বাকের ভাই( একটি সত্য ঘটনা অবলম্বে লিখা)

আহমেদ পরাগ ১২ ডিসেম্বর ২০১৪, শুক্রবার, ১০:২৩:৪৫পূর্বাহ্ন বিবিধ ১২ মন্তব্য

একঃ

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ফার্মগেটের ঘুপচি গলিতে সিগারেটের শেষ লেজ টুকু  টান  দিয়ে শোভন ধীরে ধীরে ক্লাসিক কোচিং সেন্টারের  দিকে হাটা ধরল।  ভোরের  এই সময়টি তার ভীষণ  পছন্দ। গাড়ি ঘোড়ার ভিড়  অনেক কম। বিদ্যুতের নড়বরে তার গুলোতে কাক আর কবুতর গুলো বসে  কিচ কিচ  শব্দ করে  কি যেন এক বোঝাপড়া সেরে নেয়। শহরটা  যেন প্রস্তুত হয় আরেকটা নোংরা দিনের জন্য।

কোচিং সেন্টারের ছাত্রী  গুলো নামছে রিকশা থেকে এক এক করে। “শালা- আমরা আসি  বাসে বাদুড় ঝোলা হয়ে আর  নবাবজাদিরা আসছেন  রিকশা আর গাড়ি চড়ে”-মনে মনে খিস্তি করল শোভন। সাদা একটা টয়োটা-করওলা এইমাত্র এসে থামল গলিটার মুখে। খুব ফর্সা আর হাল্কা পাতলা এক মেয়ে নামল  গাড়ি  থেকে। ঢাকা ভার্সিটির  মুনা আপাকে দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেলো শোভনের। হাজার হউক আরমান ভাইয়ের ‘মুরগি’। আরমান ভাই কে শোভনরা  ডাকতো  ‘বাকের ভাই’ বলে।

মুনা আপা খুব নরম স্বভাবের মেয়ে। কথা বলেন এত নরম ভাবে যেন মাটিও শুনতে না পায়।সাজগোজের  কোন বালাই  নেই-সারাক্ষন পড়াশুনা আর লেকচার নোট্‌স নিয়েই ব্যাস্ত।

সুন্দরী মেয়ে গুলো যে কেন সাজেনা শোভনের মাথায় সেটা কোন ভাবেই ঢোকেনা- যত সাজগোজ সব করবে ওই সব  পয়মাল মেয়ে গুলো। ‘পয়মাল’   আর ‘মুরগি’ শব্দ গুলো ইদানিং সে শিখেছে কোচিং ক্লাসের ছাত্রদের কাছ  থেকে।  শব্দ গুলো তার ভারী পছন্দ হয়েছে। কোচিং ক্লাসে অনেক খারাপ খারাপ ছেলেদের সাথে মেশা হচ্ছে আজকাল।

দুইঃ

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

আরমানঃ কি মুনা? আজকে কিসের উপর  লেকচার দিচ্ছ?

মুনাঃ খুব বোরিং একটা  টপিক, আরমান ভাই। ক্লাস নিতেই ইচ্ছে হচ্ছেনা।

আরমানঃ আরে ক্লাস নিতে থাক। ভার্সিটির ক্লাস শুরু হলে তো ভাল ভাল  লেকচার গুলো নেওয়ার ও সময় থাকবেনা।

মুনাঃ সময়  ঠিকই  থাকবে আরমান ভাই। আমি সময় বের করে  ঠিকই চলে আসব।

আরমানঃ তোমার আসা ঠিক হবেনা মুনা। তোমার রেজাল্ট খারাপ হবে।

মুনাঃ (একটু দুষ্টুমি হাসি দিয়ে): তা আমার রেজাল্ট নিয়ে আপনার এত টেনশন কেন আরমান ভাই?

আরমানঃ(এক্ টু লজ্জা পেয়ে): না মানে এত কষ্ট করে এ পর্যায়ে এসেছ, তোমাকে তো অনেক দূর যেতে হবে।

 

তিনঃ

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

শোভন আধা ঘণ্টা ধরে বসে আছে প্র্যাকটিস শিট গুলোর জন্য। “শালার  আরমান এখনও মুনা আপার সাথে গেজাচ্ছে”-খিস্তি দিয়ে উঠল শোভন । প্রেমে মানুষ এত ইনিয়ে-বিনিয়ে পরে কেন  এটা তার মাথায় ঢোকেনা, Straight-cut বলে ফেললেই ত হয়-ল্যাঠা চুকে যায়।

আরমানঃ এই নাও  তোমার প্র্যাকটিস শিট।

শোভনঃ খুব তো  টাংকি মারলেন বস।

আরমানঃ (লাজুকের হাসি)

শোভনঃ  তা  আরমান ভাই, মুনা আপা কে এত ভাল লাগে কেন?(খিক খিক করে হেসে) কি? তার চোখ গুলো খুব ভাল লাগছে, তাই না? না তার চুল?

পাশে বসা মেডিকেল কোচিংয়ের ছাত্র, মোবারক বলে  উঠলঃ “তবে আপনার মুরগি একটু বেশি ফ্ল্যাট, আপনাকে ফিক্স করতে হবে।  অনেক্ টা সুদানের মরুভুমির মত(খিক খিক করে হাসি)”

আরমানঃ চুপ কর মোবারক । দুদিন পর  তোমরা  ভার্সিটি আর  মেডিকেলে  পড়বে। মেয়েদের কে একটু সম্মান করতে শেখ।

মোবারক:  ও বাব্বা, বেপারটা দেখছি খুব সিরিয়াস! আরমান ভাই, এই তো সেদিন মেডিকেল ক্লাসের টুম্পা কে দেখিয়ে বললেনঃ একদম Prairie! আজ খুব ভাব নিচ্ছেন? তা ব্যাপার টা কি?

শোভনঃ মোবারক, তুই চুপ কর। ব্যাপার টা  একটু সিরিয়াস।

আরমানঃ আচ্ছা শোভন, আমাকে একটু বুদ্ধি দাও। আমি কি BBA-MBA লাইনে একটু চেষ্টা করব? আমার তো কোচিংয়ের চাকরীতে কিছুই হচ্ছেনা।

মোবারকঃ  চেষ্টা করতে পারেন তবে আপনার  যেই ঘিলু তাতে  BBA তে তিনবার আর  MBA তে কম সে কম ৫ বার  ফেল করবেন(খিক খিক করে হাসি)

 

চারঃ

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ক্লাস নেওয়ার পর মুনা হন হন করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি  বৃষ্টি পড়ছে।

আরমানঃ  মুনা, এই ছাতাটি নিয়ে যাও, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে।

মুনাঃ এত ভারী ছাতা আমি নিতে পারবনা। আমার হাতে অনেক জিনিস পত্র।

আরমানঃ আচ্ছা  ঠিক আছে, আমি ছাতা ধরে রাখছি চল।

মুনাঃ কিছুটা ইতস্তত …।

মুনাঃ কি ব্যাপার? আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন?

আরমানঃ আমার ভিজলে কিছু হবেনা,  তোমার  জ্বর আর সর্দি লাগবে

মুনাঃ আমার জ্বর আর সর্দি লাগবে আর আপনার কিছু হবেনা? আমাকে খুব দুর্বল ভাবেন, না?

আরমানঃ আমার গণ্ডারের চামড়া, আমার কিছুই হয়না।

মুনাঃ আচ্ছা, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন?

আরমানঃ না মুনা, তোমাকে আমার বলার কিছুই নেই।

আরমানঃ(এক্টা  দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে … আমার বলার সময় এখনও হয়নি।)

পাচঃ

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

ক্লাস  নেয়া র পর মুনা বসে আছে। কোচিং ক্লাস নেয়া থেকে তার আড্ডাবাজিই পছন্দ। আরমান ভাই কি মজার মজার সব গল্প করেন!

এত মজার মানুষ সে আর কখনো দেখেনি। আরমান ভাই যে তাকে খুব পছন্দ করেন সেটা সে বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারছে।

আরমান ভাই সম্পর্কে সে কিছুই জানেনা-তবে মানুষটা ভীষণ কেয়ারিং । আরমান ভাইয়ের গায়ের রঙ তার খুব পছন্দ । মানুষটা কেমন যেন একটু বে-খেয়ালি। মনটা খুব বড়। কত দিন তাকে কোচিং সেন্টারে ক্লাস  নেয়ার পর চটপটি আর চানাচুর খাইয়েছেন। বার বার নিষেধ করা সত্ত্বেও খেতে বাধ্য করেছেন। বাসায়  এই ব্যাপারটার ই  তো খুব অভাব। আব্বু  আর ভাইয়া তাদের  ব্যবসা নিয়ে সারাক্ষন ব্যাস্ত। কে গল্প করবে তার সাথে, কে সময় কাটাবে?

ছয়ঃ

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্ট বের হল।  মোবারক চিটাগাং মেডিকেল কলেজে চান্স পেল। শোভন পেল ঢাকা ভার্সিটিতে। মুনা আপার ক্লাস শুরু হয়ে গেলো ঢাকা ভার্সিটিতে। কোচিং সেন্টার গুলো সব ফাঁকা ফাকা। শোভন দেখল আরমান ভাই চেয়ারে হেলান দিয়ে কি যেন ভাবছেন।

শোভনঃ আরমান ভাই, কি খবর? মুনা আপার সাথে ‘ব্যাটিং’ কেমন চলছে? রাতে টেলিফোনে  নিশ্চয়  লং ইনিংস  খেলছেন?

আরমান ভাই: লং ইনিংস আর খেলা হচ্ছেনা। তোমার মুনা আপা ভীষণ ব্যস্ত। তবে  ছোট ছোট ওভারের ওয়ান-ডে খেলা হচ্ছে।

আরমান ভাই: শোভনঃ, তোমাকে একটা  কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

শোভনঃ কি কথা?

আরমান ভাইঃ আমি কোচিং সেন্টারের চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। আমি  প্রাইভেটে BBA তে ভর্তি হচ্ছি।

শোভনঃ বলেন কি আপনি?? প্রাইভেটে BBA পড়ার জন্য টাকা-পয়সা  কোথায় পাবেন?

 

সাতঃ(পাচ-ছয় বছর পর..............................)

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

শোভন সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে  বেড়াতে আসলো।  স্থানীয় একটি  ব্যাঙ্কে ডলার ভাঙ্গানোর সময়  হঠাৎ করে আরমান ভাইয়ের সাথে দেখা হল শোভনের।  পাশের চুল গুলোতে একটু সাদা রঙ ধরেছে, গায়ের লালচে ফর্সা রঙ এখনও অক্ষত। দেখে শোভনকে জড়িয়ে ধরলেন। শোভন জিজ্ঞেস করল বিয়ে সাদির কথা।পুরোপুরি এরিয়ে গেলেন আরমান ভাই। শোভনকে অবাক করে দিয়ে বললেন “আমি  MBA টা  শেষ  করেছিলাম। এখন এই ব্যাঙ্কের  ভাইস প্রেসিডেন্ট” । ছেলে মেয়ের কথা শোভন আবারও জিজ্ঞেশ করতেই বল্লেন “আমার কোন সংসার নেই শোভন, তোমরাই আমার সংসার”

আরমান ভাইয়ের গাড়ীতে যেতে যেতে শোভন সেই পুরনো মাইলস এর গানটি আবার শুনলঃ

“শুন  ও প্রিয়া কত যতনে

এনেছি  তোমায়-- আমার এ মনে

কি যাদু-- তোমার প্রেমে

কি যাদু-- তোমার চোখে”

 

আটঃ

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সিঙ্গাপুরে এক পার্টিতে বসে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডাতে ব্যস্ত শোভন। ঢাকা ভার্সিটির কোন এক  সিনিয়র কাপল বেড়াতে এসেছেন। বার বছর পরও মুনা আপাকে দেখে শোভনের কোন ভুল হলনা। মুনা আপা শোভনকে পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেন। শোভনও না চেনার ভান করল।খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে  সবাই যার যার প্রেমের গল্প করতে থাকলেন। তারপর আসলেন মুনা আপা।  মুনা আপার ওই গল্পে প্রেম ছিল, আশা ছিল, ভালবাসা ছিল, শুধু  ছিল না  দেশে ফেলে  আসা  শোভনের ওই বাকের ভাইটির কথা।

নয়ঃ(বহুবছর আগের কথা........................................................................)

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

তারা ভরা রাতে ঊত্তরায় আরমান ভাইদের বাসার  ছাদে শোভন বসে আছে। আরমান ভাই  তার বাসর রাত কিভাবে হবে তাই ই বর্ণনা করছিলেন শোভনকে।

তার বাসর ঘরে থাকবে সারি সারি  মোমবাতি আর লাল গোলাপ ফুল।সেই মোমবাতি গুলোর নিভু নিভু আলো তে তিনি মুনা আপার লাজুক মুখটি উঁচিয়ে ধরবেন।

মুনা আপার চোখে থাকবে জল।চোখের সেই জল ঝিক মিক করবে দুঃখিনী এক নদীর ক্ষয়ে যাওয়া নুড়ি-পাথরের মত। দুঃখ, সুখ আর অভিমান নিয়ে মুনা আপার অশ্রু গুলো তার বুকের পাঞ্জাবী ভিজিয়ে ফেলবে।

সেই অস্রু গুলো  তারপর নদী হয়ে বইবে তার  হৃদয়ে।  দুরে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজবে তার প্রিয় গান, মাইলস এর  ট্র্যাক নাম্বার-৮

“শুন  ও প্রিয়া কত যতনে

এনেছি  তোমায়--আমার এ মনে

কি যাদু-- তোমার প্রেমে

কি যাদু-- তোমার চোখে”

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ