বীরাঙ্গনা-১

মারজানা ফেরদৌস রুবা ৫ ডিসেম্বর ২০১৪, শুক্রবার, ০৪:১৭:৫৩অপরাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ৩১ মন্তব্য

১৯৭১ সালে ৯ মাস ব্যাপী যুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী দ্বারা ধর্ষিত বীরাঙ্গনাদের করুণ পরিণতির পেছনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিলো এদেশেরই কিছু লোক রাজাকার-আলবদররা। তাদের সাহায্য নিয়েই মিলিটারিরা অসহায় নারীদের উপর তাণ্ডব চালিয়েছিলো, যে তাণ্ডবের যন্ত্রণা তাঁরা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।

শ্রীপুরের বীরমাতা মমতাজ
গর্ভাবস্থার নয় মাস চলাকালীন সময়ে আট পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক ধর্ষিত হন। যার ফলে জরায়ু ও পায়ুপথের সাথে প্যাঁচিয়ে পচে গলে শিশুটি গর্ভেই মারা যায়। তিন মাস পর হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রী মমতাজের পেট থেকে মৃত শিশুর হাড়গোড় বের করা হলেও চিরদিনের জন্য তাঁর পায়ুপথ ও যোনিপথ অকেজো হয়ে যায় । ডাক্তাররা তাঁর তলপেট কেটে তাঁর কোলনটি (পায়খানার রাস্তা) বের করে দেন আর গত বিয়াল্লিশ বছর ধরে এভাবেই তিনি মলত্যাগ করে আসছেন। অসহায় মমতাজ কোলন ব্যাগ কেনার ক্ষমতা না থাকায় পরনের ছেঁড়া ময়লা-নোংরা শাড়ি দিয়ে কোলনটি ঢেকে রাখেন। ময়লা শাড়ি আর বাতাস থেকে জীবাণু মিলেমিশে তাঁর কোলনটি ঘাঁ হয়ে একাকার, সবসময় কোলন দিয়ে রক্ত পড়ে।

রানীশংকৈল গ্রামের মোখলেছা, মালেকা, আমিনা, বুদি
চার বোনই বীরাঙ্গনা। যুদ্ধের শেষের দিকে মিলিটারি ক্যাম্প থেকে পালাতে সক্ষম হলেও জীবনের নির্মম সত্য থেকে পালাতে পারেননি। বাড়ির পেছনে জঙ্গলে সারাদিন লুকিয়ে থাকতেন। গ্রামের মানুষ তাঁদের দেখলেই তাড়া করত, যেন ওঁরা অচ্ছুৎ কোনো প্রাণী, ধুর! ধুর! করে খেদিয়ে দিত! সবার পরনে কাপড়ও ছিল না। একটা কাপড় পরে এক বোন লোকালয়ে বের হয়ে খাবার আনতে যেতেন। বাকি তিনজন নগ্ন লুকিয়ে থাকতেন সেই জঙ্গলে। আমিনা পরিচয় লুকিয়ে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু স্বামী তাঁর বীরাঙ্গনা পরিচয় জানতে পেরে সেই অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি হিসাবে ইট দিয়ে মেরে হাত, পা, দাঁত সব ভেঙে দিয়ে সন্তানদের তাঁর ঘাড়ে ফেলে রেখে চলে যায়।

কুমিল্লার বীরমাতা আম্বিয়া
পাক সৈন্যরা তাঁকে ধর্ষণ করলে তিনি গর্ভবতী হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর সন্তানটি জন্ম নিলে ‘শিশুটি বৈধ নয়’ এই ফতোয়া দিয়ে মসজিদের ইমাম শিশুটির মুখে লবণ দিয়ে তাকে মেরে ফেলে। অবিবাহিত অবস্থায় সন্তান হয়েছে মর্মে তাঁকে অসতি বলে ফতোয়া জারি করা হয় এবং পরপর চল্লিশ দিন তাঁর দুহাতে চল্লিশটি করে বেত্রাঘাতের আদেশ করা হয়, ফলে থেতলে যায় তাঁর হাতের পাতা দুটো। এরপর বেঁচে থাকা অবস্থায় তিনি ভাইয়ের সংসারে দাসী হয়েই পড়েছিলেন। সম্প্রতি আম্বিয়া মারা গেছেন।

বীরমাতা রমা চৌধুরী
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাহিত্যে মাস্টার্স করে পেশা হিসেবে বেচে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতাকে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পর নিকটজন সহ সমাজের লোকদের কাছ থেকে শুরু হয়েছিল তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্চিত হবার পালা। এখন তিনি ফেরি করে নিজের লেখা বই বিক্রি করেন। তাঁকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন এমন কিছু বাঁধা গ্রাহকই তাঁর বই কিনে নেন। এ পর্যন্ত ১৮টি বই তিনি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ”আমি বই বিক্রি করি, যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারিনা সেদিন উপোস থাকি। মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব, সবই মুক্তিযুদ্ধের অবদান। আমার ভিতরে অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে সব বলতে পারিনা, কালি দিয়ে লিখে যাবো। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।“ ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় নিজের ধর্ষিত হবার কাহিনীর পাশাপাশি রমা চৌধুরী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতার বর্ণণা দিয়েছেন।

এই হচ্ছে আমাদের বীরাঙ্গনাদের জীবনের সুঁচে খোদাই করা নকশি কাঁথা। ঠাঁই হয়নি সমাজ নামের শৃঙ্খলিত প্রাচীরে। স্বীকৃতিও মেলেনি এক বিন্দু। মিলেছে শুধু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা আর বীরাঙ্গনা জীবনের জন্য তিরস্কার। এমনকি পরিবারেও ঠাঁই মেলেনি তাঁদের, পড়ে ছিলেন স্টেশনে, নদীর পাড়ে। দিনের পর দিন অভুক্ত, কখনো কখনো পরনে হয়তো কোনো কাপড়ও থাকত না।

পাকিস্থানি মিলিটারিরা কিন্তু এদেশের অলিগলি কিছুই চিনতো না। কোন ঘরে মেয়ে আছে তা জানার বা চেনার তাদের কোন উপায়ই ছিলো না। তাহলে কে চিনিয়েছে বা জানিয়েছে তাদের???

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ