তৃতীয় পর্বের লিঙ্ক
চতুর্থ পর্ব
গ্রহণ/গ্রহণ করা/অংশগ্রহণ/ব্যবস্থাগ্রহণ/পদক্ষেপগ্রহন/শ্বাসগ্রহণ/শপথগ্রহণ ইত্যাদি 
আমরা গ্রহণ করা ক্রিয়াপদটির ব্যবহারে কতো যে ভুল করি, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে-Take/Accept। যেমন আমরা বলি-আমি তোমার বাসায় কিছুতেই পানিগ্রহণ করবো না, আমি কিছুতেই তোমার টাকা গ্রহন করতে পারবো না। কী ফারাক বুঝলেন? বিশাল ফারাক আছে দু’টো বাক্যের মাঝে;Take/Accept অর্থে টাকা গ্রহণ করতে পারবো না ঠিক থাকলেও কিন্তু পানিগ্রহণ সেই অর্থে ঠিক থাকেনি।

এখানে পানিগ্রহণ (জলস্পর্শ) পান করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। পানি ও গ্রহণ এ দুটো আলাদা শব্দ মিলেই একশব্দ গঠিত হয়েছে, যার আলাদা অর্থ হবে এমন-”জমজমের হোক বা অন্য কোনো পানযোগ্য বোতলের বা মগের পানিই হোক আমি পান করবোনা। আবার পাণিগ্রহণ অর্থ হচ্ছে বিবাহবন্ধন; ণ-দিয়ে পানিবানানটি লিখলেই কী বিপত্তি ঘটবে, বলুনতো? ঠিক একই রকম অর্থেই ব্যবহৃত অংশগ্রহণ/ব্যবস্থাগ্রহণ/পদক্ষেপগ্রহন/শ্বাসগ্রহণ/শপথগ্রহণ ইত্যাদিও ক্রিয়াবাচক শব্দ। যেমন আমি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ(যোগদান) (অংশ গ্রহণ নয়) করবো না, আমি কোনো ব্যবস্থাগ্রহণ (পদক্ষেপ নেয়া কিন্তু ব্যবস্থা গ্রহণ নয়) করছিনা। তেমনই জোরেজোরে শ্বাসগ্রহণ (শ্বাস গ্রহণ নয়) করো তো? ”আমি শপথগ্রহণ (শপথ গ্রহণ নয়) করে বলছি যে–।”

দেখুন উল্লেখিত শব্দগঠনে জোড়ালাগানো আর স্পেস দেয়াতে কী ধরণের অর্থের ভিন্নতা দেখা দিচ্ছে? সুতরাং দুটো শব্দ একত্র হয়ে ভিন্নার্থগ্রহণ করলে তা কখনোই পৃথক করা যাবে না বা উচিৎ নয়। যেমনঃ অংশগ্রহণ করা মানে Take part আর Share বা ভাগ নেয়া মানে অংশ গ্রহন করা। আর ব্যবস্থাগ্রহণ করা মানে Take action. আবার ব্যবহার ও অর্থভিন্নতা দেখুন-দাঁড়াও তোমার ব্যবস্থা আমিই গ্রহণ করছি!

বাড়ী/শাড়ী/গাড়ী এবং সরকারী/সরকারি
বাংলাএকাডেমী’র প্রমিত বানানের সাথে অনেকক্ষেত্রেই আমি একমত নই। যেমনঃ সরকারী বানানটা প্রচলিত ছিলো মন্দ কী? কিন্তু এখন সরকারী/সরকারি দুটোই সঠিক, যা দ্বন্দ্বের ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। আবার বাড়ী/শাড়ী/গাড়ী ইত্যাদির ঈ-কার তুলে দিয়ে ই-কার বসিয়ে একটাই অবয়ব বা রূপ তৈরি করা হয়েছে বলে ভুল হবার সম্ভাবনা কম, যা আমি পছন্দ করলেও বৃহত্তর স্বার্থে এসবের ই-কার দিয়ে অপর বানানটিও সমর্থন আমি করি। কারণ এসব শব্দের দ্বৈত বানান থাকলে ভুললেখার সম্ভাবনা কমে যাবে। যে কেউ দুটো বানানের একটি লিখলেই তা শুদ্ধ হবে । আগের বা পুরনো বানানে আমার শতশত ছড়া-কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ প্রিন্টেড আকারে ১৯৭৭ সাল থেকে সংরক্ষিত আছে। সন্তানরা তা পড়তে গিয়ে এসব বানান ও শব্দের বিভ্রান্তিতে পড়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নানারকম প্রশ্ন করে তটস্থ করে তোলে। আমি জবাব দিতে গিয়ে প্রায়ই হিমশিম খাই আরকি?

আমরা অনেক বড়বড় একাধিক শব্দসহযোগে গঠিত শব্দ সহজেই মেনে নিলেও তুলনামুলক অনুরূপ ছোটো শব্দকেও অযথা ভাগ করে অর্থই বিগড়ে দেই–ফলে উকিলের ব্যাখ্যার মারপ্যাঁচের কবলে পড়ে আইন-আদালতেও হেরে যাবার সম্ভাবনা ১০০% থাকে। যেমন ৩ শব্দের মিলিত শব্দ হচ্ছে-ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ শব্দটি সঠিক লিখলেও ব্যবসা খাত/জাল ভোট/দর পতন/ সরকার পতন/অন্ধ সমর্থন/পুলিশ প্রহরা/আরব জাগরণ/যুগ যুগ/দিন দিন/পর পর/ দলমত বর্ণ পেশা নির্বিশেষে ইত্যাদি বড়শব্দকে ২/৩/৪/৫ ভাগ করে লিখি, যা ভুল-মহাভুল।

বাংলাভাষা কঠিন কিন্তু মজার ও পরিপূর্ণ ভাষা। আমি যখন আরবীর পাশাপাশি উর্দু পড়েছি তখন দেখেছি–আরবীতে আলিফ, বা, তা, ছা (যদিও শিখেছিলাম আলিফ, বে, তে, ছে উচ্চারণে) থাকলেও উর্দুতে ছিলো পে, টে, চে ইত্যাদি বর্ণ। ফলে আরবীর পে বা প জাতীয় বর্ণ না থাকায় পাকিস্তানকে পড়তাম বাকিস্তান বলে। আরবীর এমন অসম্পূর্ণতা রয়েই গেছে যদিও বাংলায় সে সমস্যাতো নেই-ই বরং অতিরিক্ত বর্ণের দাপটে আমাদের মরার দশা আরকি? শ, ষ, স/ড়, ঢ়, র/জ, য, ঝ/ন, ণ ইত্যাদি সমগোত্রীয় বর্ণকে আমরা ঝামেলা মনে করলেও এরা যে, বাংলাকে পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ভাষায় পরিণত করেছে, তা কি জানেন! ইংরেজিতে বানানের মুলঅক্ষর বা স্বরবর্ণ হচ্ছে ৫টি যথা- A, E, I, O, U যা দিয়ে সব বানান ও উচ্চারণ পরিস্কার হয়না। কিন্তু বাংলায় সে সমস্যা নেই একদম। এবার আমার অনেক পুরনো একটা কবিতা পড়ুন এবং বানান দেখুন--

তিনপিঁপড়ে

তিন পিঁপড়ে কোথায় যেনো যাচ্ছিলো
সামনে কিসের জল গড়িয়ে আসছিলো
তাই দেখে যেই পাশ কাটাতে চাচ্ছিলো
না পেরে হায় হাবুডুবুই খাচ্ছিলো!

বন্যাতো নয় অজুর পানি গড়ছিলো—
সেই পানিতেই খাচ্ছি খাবি করছিলো;
বাঁচার তরে প্রাণপনে যে লড়ছিলো
বিফলতায় চোখের পানি ঝরছিলো।

অজুর জলে ভেসে ভেসেই চলছিলো—
জানের ভয়ে দোয়াও কতো বলছিলো;
আর নিজেদের কানগুলো যে মলছিলো
কারণ ওদের মায়ের কথাই ফলছিলো?

মায়ের বারণ তখন কি আর মানছিলো
তাই যে বিপদ পদেপদেই টানছিলো
এমন ব্যাপার ঘটবে তাকি জানছিলো
শিক্ষা পেয়ে কীযে ভীষণ কানছিলো।
কান্নাকাটির একটা সীমা শেষ ছিলো
আল্লাহতালার করুণারও লেশ ছিলো!
হঠাৎ যে এক শুকনো পাতা ঘেঁষছিলো
ওতে চড়েই বাঁচলো-দারুণ কেস ছিলো!!
(চলবে)

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ