বাতাসে মৃত্যু-গন্ধ

সাবিনা ইয়াসমিন ১৮ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১১:২৮:১৮পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ৩২ মন্তব্য

 

” মা-বাবারা আমাদের একটু সাহায্য করেন। সারারাত কিছু খাইনি, আপনাদের বাসি খাবার গুলো দিয়ে আমাদের একটু সাহায্য করুন ” এভাবে ডেকে এলাকার অলি-গলির দ্বারে দ্বারে ঘুরছে ক্ষুধার্ত মানুষেরা।

প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে, প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা, কখনো কখনো রাতের প্রথম অংশ- অব্দি চারদিক থেকে ভেসে আসে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ। সকালের দিকে যারা আসে তারা সাধারণ ভিক্ষুক, নারী পুরুষ। স্বাভাবিক সময়ে এদের অল্পকিছু মানুষ বাড়ি বাড়ি ঘুরে আর বেশিরভাগেরা চলতি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে/ বসে পথচারীদের কাছ থেকে ভিক্ষা/ সাহায্য নিতো। এখন রাস্তায় পথচারী নেই, তারা আসে বাড়িতে বাড়িতে। এদের মুখে মাস্ক থাকেনা। যাদের পায়ের স্যান্ডেলের ফিতা ছিড়ে যায়, পরনে থাকে শতচ্ছিন্ন কাপড়চোপড়, তারা মাস্ক পরবে কিভাবে!

দুপুরের পর আসে আরেকদল। তাদের কণ্ঠেও একই আর্তি। ” আমাদেরকে একটু সাহায্য করুন “। এরা নারী। বিভিন্ন বয়সের। কেউ মধ্য বয়স পেরিয়েছে, কেউ যুবতী, কেউ কেউ সদ্য কিশোরী। কারো হাতে/কোলে ছোট ছোট বাচ্চা। এইমুখ গুলো মোটামুটি পরিচিত। মহামারীর আগে তারা যে যার মতো স্বাবলম্বী জীবন কাটাচ্ছিলো। বাসা-বাড়ির কাজ, দিন মজুরের কাজ, ফুটপাতে এটা-সেটা বিক্রি করে তাদের দিনগুলো কোনো ভাবে পার হয়ে যেতো। কিছু লজ্জা/আত্মসম্মান ছিলো তাদের। কিন্তু পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে তারাও এখন দ্বারেদ্বারে ঘুরছে সাহায্যের আশায়। লজ্জা দিয়ে ক্ষুধা ঢেকে রাখা যায় না।

আরও কিছু মানুষ বেঁচে আছে বেঁচে থাকার নামে। যাদের মাস শেষে নির্দিষ্ট বেতন নেই, তারা নিজেদের উদ্যোগে ঘরে থেকে আয় করার পথ বের করেছিলো। আবার তাদের কেউকেউ বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে অথবা ছোটছোট স্কুলে/ কোচিং সেন্টার গুলোতে নামমাত্র বেতনে চাকরি করে নিজেদের জীবন-সংসার টিকিয়ে রাখতো। এরা কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না। খুব কাছের মানুষের ছাড়া তাদের দুরবস্থার কথা কাউকে জানায় না। আত্মমর্যাদা তাদের গলা টিপে ধরে। লজ্জা/ আত্মমর্যাদা তাদেরকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যাবে, তবু্ও মুখ ফুটে নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে পারে না। তারা বেঁচে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।

৭১ এর যুদ্ধ দেখিনি, যুদ্ধ পরবর্তীর দুর্ভিক্ষের কোনো কিছুই স্বচক্ষে দেখিনি। ছবিতে দেখেছি, বড়োদের কাছে শুনেছি, বইতে পড়েছি, অনুমান করে নিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা আমাদের চারপাশে মৃত্যু-ক্ষুধার এখন যেসব রূপ দেখতে পাচ্ছি তার সাথে ঐসব অনুভব-অনুভূতির কোনো মিল পাই না। শুধু উপলব্ধি করছি, বাস্তব ভয়াবহতা সব জানা/শোনা/কল্পনার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।

কারো মৃত্যু সংবাদ পেলে সর্বপ্রথম মুখ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো ( ইন্না-লিল্লাহ ) আগে উচ্চারণ করতাম বেদনাহত হয়ে। এখন, বিড়বিড়িয়ে বলে যাই। চমকে উঠি মসজিদের মাইকে প্রতিটি নাম ঘোষিত হওয়ার পর।

“ ইনিও চলে গেলেন! এইতো সেদিন তাকে হেটে যেতে দেখেছি, একদম সুস্থ ছিলেন ”…..।

ছোট থেকে যাদের শাসন-আদরে অথবা দেখে-দেখে বড়ো হলাম, হঠাৎ করেই যেন সেইসব প্রাচীন বৃক্ষগুলো কেউ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আশ্রয়ের আগল হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের উপর থেকে। ছায়াহীন, মায়া-হীন হয়ে যাচ্ছে এই চিরচেনা পৃথিবীটা।

দিনের শোকগাথা থেমে থাকেনা রাতেও। রাত যেন নিজের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেসে আসে স্বজন হারানোর আর্তনাদ। হুহু করে ছুটে আসা বাতাসটা ক্রমাগত ভারী হতে হতে বুকের ভেতরটা শূন্য করে দিতে চায়। হাস্নাহেনার সুগন্ধ আরও আতংক ছড়িয়ে চঞ্চল করে দেয় নির্ঘুম রাত।

কবে ফুরাবে এই অন্ধকার? এই জীবনেই কি আসবে আলোকিত ভোর? এমন একটা রাত কি আসবে, যে রাতের বাতাসে থাকবে না মৃত্যুর গন্ধ-ক্ষুধার্তের আর্তচিৎকার…..?

0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ