তথ্য বিকৃতি, উসকানি সাংবাদিকতার নামে
পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবি ব্যবহার করে মিথ্যা খবর ছাপা থেকে শুরু করে স্কাইপ সংলাপসহ নানা কারণে মাহমুদুর রহমান এবং দৈনিক আমার দেশ বহুল আলোচিত-সমালোচিত দুটি নাম। সর্বশেষ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে উসকানিমূলক, বিকৃত, কখনোবা মিথ্যা খবর ছেপে পত্রিকাটি সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ায়- রয়েছে এমন জোরালো অভিযোগও।
গত বছরের শেষ দিকে ব্রাসেলসভিত্তিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রধান নিজামুল হকের কথিত স্কাইপ কথোপকথন প্রকাশ করে ব্যাপক আলোচনায় আসে দৈনিক আমার দেশ ও মাহমুদুর রহমান। ব্যক্তিগত কথোপকথনের এ ঘটনা প্রকাশের কারণে গত ১৪ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর শাহীনুর রহমান তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলার আসামি হিসেবেই গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে গ্রেপ্তার করা হয় মাহমুদুর রহমানকে। এর আগেও ২০১০ সালে একটি প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাহমুদুর রহমান।
বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে ধর্মীয় উসকানি দিয়ে উন্মাদনা সৃষ্টির অভিযোগে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে আসছিল। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন শুরুর পর থেকেই 'উসকানিমূলক' নানা প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে আমার দেশ। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। খবরের সূচনাতে ভারতের অবস্থান সম্পর্কে 'স্ট্রংগেস্ট সাপোর্ট' শব্দ ব্যবহার করা হয়, যার আভিধানিক অর্থ হয় 'জোরালো সমর্থন'। এ সংবাদটিকেই বিকৃত করে দৈনিক আমার দেশ সংবাদ প্রকাশ করে 'ভারতের মদদে শাহবাগের আন্দোলন'।
আমার দেশ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে প্রথম দিকে কিছুটা নীরব থাকলেও ৯ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিরোনাম করে 'শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি : গৃহযুদ্ধের উসকানি, বক্তাদের গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার : আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের রণহুঙ্কার।' একই দিনের আরেকটি শিরোনাম ছিল 'ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় এসেছে।' এরপর থেকেই একের পর এক গণজাগরণ মঞ্চকে আক্রমণ করে প্রকাশ করে আসছে দৈনিকটি। দেখা গেছে, আমার দেশের একেকটি বিভ্রান্তিকর খবরের লিংক জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সাইটে শেয়ার করে। এরপর সেই মিথ্যা খবরটি ছড়িয়ে পড়ে লাখো মানুষের পিসি, ল্যাপটপ কিংবা মোবাইলের পর্দায়।
শাহবাগ আন্দোলন চলাকালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার নিহত হওয়ার পর ঢালাওভাবে আন্দোলনকারীদের 'নাস্তিক' আখ্যায়িত করে প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিরোনাম করে, 'ভয়ংকর ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারচক্র'। প্রতিবেদনে বলা হয়, 'ধর্মদ্রোহী ও নাস্তিক যুবগোষ্ঠী মহান আল্লাহ, পবিত্র গ্রন্থ কোরআন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), ঈদ, নামাজ, রোজা ও হজ সম্পর্কে জঘন্য ভাষায় বিষোদগার করে মুসলমানদের ইমান-আকীদায় আঘাত হানছে। তাদের কুৎসিত ও অশ্লীল লেখা পড়লে যেকোনো মুসলমানের স্থির থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। ...ধর্মদ্রোহী ব্লগারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শুক্রবার রাতে মিরপুরে খুন হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা আহমেদ রাজীব হায়দার ওরফে থাবা বাবা।' রাজীব হায়দার খুনের ঘটনাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে এরপর বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদন ছাপে পত্রিকাটি।
'ব্লগারদের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণায় আলেমদের ক্ষোভ : নাস্তিকদের প্রতিরোধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা'; 'ব্লগে নাস্তিকতার নামে কুৎসিত অসভ্যতা'; 'শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তির জন্য শাস্তি : রাসুল (সা.) অবমাননাকারীদের বাহবা!'; 'ধর্ম ও আদালত অবমাননা করছে ব্লগারচক্র'; 'রাসুল (সা.) অবমাননার প্রতিবাদে গণবিস্ফোরণ : পুলিশের নির্বিচারে আলেম হত্যা : স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল', 'শাহবাগী ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারবন্দনা : কথিত আন্দোলনের পেছনে ভারতীয় মদদের আরো এক নজির' প্রভৃতি শিরোনামে একের পর এক উসকানিমূলক সংবাদ প্রকাশ করতে থাকে। এ নিয়ে সরকারের মধ্যেও অস্বস্তি তৈরি হয়। বিভিন্ন ঘটনায় তাঁর নামে হওয়া মামলায় যেকোনো সময় আটক হওয়ার শঙ্কায় তিনি পত্রিকা অফিস থেকে বের হতেন না। গত কয়েক মাস ধরে তিনি অফিসেই থাকতেন। তাঁকে নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হলেও তিনি তা পরোয়াই করছিলেন না। বারবার পত্রিকার শিরোনামও হতে থাকেন।
সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা না থাকা মাহমুদুর রহমান ২০০৮ সালে আমার দেশের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটির প্রথম পাতায় বিভিন্ন মন্তব্য প্রতিবেদন (কমেন্ট্রি) লিখে সমালোচিত হয়েছেন। সেসব লেখায় তাঁর বিভিন্ন বক্তব্য পত্রিকাটির সাংবাদিকতার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। এসব লেখায় সূক্ষ্মভাবে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো হয়।
বিএনপি সরকারের শেষ দিকে জ্বালানি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালেও বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য বহুবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হন মাহমুদুর রহমান। ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে পুলিশসহ জনপ্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে বৈঠকে বসেন তিনি। খবর পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে গেলে বৈঠকে যোগ দেওয়া কর্মকর্তারা মুখ ঢেকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। অভিযোগ ওঠে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি-জামায়াত জোটকে আবারও ক্ষমতায় বসাতেই ওই গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করেন মাহমুদুর রহমান। ঘটনাটি সে সময় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
গত ৬ জানুয়ারি দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সপ্তম পৃষ্ঠায় 'আলেমদের নির্যাতনের প্রতিবাদে কাবার ইমামদের মানববন্ধন' শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ছবিতে কাবার খতিব কারী শাইখ আবদুর রহমান আল সুদাইসিসহ আরো বেশ কয়েকজন আলেমকে পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তন অনুষ্ঠানে তোলা হয়েছিল ছবিটি। অথচ রিপোর্টে ওই ছবি সম্পর্কে বলা হয়েছে, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ বাংলাদেশের আলেমদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তার প্রতিবাদে বাদ জুমা কাবার খতিবসহ বিখ্যাত আলেমরা মানববন্ধন করছেন। কেবল তাই নয়, মানববন্ধনের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে খতিবের বক্তব্যও ছাপানো হয় রিপোর্টে। রিপোর্টের সঙ্গে প্রকাশিত রঙিন ছবিটি আরবি একটি সাইটে ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর আপলোড করা হয়। কিন্তু আমার দেশের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মানববন্ধনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সুত্র : লেখাটি দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকা থেকে কপি করা হয়েছে ।

0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ