিছু কিছু বদ দোকানদার প্রায়ই বলে,"২ টাকায় দিবো,নিবেন?" তখন সাধারণত আমরা তাদের ignore করে চলে যাই, মা সেটা করে না। মা ২টাকার নোট ব্যাগ থেকে বের করে দোকানদারের সামনে এগিয়ে ধরে, এতে দোকানদার বিব্রত হয়। তারপর শুরু হয় মার টেপরেকর্ডার। ঐ সময়টা অবশ্য বেশ উপভোগ করি।

ছুটির দিনে মা বারবার ডাকে টুকিটাকি কাজের জন্য। ফেসবুক থেকে উঠে ডাক শুনতে কার না বিরক্তি লাগে? আশেপাশে কিসব ঘটছে, সব কিছু সম্পর্কে আপ টু ডেট থাকার জন্য ফেসবুকের থেকে better কি কিছু আছে? যাই হোক, মাকে বলি,"একবারে সব বলতে পারো না? একবার বলো-' ফ্যান অন কর', আরেকবার বলো-'ফ্যানটার স্পীড কমিয়ে দে'।" অসহায় ভঙ্গিতে হাসে মা। পরে মনে হয়, কেনো যে এমন করি মার সাথে? আমাকে দেখার জন্যই তো বারবার মার এসব ডাকাডাকি।

যেসব ছুটির দিনে বাইরে কোথাও যাই, তখন বাবা বলে, "একটা দিনও কি বাসায় থাকতে চাস না? তোর মা ঘরে একা একা।"

আমি বলি," তো আপনি আছেন কি করতে?" বাবা তখন দুঃখী ভঙ্গিতে কিছু বলবেন। আমিও উলটো কিছু বলবো, তারপরের কাহিনী থাক। পরে বুঝি, দুজনই আমার সঙ্গ কামনা করেন। সব ঘরেই হয়ত একই কাহিনী। তারা ভাবেন, তাদের অবহেলা করছি। কিন্তু ব্যস্তজীবনে অবহেলা করার সময়টুকুও আজ নেই-তারা বোঝেন না । যেই ছুটির দিন কোন বিয়ের দাওয়াত বা কোন প্রোগ্রাম থাকে, ঐদিনই মার মুখ মলিন। প্রথম প্রথম বারবার ফোন দিতো কোথায় আছি জানার জন্য। এখন কিছুটা কমেছে(হয়ত বিরক্ত হই বলে)। বুঝি সবই ভালবাসার অভিব্যক্তি, কিন্তু জীবন তো যান্ত্রিক।

শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। শাহবাগ নতুন ইতিহাস গড়ছে। এতো মানুষ একসাথে কিভাবে? অবাক লাগে! শিশু থেকে বুড়ো সবাই...

বড় বড় কবি সাহিত্যিক, নেতারা যোগ দিচ্ছেন। প্রায়ই দৌড় দেই অফিস শেষে। এ যেন অন্যরকম ভাল লাগা। শাহবাগ আমায় টানে চুম্বকের মতো।

ফ্রান্সফেরত জেরিন মির্জাও আন্দোলনের সাথে একাত্ত্বতা ঘোষণা করে বলেন,"একাত্তরে ৮বছরের বালিকা থেকে শুরু করে বৃদ্ধনারী পর্যন্ত বর্বরতার শিকার হয়েছে। আজ যদি আমি এই আন্দোলন সমর্থন না করি, নারীত্বের অবমাননা হবে।একাত্তরে যে অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটেছে সেগুলোকে ছোট করে অন্য ইস্যুগুলোকে নিয়ে যদি কথা বলি, তাহলে আমার থেকে বড় নাস্তিক হয়ত কেউ হবে না। উনি সবই দেখছেন উপর থেকে। এতো মানুষের সাথে অবিচার করবেন না, যদি উনি থেকে থাকেন। আমার বিশ্বাস,উনি এত্ত মানুষকে নিরাশ করবেন না ।" জেরিন মির্জার "যদি উনি থেকে থাকেন"কথা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেলো। একে তো মহিলা ফ্রান্সফেরত,তার উপর আবার এমন উক্তি!!! এসব নারীবাদী মহিলাগুলো একটা না একটা ক্যাচাল বাঁধাবেই। ঐ কথাটা না বললেই কি নয়???

এর মধ্যেও আন্দোলন চলছে। বলতে গেলে রেগুলার যাওয়ার চেষ্টাটা করি। শুক্রবারেও যাবো। মাকে বললাম,"মা,শাহবাগ যাচ্ছি।" দেখলাম,মার মুখ চকচক করছে,মলিন নয়। বুঝতে পারলাম,মা কি ভাবছে। ভাবছে, আমার ছেলে কাপুরুষ নয়(মায়েরা খুব অল্পেই নিজের ছেলেদের সুপুরুষ ভেবে থাকেন,যদিও ঐদিন ব্যাপারটা মনে ধরল),বুকের পাটা আছে। মা বললেন,"শুনলাম, খাবার নিয়ে যাচ্ছে সবাই সবার জন্য। আগে বলবি না? পিঠাজাতীয় কিছু একটা বানিয়ে দিতাম। ফ্রিজে চকোলেটের প্যাকেট আছে, ওটা নিয়ে যাস।"(হয়ত প্রতিটি মায়ের গল্প একই)

দেশের জন্য হয়ত কখনো কিছু করার সুযোগ হবে না,হলেও করব কিনা জানি না। মানুষমাত্রই স্বার্থপর,নিজের জন্য ভাবার সময় যেখানে সল্প,সেখানে দেশকে নিয়ে ভাবাটা যেন কল্পনা। কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে,এই আন্দোলনকে সমর্থন না করা মানে মায়ের অবমাননা। মা, তোমাকে ভালবাসি,তাই পারলাম না আন্দোলন থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে। আজ ম্যাক্সিম গোরকির মতো আমিও লিখলাম "মা"। (গল্পটির সব চরিত্র কাল্পনিক)

 

[বিঃ দ্রঃ লেখাটি লিখেছি,ফেব্রুয়ারী ২০১৩ তে, শাহবাগ আমাদের একটি চেতনাকে জাগ্রত করেছিলো। কোন নেতার আহ্বানে আমরা সেখানে যাইনি, আমরা গিয়েছি, নিজের ভিতরকার আশা আকাঙ্ক্ষা প্রানের আহ্বানে।

যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানুষ ঘৃনা প্রকাশের একটি স্থান হিসেবে শাহবাগ কে বেছে নিয়েছিলো।এই বিচারের দাবী বাঙ্গালীর অস্তিত্তের দাবি। এটি হতেই হবে।

সবাইকে বিজয় মাসের শুভেচ্ছা ----- ]

( সামনে পরীক্ষা। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি হয়ত সবার উত্তর সময়মত দিতে পারব না। সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। কিন্তু যখনই বসব, উত্তর দিয়ে দেব। সবার জন্য রইল শুভকামনা।)

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ