অনিমিখ পলক জানতে চেষ্টা করে জীবনের কাছে বার বার। কেন থমকে যায় সময়ের কাছে স্বল্প সময়ের দাবি দাওয়া? প্রশ্নেরাও অথর্ব পঙ্গুত্বের পরিচয় উত্থাপনে ব্যস্ততার অজুহাত খোঁজে নিরলস প্রচেষ্টায়। শব্দেরা যেখানে হাঁটু ভেঙে মাথা নুইয়ে থাকে পরাজিত যোদ্ধার মত! সেখানে সমস্ত পৃষ্ঠা সাদা হতে হতে বাদামী রং ধারন করে।  আঙুলের হাড় মজ্জায় অলসতা যোগ হয়ে যায় নির্ভাবনায়।  নিশ্চিন্ত ভাতঘুম এখন তাড়িত করে ফেরে অসম বিলাসিতায়। স্থুলাকার ধারন করে নিচ্ছে বৈরী বাতাস। নিয়তি জানে নিয়তির ধরন। আমাদের সহজ যাপনে অতর্কিতে এসে সামনে এসে গ্যাট হয়ে ফয়সালা ধরিয়ে দিয়ে বলে যায়.... " আমি তো এমনই! আমাকে না মেনে যাবে কোথায়?"  গলা চিড়ে ফেরে চিৎকার করে করে শোক চলে উপুর্যুপরি।  আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়।

কষ্ট! শুধু আক্ষরিক শব্দ দিয়ে যদি বোঝানো যেত এর পরিমাপ! সর্বময় অধিকর্তা জানেন সবটাই। তিনিই  একমাত্র নিয়তি নিয়ন্ত্রক।  ঢেউয়ের পরে ঢেউ আসছে মহামারীর।  নিভছে না শ্মশানের আগুন।

কমছে না কবর খননের কাজ!

সারি সারি সাদা কাফনের ভীড় বেড়েই চলছে তো বেড়েই চলেছে। এই যে এত এত শোক! কাছের মানুষ,দূরের কেউ, পরিচিত, অপরিচিত, জানা- অজানার এত এত জীবন!! যাচ্ছে  যাচ্ছে যাচ্ছে......  ক্রমাগত সংখ্যা বাড়ছে। কাছের জনও আক্রান্তের খবর আসে, চিন্তিত হতে হতে নতুন নতুন রোগের জন্মও হচ্ছে শরীর জুড়ে। ব্লাড প্রেসার, ডায়বেটিস, ইনসমোনিয়া। মৃত্যু অনিবার্য কে না জানে?

সেই যখন জন্ম হলো! সেই থেকেই তো একটু একটু করে এগিয়ে যাই সবাই ওই পথেই! যেতে হবে জেনেই! কী মোহেই ভুলে থাকা!  কী মোহেই না এই রঙ্গ ভরা রঙের দূনিয়ায় হেঁটে চলা! তারপর যখন চরম সত্যতা সামনে এসে টান মেরে নিয়ে যায়...... " এটাই নিয়তি" বলে শান্তনা পেতে প্রবোধিত করার জন্য নিজেদের আবার নিয়মিক ভাবেই ভুলে গিয়ে হাঁটতে/ দৌড়তে শুরু করি রঙের গোলায়।

নৌকা ডুবছে- মৃত্যু বাড়ছে

লঞ্চ ডুবছে- সংখ্যা গোপন করেও সংখ্যা কমছে জীবিতের।

প্রকৃতি রুদ্ররূপ ধারন করছে- মৃত্যু

সড়কে অনিয়ম বাড়ছে- মৃত্যু

ঘনবসতিতে অনিয়মিক বসবাস- মৃত্যু

কারখানায় অনিয়ম- মৃত্যু

বেপরোয়া জীবন যাপন- মৃত্যু

মৃত্যু আমাদের সাথে সাথেই থাকছে মিশে। আমরা বেখেয়ালি, বেপরোয়া। বলছিনা খেয়ালে বা নিয়মিক চললেই এড়ানো সম্ভব।  জানতে ইচ্ছে করে স্বাভবিক মৃত্যু বলে আসলে কী বুঝতে চাই। এক একটা দুর্ঘটনার পর শান্তনা পেতেও মনে হয় আমরা নানান ধরনের মনগড়া উপাত্ত উত্থাপন করার জোড় চেষ্টা চালাই। এমন হলে এমনটা হতো না।

অমন করলে অমন হতে পারত।

সময় মত চিকিৎসা হয়নি।

কতশত শব্দ খরচা হয় আমাদের অতি জ্ঞানী মস্তিষ্ক থেকে! পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি। যখন যা ঘটবার তা খন্ডায় সাধ্যি কার কত?  তাই বলে নিয়ন্ত্রিত নিয়ম অস্বীকার করব? না,  মোটেই না,বলছি বেপরোয়া বঞ্চিত,বিবর্জিত,বিতর্কিত শব্দ উচ্চারনে সামলাই নিজেদেরকে।

-- আম্মু, নওশাদ মারা গেছে.....

: নওশাদ কে?

মেয়ে বিরক্ত হলো আমার উপর।

-- তুমি কয়টা নওশাদের নাম জানো?

মেয়ের বন্ধুদের নামগুলো মনে করে ঘুরে এলাম কয়েক মুহুর্ত। লাভ হলো না। এ নাম তাদের মধ্যে মনে পড়ছে না।( এটা চরম এক বিষয় আমার জন্য। যা প্রায়ই আমাকে বিপদে ফ্যালে। মনে না থাকা) মেয়েকে বেশি রাগাতে চাইলাম না বলে সহজেই হার মেনে নিয়ে......

: মনে করতে পারছি না। মনে নেই।

অন্য সময় হলে সামনে থেকে রেগে মেগে কিছু না বলেই উঠে নিজের রুমে চলে যেত। মেয়ের মুখ দেখে আঁচ করে নিলাম She is so much herated..আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি মেয়ের দিকে। মেয়ে শান্ত স্বরেই বলল-- তাম্মী- নওশাদ!! ভুলে গেছো?

আমি আচমকা বিমূঢ়। কয়েক সেকেন্ড বোবা।

: ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজেউন........নওশাদ? নওশাদ? নওশাদ নেই?  কি হইছিলো? অনেকদিন শুনিনি ওর কথা!!

-- ওর বাবা কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে। আজ ফিরছিলো ময়মনসিং থেকে ৪০ দিনের কার্য সম্পন্ন করে। নওশাদ বাইকে ছিলো বাকি সবাই মাইক্রোতে আসছিলো। স্পট ডেড্।

মাথা চেপে ধরে থ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ।  ছেলেটাকে দেখিনি কখনো। অনেক আগে মেয়ের বান্ধবির বড় বোনের বিয়ের ছবিতে দেখেছিলাম নওশাদের ছবি। তারও আগে থেকে ছেলেটার গল্প শুনে শুনে ছেলেটা চেনা হয়ে উঠেছিলো খুব। সেনা অফিসারের একমাত্র ছেলে। উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে মেয়ে গুলো যেমন হয় আরকি!! প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্যেও কিছুটা এলোমেলো। নওশাদও তেমন। তাম্মী নওশাদের প্রতি দুর্বল। নওশাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠা ছাড়া নিজস্ব কোনো এ্যাচিভমেন্ট ছিলোনা। তবু তাম্মী ছাড়তে পারেনি নওশাদকে। তাম্মী প্রতিষ্ঠিত পরিবারের মেয়ে। নিজেও মিডিয়ায় বেশ ভালো প্রতিষ্ঠিত। তাম্মী আমার মেয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমি বুঝছি তাম্মীর মনের অবস্থা।

: তাম্মীর কী অবস্থা?

-- ও কাঁদতেও পারছে না, বোঝোইতো....

: ওর দিকে খেয়াল রাখিস। তাম্মী এখন আরো ডিপ্রেশনে পড়ে যাবে। ওকে সর্বত মেন্টালি সাপোর্ট দিও।

-- আম্মু, পিকআপ ভ্যান নওশাদের মুখের ওপর দিয়ে চলে গ্যাছে। পুরো মুখ থেতলে গেছে। ওকে চেনা যায়নি নাকি!

: কিভাবে জানলি?

-- তাম্মীর সাথে নওশাদের বোনের কথা হয়েছে। আমার শুধু বার বার মনে পড়ছে মেহনাজ'দির হলুদের দিনের কথা। সেদিন ছিলো তো আমাদের সাথে। আমরা কত ছবি তুললাম!

নওশাদ নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলো আম্মু: চাকরিতে যোগ দিয়েছিলো। বদঅভ্যাসগুলো ছাড়তে চেষ্টা করছিলো বাবার মৃত্যুর পর। কয়েকদিন আগেও স্টাটাস দিয়েছিলো বাবাকে উদ্দেশ্য করে যার লাস্ট লাইনটা ছিলো এ রকম---" খুব ভালো থাকুন........  দেখা হবে ইনশাল্লাহ"  এত তারাতারি নওশাদ বাবার সাথে দেখা করতে চলে গেলো!!

এখানে বলতে পারি, কেন ছেলেটা বাইকে চড়ে রওয়ানা দিলো? কেন অন্যদের সাথে মাইক্রোতে উঠলো না? কতকিছুই তো বলতে পারি! আমি শুধু বললাম..... ওর যাত্রা এ পর্যন্তই ছিলো যে!

চারিদিকে এখন শুধু মৃত্যু মৃত্যু আর মৃত্যু।

আপনি আমি প্রস্তত আছি তো??

# হে মহান স্রষ্টা দয়াময় আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ