ভাইবোন সকলেরই ভাগ্য লিখন

রিমি রুম্মান ১০ এপ্রিল ২০১৯, বুধবার, ১০:৪৬:৪৫পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৭ মন্তব্য

জীবনের এ বেলায় এসে হিসেব করে দেখলাম, একই মায়ের গর্ভে বেড়ে উঠা আমার ভাইবোনের সাথে কাটানো সময়টি খুব সংক্ষিপ্ত ছিল। যে টুকুন সময় আমরা তিন ভাইবোন এক ছাদের নিচে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছি, তারও অধিক সময় দূরে থেকেছি। শুধুই দূরে নয়, একেবারে ধরা ছোঁয়ার বাহিরে মানচিত্রের ঠিক উল্টো দিকে, হাজার হাজার মাইল দূরে। যখন আমরা এক ছাদের নিচে বাবা-মায়ের সংসারে ছিলাম, কারণে অকারণে ঝগড়া লেগে যেত। আমি ভাবতাম আপাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, আমাকে আমলেই নেয়া হচ্ছে না। আবার ভাইটা ভাবতো আমাদের দুইবোনের সব চাহিদা আম্মা চাওয়ার আগেই পূর্ণ করে দেন, অথচ সে হাজার চেয়েও কাঙ্ক্ষিত জিনিষটি পাচ্ছে না। আবার আব্বা ভাবতো আম্মা একমাত্র ছেলেকে অহেতুক আস্কারা দিচ্ছেন। ভাইটা বয়সে ছোট হলেও জেদ বেশি ছিল। পান থেকে চুন খসলেই এসে ধুরুম ধুরুম মারতো আমায়। বিবাদের সময় আম্মা তেড়ে আসতেন। কখনো রান্নাঘর থেকে ডালের ডাব্বা কিংবা কাঠের খুন্তি ছুঁড়ে মেরে বলতেন, ' অজাতের ঘরের অজাত, এমন দিন আসবো যে একটা আরেকটার চেহারাও দেখবি না, হাজার কানলেও (কাঁদলেও) না।' এইচ এস সি পাশের পরই আমরা একে একে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি। আপা চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে, আমি ঢাকায় ইডেন কলেজে, সবশেষে ভাইটি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার আগেই আমি দেশ ছাড়ি। এরপর বাবার বাড়িতে ফেরা হয়েছিল আমাদের কখনো কখনো। সে ফেরা আগের সেই ফেরা নয়। তা ছিল ক্ষণিকের অতিথি হয়ে ফেরা। মায়েদের কথা কী সব সময় সঠিক হয় ? সময়ে আম্মার কথাই ঠিক হোল। নিয়তি আমাদের দূরে সরিয়ে দিলো। হাজার কাঁদলেও আমরা আর কেউ কাউকে দেখতে, ছুঁইতে পারতাম না।

শুরু হোল আমাদের চোখের জলে বুক ভাসিয়ে চিঠি লেখালেখি। সেইসব চিঠি পড়ে প্রবাসে আমার হাহাকার আর দুঃখ জমে ভারি হয়ে থাকা দিনগুলোয় খানিকটা স্বস্তি মিলতো বৈকি। চিঠি পড়ে পড়ে কয়দিন স্মৃতির ভেলায় ভাসতাম। কতো কতো ভাবনা ডানা মেলে উঁকি দিতো মনের জানালায় ! ভাইটা ইডেনের গেটে দেখা করতে এলে রিকশায় চেপে বসতাম দু'জন। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের নিরব রেস্টুরেন্টে নানান পদের ভর্তা- ভাজি দিয়ে ভাত খেতাম। পড়ে থাকুক আমার হলের ডাইনিং এর কব্জি ডুবানো পাতলা ডাল, একটুকরো আলুর ঝোলে ডুবে থাকা ছোট্ট মাছের টুকরো। ওর জন্মদিন ঘনিয়ে আসার আগেই ডাইনিং এর খরচ বাঁচিয়ে বঙ্গবাজার থেকে সস্তায় কালারফুল শার্ট কিনে আনতাম। সেটা হাতে পেয়ে তার চোখে মুখে যে আনন্দ খেলে যেতো, তা দেখে আমি আড়ালে চোখ মুছতাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে চলে যাবার সময়টাতে দু'জনেরই চোখমুখ বেদনার্ত হয়ে উঠত। ছুটির দিনে হল থেকে আপার ধানমণ্ডির বাসায় বেড়াতে গেলে আপা যত্ন করে ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়াতো। প্রবাসে চলে আসার আগে এয়ারপোর্টে আপার বিষণ্ণ বিদায়ী মুখখানি প্লেনের পুরোটা পথ বুকের ভেতরটায় তীব্র হাতুড়িপেটার মতো করে চূর্ণবিচূর্ণ করেছিল। সে বিচ্ছেদ বুকের ভেতরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছিলো অনেকগুলো দিন।

এরপর কালের গর্ভে হারিয়ে গেলো বহু বহু বছর। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন বাবা-মা। আমাদের মাথার উপরের ভরসার হাত, ছায়া সরে গেলো চিরতরে। ভাইবোন দু'জনেই সংসার সামলে হিমশিম দশা। যোগাযোগ আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। কিন্তু ব্যস্ততা বেড়েছে। লোক পেলেই আপা এটা সেটা পাঠায়। নানাবিধ বিষয়ে আমায় স্বার্থহীন উপদেশ দেয়। পৃথিবীতে একমাত্র বোনই বোধহয় বোনের কাছে প্রাণ খুলে জগতের সকল সুখদুঃখ ভাগাভাগি করতে পারে। আমার রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলা যাপিত জীবনের কথা শুনে আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, ' পাঁচ মিনিট সময়ও যদি পাস, হাত-পা টানটান করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকিস, কিছুটা রেস্ট অন্তত হবে। দেশে গেলে বলে, ' তুই এতো রোগা হইসিস ক্যান !' এক ভোরে ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে যায় হাসপাতালে। খালি পেটে নাকি ব্লাড দিতে হবে। যতো রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা আছে, সব করিয়ে রিপোর্ট দেখে তবেই শান্তি তার ! ' দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে ভাইটাকে নিয়ে এলাম নিজের কাছে। দেশে আরাম আয়েশে থাকা ভাইটা রোজ ভোরে উঠে কাজে যায় এই ভিনদেশে। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে। রাতের খাবার শেষে ব্যথার ওষুধ খায়। আমি আরো একধাপ এগিয়ে ভিটামিন ওষুধ এগিয়ে দেই। পুষ্টিকর খাবার দেই স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা ভেবে। কখনো রাস্তা হারিয়ে আধা ঘণ্টার পথ দুই ঘণ্টায় ফুরায় তার। তবুও তার এখানেই ভালো লাগে। ধূলা, ধোঁয়া, শব্দ নেই। সবকিছু নিয়মের মাঝে চলে। পরিচ্ছন্ন নিরাপদ জীবন।

ভাইবোন সম্পর্ক বুঝি এমনই। জ্বলতে থাকা লোবানের মতো। যার সুগন্ধ ঘরময় ভেসে বেড়ায়। এ সম্পর্ক আবেগের। ভালোবাসার। মায়ার। সংঘাতে অভিঘাতে একসাথে পথ চলার। জটিল এই পৃথিবীতে বাবা-মা'র অবর্তমানে ভাইবোনেরাই একের বিপদে, দুঃসময়ে অন্যজন হাত ধরে টেনে তুলে আনে। সব ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও চিন্তাক্লিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠে, ' তুই এতো রোগা হইসোস ক্যান !

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ