মঙ্গলশোভাযাত্রা

নাজমুস সাকিব রহমান ১৫ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ১২:৩০:২৪পূর্বাহ্ন ছোটগল্প ১০ মন্তব্য

এগারোটায় মঙ্গলশোভাযাত্রা ছিল। আমি ঘুম থেকে উঠলাম দুপুর দুইটায়। ততক্ষণে পান্তার আয়োজন প্রায় শেষ। যারা নববর্ষ বরণ করতে বেরিয়েছিল, তাদের এনার্জিও শেষের দিকে। এই রকম সময়েই আমি বাসা থেকে বের হলাম। ভাতিজার আকীকার দাওয়াত ছিল। কিসের পান্তা, কিসের ইলিশ—আমি সেখানে কবজি ডুবিয়ে খাসির রেজালা খেলাম। একটু পর চলে আসছি দেখে একজন বলল,—আরে কৈ যাও? মাত্রই তো খাওয়া দাওয়া করেছ। এখন কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি দাও। ভাল লাগবে।

দুপুরের ঘুমের আলাদা আরাম আছে। এটা আরো গভীর ঘুমের দিকে নিয়ে যায়। ডাবল বেডের বিছানা দেখে আমি তার সঙ্গে একমত হলাম। বিশ্রামের দরকার তো অবশ্যই—কিন্তু সাড়ে তিনটা পেরিয়ে গেছে। বিকেলের আগের এই সময়টাতে কলেজ রোডে হাঁটতে ভালো লাগে। পথিমধ্যে পিকাসো, বুনয়েল, দান্তে হাজির হয়। এই ভালো লাগাটাই হতে পারে সেই বিশ্রাম। আমি হাঁটতে লাগলাম। হাঁটাহাঁটিও তো বিশ্রাম হতে পারে।

একটু পরেই মহসিন কলেজ আর চট্টগ্রাম কলেজের সামনে চলে এসেছি। দুইটা কলেজেই লম্বা চুলের ব্যান্ড এসেছে। সমানে বর্ষবরণ চলছে। উচ্চ স্বরে গান-বাজনা হচ্ছে। একদিকে সুলতানা বিবিয়ানা, সাহেব বাবুর বৈঠকখানা গাইছে। আরেকদিকে বেদের মেয়ে জোছনা। আচ্ছা, এরা কি কেউ আসাদুল্লাহ দেহেলভীকে চেনে? মনে হয় না। কলেজের মেইন গেইট দিয়ে ছেলেমেয়েরা ঢুকছে আর বের হচ্ছে। আমি কার গান শুনবো? বুঝতে না পেরে খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম।

আমার বিভ্রান্তি কাটল এক পথচারীর কথায়। তিনি সিগারেট ধরাবেন, আগুন পাচ্ছিলেন না। আমাকে বললেন, ভাই, আপনার কাছে আগুন আছে? আমি যেহেতু ভদ্রলোক—পকেট থেকে লাইটার বের করলাম। উনাকে আগুনের সংকট থেকে উদ্ধার করতে করতে বললাম, মানবসভ্যতার প্রথম উন্নয়ন হল আগুন। পাথর ঘষা আগুন। আপনার জন্য সেই উন্নয়ন থমকে আছে। এই কথা শুনলে লোকজন কী বলবে বলুন তো?

এ কথায় তিনি মুচকি হাসলেন। কথা বাড়াতে চাইলেন। বললেন, তার বোন মহসিন কলেজে পড়ে। তাকে দিতে এসে আটকে গেছেন। আর এত কাছাকাছি দুইটা স্টেজ হওয়া ঠিক হয়নি। আমি কিছু বললাম না। তাকে এড়িয়ে এগিয়ে গেলাম। পহেলা বৈশাখে একলা থাকা যায়, এক জায়গায় থমকে থাকা যায় না। অথচ গুলজার মোড়ে এসে আমাকে থমকে যেতে হল। ইতিমধ্যেই প্রচুর কাপল দেখে ফেললাম।

চট্টেশ্বরীর মোড়ে, চট্টগ্রাম গ্রামার স্কুলের অপজিটে একটা চায়ের দোকান আছে। আমি সেই দোকানে গেলাম। দোকানিকে বললাম, মামা, একটা গোল্ডলিফ দেন তো। এর আগে আমার কাছে আগুন ছিল, সিগারেট ছিল না। আজকাল এরকম প্রায়ই হয়। আগুন আনতে সিগারেট ফুরায়। এই স্ট্রাগলের কথা কেউ বলতে চায় না। অনেকে লজ্জা পায়।

দোকানি আমাকে গোল্ডলিফ দিলেন। সেই গোল্ডলিফ বের হল ডার্বির প্যাকেট থেকে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। একটু পর কাহিনীটা জানতে চাইলাম। মামা বললেন, আছে না কিছু লোকজন, দোকান চালালে যাদের টাকা দিতে হয়, সিগারেট দিতে হয়; ওরা করে কী—এসেই দামি সিগারেটের প্যাকেটে হাত দেয়। সস্তা সিগারেটের প্যাকেট খোলে না। এইজন্যই এই ব্যবস্থা। আমি বেনসন রেখেছি নেভির প্যাকেটে।

আমি হাসলাম। বললাম, মামা, তুমি তো অনেক চালাক।

কী বলেন মামা?

হ্যাঁ। চালাকই। চিনির বোয়ামে পিঁপড়া আসে। পিঁপড়া থেকে বাঁচতে এক লোক বোয়ামের ওপর লিখে রেখেছিল—'লবণ।' গল্পটা শুনো নাই? মামা হেসে দিলেন। তার হাসির অর্থ স্পষ্ট। তিনি গল্পটা শুনেছেন। আমার প্রশংসাও গ্রহণ করেছেন। তার চেহারা ব্লাশ করছে। আমি মোবাইলের স্ক্রিন বের করে তাকালাম। পাঁচটা বাজতে তখনও দেরি আছে।

একটু পর চারুকলার দিকে হাঁটা দিলাম। আগের রাতে বাদশা মিয়া রোডের এই ক্যাম্পাসে বর্ষবরণের আয়োজন হচ্ছিল। এর পেছনে চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীরা প্রচুর শ্রম দেয়। আমি এটা বুঝতে পেরে ঠিক করেছিলাম, এবারের মঙ্গলশোভাযাত্রায় যোগ দেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। জীবনে এইরকম কত কিছু যে হয়নি—এটা ভাবতে গিয়ে ঈদের জামাতের কথা মনে পড়ল। অনেকবার বেচারাকে ধরতে গিয়েও ধরা হয়নি।

ছবি : নাজমুস সাকিব রহমান

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ